দিল্লির হযরত নিজামুদ্দীন দরগাহ কমপ্লেক্সে মধ্যযুগীয় কবিগুরু আমির খসরুর সমাধিসৌধ রয়েছে, যার ভক্ত দিল্লির সুলতানি আমল থেকে আজও বর্তমান রয়েছে। আমির খসরুর গজল এবং কবিতা শুধু দক্ষিণ এশিয়ার সুফি দরগাহের কাওয়ালীদের মধ্যেই শোনা যায় না, এমনকি আজকের বলিউডের সিনেমার গানের ভিডিওগুলিতেও সমানভাবে জনপ্রিয়। তার প্রমাণ রাহাত ফতেহ আলী খান ও আবিদা পারভিনের কন্ঠে তাঁর সর্বাধিক জনপ্রিয় রচনা ‘চ্যাপ তিলকে’র গানটি ২৭ মিলিয়নেরও বেশি অনলাইন ভিউ রয়েছে। তাহলে চলুন দেখে আসা যাক, মৃত্যুর প্রায় ৭০০ বছর পরেও আমির খসরু এতো জনপ্রিয় কেন?
তিনি গঙ্গা-যমুনার মিলিত স্রোতধারার মত হিন্দু – মুসলিম সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের উপাদানগুলির মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে নিজের জীবন ও কাজকে বিকশিত করেছিলেন এবং দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে নিজ দেশ ভারতকে ভালোবেসে ছিলেন। গতানুগতিক ধারায় তার তুলনা করলে হবে না। তিনি কেবলমাত্র শাস্ত্রীয় পারস্যের অন্যতম মহান কবি ছিলেন না, হিন্দি ভাষায় বিকশিত হওয়া ‘হিন্দবি’ ভাষা বিকাশে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির দরবারের প্রধান কবি ছিলেন। হয়তো তিনিই প্রথম ভারতের প্রশংসা করেছিলেন, যা তাঁর নুহ-সিপাহি’র বা ‘নয় স্বর্গ’ বইতে লিখেছেন: “ভারতে খুব বিদ্বান ব্রাহ্মণরা রয়েছে তবে তাদের গভীর জ্ঞানের কেউই কোনও সুবিধা নেয়নি, যে কারণে তারা অন্য দেশে খুব কম পরিচিত। আমি তাদের কাছ থেকে কিছু শেখার চেষ্টা করেছি। তাই আমি তাদের গুরুত্ব বুঝতে পারি…। যদিও তারা আমাদের ইসলাম ধর্ম অনুসরণ করে না তবুও তাদের ধর্মের অনেক নীতি আমাদের অনুরূপ… ”
১৩১৮ সালে রচিত নুহ সিপাহি’র বিশাল দৈর্ঘ্যের রচনায় তিনি আরো লেখেন যে, গণিতের ক্ষেত্রে ভারতের অবদান অতুলনীয়। ভারতের প্রতি তাঁর ভালবাসার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন, “আমি দুটি কারণে ভারতের প্রশংসা করছি। এটি আমার জন্মস্থান এবং আমার দেশ, আর দেশপ্রেম নিজেই একটি মহান ধর্ম ” অনেকের মতে, প্রথম সত্যই দেশাত্মবোধক লেখাটি এসেছে ফার্সিতে দিল্লির কবি আমির খসরুর কলম থেকে। আমির খসরু দিল্লিতে গিয়াসউদ্দিন বলবন থেকে মুহাম্মাদ বিন তুগলক পর্যন্ত মোট ১১ জন সুলতানের শাসন দেখেছিলেন এবং পাঁচ জন শাসকের দরবারের প্রধান কবি ছিলেন। ১১৯৩ সালে মুহম্মদ ঘোরি দিল্লি বিজয়ের পরে ভারতে দিল্লি সুলতানি শাসনের শুরু হয়। দিল্লির মামলুক রাজবংশ এবং বেশিরভাগ শাসক শ্রেণির পাশাপাশি সংস্কৃতিশ্রেণির মানুষেরা ছিলেন তুর্কি জাতির। তেমনি এক সম্ভ্রান্ত তুর্কি পরিবারে আমির খসরু ১২৫৩ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশের কাশগঞ্জ জেলার পাতিয়ালিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। মঙ্গোল আগ্রাসনের কারণে তাঁর পিতা সাইফুদ্দিন মাহমুদ বর্তমান তুর্কমেনিস্তানের তাকাশ শহর থেকে ভারতে চলে আসেন। তিনি ছিলেন লাচিন উপজাতির প্রধান। যে কারণে তিনি সহজেই দিল্লি শহরে সুলতান ইলতুতমিশের পুলিশ বাহিনীতে অফিসার হিসাবে যোগ দেন। আর আমির খসরুর নানা ইমাদ-উল-মুলক সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবনের (১২৬৬-১২৮৭) অধীনে আরজি মুমালিক বা প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
