সম্রাট আকবর তার সময়ে সমগ্র বাংলার উপর মুঘল অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পারেননি । সেই সময় বাংলার বড় বড় জমিদারেরা তাদের নিজ নিজ এলাকায় স্বাধীনভাবে শাসন করতো এবং তাঁদের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতো। এ জমিদাররা বারো ভূঁইয়া নামে পরিচিত ছিল l এদের বিবরণ আবুল ফজলের ‘আইন-ই-আকবরি’ ও মির্জা নাথানের ‘বাহরিস্তান-ই-গাইবি’তে রয়েছে| আজকে আমরা বারো ভুঁইয়া নেতা মুসা খান ও ঢাকায় তার মসজিদ বিষয়ে জানবো। তাহলে চলুন, জেনে আসা যাক কে ছিলেন এই মুসা খান? মুসা খান ছিলেন সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে ভূঁইয়াদের মধ্যে সর্বাপাক্ষা শক্তিশালী বারো ভুঁইয়া নেতা। তিনি মুঘল আনুগত্য অস্বীকার করে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে মুঘল আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। তিনি ছিলেন বারো ভুঁইয়ার অন্যতম মসনদ-ই-আলা ঈসা খানের ছেলে। ঈসা খান ছিলেন খিজিরপুর অঞ্চলের জমিদার। তার রাজধানী ছিল সোনারগাঁও। বাবা ঈসা খানের মৃত্যুর পর মুসা খান জমিদারি লাভ করেন। বৃহত্তর ঢাকা, কুমিল্লা জেলার অর্ধেক, রংপুর, বগুড়া ও পাবনা জেলার কিছু অংশ এবং ময়মনসিংহের প্রায় সমগ্র এলাকাজুড়ে ছিল তার জমিদারি। মুসা খানের ক্ষমতার কেন্দ্র ছিল বর্তমান ঢাকার দক্ষিণপূর্ব দিকে পদ্মা, শীতলক্ষ্যা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনার সংগমস্থল অঞ্চল। যেখানে তার খিজিরপুর দুর্গটি ছিল। খিজিরপুরের বিপরীত দিকে ছিল তাঁর পারিবারিক আবাসস্থল সুরক্ষিত কাত্রাবো নগরী, আর বর্তমান নারায়ণগঞ্জে ছিল কদম রসুল নামে আরেকটি সুরক্ষিত সামরিক ঘাটি। তাঁর রাজধানী সোনারগাঁও ছিল দেয়াল বেষ্টিত অত্যন্ত সুরক্ষিত নগরী।
১৬০৮ সালে মুগল সুবাদার ইসলাম খান গোলন্দাজ বাহিনী ও ২৯৫টি রণতরী সহ বিশাল বাহিনী নিয়ে বাংলা জয়ের অভিযান চালান। এই সময় মুসা খান তাঁর মিত্র জমিদারদের কাছে খবর পাঠান যেন তারা অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে মুগল বাহিনীকে প্রতিহত করেন। এ দিকে ইসলাম খান মুসা খানের রাজধানী সোনারগাঁও আক্রমণ করেন। মুসা খানও যুদ্ধের জন্য ব্যাপক প্রস্ত্ততি নেন এবং হাজী শামসুদ্দিন বাগদাদীকে রাজধানীর দায়িত্বে রেখে শত্রু বাহিনীর মোকাবিলার জন্য অগ্রসর হন। শীতলক্ষ্যা নদীর বন্দর খালের মুখে সামরিক গুরুত্বপূর্ণ স্থানে তিনি অবস্থান নেন। বন্দর খালের দুই তীরে দুটি দুর্গের মধ্যে মুসা খান নিজে একটি দুর্গের দায়িত্ব নেন, অপর দুর্গটির দায়িত্ব দেন চাচাতো ভাই আলাওল খানকে, আব্দুল্লাহ খানকে সুরক্ষিত কদম রসুল দুর্গের এবং দাউদ খানকে কাত্রাবো দুর্গের দায়িত্ব দেয়া হয়। ইসলাম খান তাঁর বাহিনী নিয়ে শীতলক্ষ্যার পশ্চিম তীরে অবস্থান নেন। মির্জা নাথান তাঁর বাহিনী নিয়ে হাতীতে চড়ে গোপনে সাঁতরে শীতলক্ষ্যা নদী পার হন এবং দাউদ খানের ঘাটি আক্রমণ করেন। দুই পক্ষে তুমুল মুখোমুখি যুদ্ধের পর দাউদ খান দুর্গ পরিত্যাগ করে তার বাহিনী নিয়ে মুসা খানের সঙ্গে যোগ দেন। মুগল নৌঅধ্যক্ষ ইহতিমাম খান তার গোটা নৌবহর নিয়ে দুলাই নদী থেকে শীতলক্ষ্যায় এসে কদম রসুল ঘাটির উপর আক্রমণ পরিচালনা করেন এবং দুর্গটিও অধিকার করেন। একের পর এক পরাজয়ে মুসা খান এতোটাই বিচলিত হয়ে পড়েন যে, তিনি তাঁর রাজধানী সোনারগাঁও নগর পরিত্যাগ করে ইবরাহিমপুর চরাঞ্চলে পালিয়ে যান। সোনারগাঁও নগরের দায়িত্বে নিয়োজিত হাজী শামসুদ্দিন বাগদাদী পরে ইসলাম খানের কাছে আত্মসমর্পন করেন। ১৬১১ সালের এপ্রিল মাসে এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে সোনারগাঁয়ের পতন ঘটে। শেষ পর্যন্ত তিনি সম্রাট জাহাঙ্গীরের সেনাপতি ইসলাম খানের কাছে পরাজিত হন এবং মোগলদের আনুগত্য মেনে নিতে বাধ্য হন। তবে ইসলাম খান তার অসীম সাহসিকতায় মুগ্ধ হয়ে তার সঙ্গে সুন্দর সম্পর্কই তৈরি রেছিলেন বলে জানা যায়।
দীর্ঘকাল কঠিন রোগভোগের পর ১৬২৩ সালে ঢাকায় মুসা খানের মৃত্যু হয়। ঢাকার ’বাগ-ই-মুসা খান’ এ অবস্থিত মুসা খান মসজিদে তিনি সমাহিত আছেন। মুসা খানের নামানুসারে পুরান ঢাকার চানখাঁরপুল, লালবাগ, সদরঘাট এবং সুপ্রিমকোর্ট, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও শাহবাগ নিয়ে গঠিত হয়েছিল “বাগ-ই-মুসা” বা মুসার বাগান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান শহীদুল্লাহ হল এলাকা সে-সময় পরিচিত ছিল বাগ-ই-মুসা খাঁ নামে। [ঢাকা: স্মৃতি-বিস্মৃতির নগরী, আধ্যাপক মুনতাসীর মামুন] বাগানটিকে মুসলমানদের বাগান বলা হতো। ঐতিহাসিকদের মতে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা ওই বাগান তৈরি করেছিলেন ইতিহাসখ্যাত বারো ভূঁইয়াদের অন্যতম ঈসা খাঁর ছেলে মুসা খাঁ। শুধু তাই নয়, ধারণা করা হয় ঈসা খাঁর পুত্র নবাবপুরের কাছে মুনওয়ার খাঁর বাজার বসিয়ে ছিলেন। [হাকিম হাবিবুর রহমান সংগ্রহ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার] বারো ভুঁইয়াদের স্মৃতি বিজড়িত গৌরব বহনকারী মুসা খান মসজিদটি চরম অবহেলিত অবস্থায় কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের পশ্চিম পাশে দু’টি উঁচু খিলানের ছাদ বিশিষ্ট ভিতের উপর তিনটি গম্বুজের মুসা খান মসজিদ। ঐতিহাসিক এ মসজিদকে কেন্দ্র করে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। জমিদার পরিবার ও শহরের সম্ভ্রান্ত ঘরের ছেলেরা এখানে পড়তে আসতো। মোগল ঢাকার অনেক মসজিদেই এরকম হতে দেখা যায়। ঐতিহাসিক আহমদ হাসান দানীর মতে, এ মসজিদটিশায়েস্তা খানের আমলে নির্মিত বা পরবর্তী সময়ে মুসা খানের পৌত্র মুনওয়ার খানের তৈরি l এবং এটির নির্মাতা তার দাদা মুসা খানের নাম অনুযায়ী এর নামকরণ করেন। দুঃখের বিষয় হলো বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল যেখানে অবস্থিত সেখানে মুসা খানের তৈরি অসংখ্য দালানকোঠা ছিল বলে ঐতিহাসিক মত পাওয়া যায়। ১৯০৪ সালে পূর্ব বাংলা সরকারের কার্জন হল স্থাপনের সময় মুসা খানের তৈরিকৃত স্থাপনাগুলো ভেঙ্গে ফেলা হয়। ঠিক এমন ভাবে এ মসজিদ ও হারিয়ে যেতে পারে পর্যাপ্ত যত্নের অভাবে l আমরা জানিযে ইতিহাসখ্যাত বারোভুঁইয়াদের অন্যতম মসনদ-ই-আলা ঈশা খাঁর ছেলে মুসা খানের নামে মসজিদটির নামকরণ। আর মুসা খানের কবরও রয়েছে অদূরেই, মসজিদের পাশের মাঠের কোনায়। একটি হেলে পড়া পলাশগাছ নামফলকবিহীন সাদামাটা কবরটিকে ছায়া দিয়ে যাচ্ছে।
তথ্যসূত্রঃ মুয়ায্যম হুসায়ন খানের লেখা ভুক্তি, বাংলাপিডিয়া।
ইতিহাসখ্যাত বারোভুঁইয়াদের অন্যতম মসনদ-ই-আলা ঈশা খাঁর পুত্র মুসা খানের নামে মসজিদটির নামকরণ। মুসা খানের কবরও রয়েছে অদূরেই, মসজিদের পাশের মাঠের কোনায়। একটি হেলে পড়া পলাশগাছ নামফলকবিহীন সাদামাটা কবরটিকে ছায়া দিয়ে যাচ্ছে।