খসরুর যখন মাত্র সাত বছর বয়স তখন তাঁর বাবা মারা গেলে, তিনি তাঁর নানার বাড়িতে বড় হন। ফলে তুর্কি পরিবারে বেড়ে ওঠার পাশাপাশি খসরু দিল্লির দরবারে যেমন প্রবেশাধিকার পান, তেমনি সুফি দরবেশদের খাঁনকাহতে প্রবেশাধিকার পেয়ে যান। সেইকালে খানকাহগুলি ছিল বিদ্যা চর্চার বিশেষ কেন্দ্র। জনশ্রুতি মতে, আমির খসরু হজরত নিজামুদ্দিনের প্রিয় শিষ্য ছিলেন। হযরত নিজামুদ্দিন রাজনীতি থেকে দূরে থাকলেও, আমির খসরু তা ছিলেন না, তিনি দিল্লি সালতানাতের উত্থান ও পতনের সাথে দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে জড়িয়ে ছিলেন। প্রথমে তিনি ১২৭২ সালে ২০ বছর বয়সে সুলতান বলবনের ভাগ্নে মালিক কিশলু খানের অধীনে পেশাগত জীবন শুরু করেন। ১২৮০ সালে তিনি সুলতান বলবনের পুত্র মুলতানের গভর্নর খান মালিক সুলতান মুহাম্মদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। রাজপুত্র ছিলেন উদার এবং কবিতার প্রতি অনুরাগী। খসরু পাঁচ বছরের জন্য মুলতানে অবস্থান করেছিলেন এবং কেবল দরবারের কবি হিসাবেই নয়, সুলতানের সেনাবাহিনীতে অফিসার হিসাবেও কাজ করেছিলেন।
১২৮৭ সালে সুলতান বলবনের মৃত্যুর পরে, তার ভাগ্নে কায়কোবাদ সুলতান হিসেবে সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি বিলাসিতা পছন্দ করতেন এবং বর্তমান দিল্লির মহারাণী বাগে সংগীতজ্ঞ, নৃত্যশিল্পী এবং শিল্পীদের জড়ো করতেন ও পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় খসরু সংগীতের ক্ষেত্রে বিরাট অবদান রাখতে সক্ষম হন এবং কিরাইন সাদাইন নামক একটি গ্রন্থ রচনা করেন, যেটা ছিল সুলতান কাইকোবাদ ও তাঁর পিতার মধ্যের সংঘর্ষ ও মিলনের কাহিনী। যা বাংলার ইতিহাসের একটি প্রাথমিক উৎস গ্রন্থ। তিনি সঙ্গীতের ক্ষেত্রে বিরাট অবদান রাখেন। বিশ্বাস করা হয় যে, আমির খসরুই ভারতীয় বীণা এবং ইরানি তাম্বুরার মিশ্রন করে ‘সেতার’ আবিষ্কার করেছিলেন। তিনিই মৃদঙ্গ থেকে তবলা তৈরি করেছিলেন। শুধু তাই নয়, তিনি কাওয়ালি রীতিটিও আবিষ্কার করেন বলে জানা যায়।
সুলতান কায়কোবাদ নিহত হওয়ার পর বিশৃঙ্খলা সৃস্টি হলে তাঁর এক শক্তিশালী সেনাপতি জালালউদ্দিন খিলজি দিল্লির সিংহাসনে বসেন এবং খিলজি রাজবংশ (১২৯০ – ১৩২০ খ্রিস্টাব্দ) প্রতিষ্ঠা করেন। এই নতুন খিলজির শাসনামলেও আমির খসরু দরবারে নিয়োগ পান। তিনি সুলতান জালালউদ্দিনের দরবারের প্রধান কবি ছিলেন। সুলতান তাকে আভিজাত্যের সম্মানের পোশাক উপহার দিয়েছিলেন এবং বার্ষিক ১২০০ সোনার টংকা বেতন দিতেন। তার দরবারে খসরু নিয়মিত গজল উপস্থাপন করতেন। ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বারানীর লেখা বই ‘তারিখ-ই-ফিরুজ শাহী’ হতে জানা যায় যে, ‘আমির খসরু মেহফিলের জন্য প্রতিদিন নতুন নতুন গজল আনতেন এবং সুলতান জালালউদ্দিন তা শুনে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে দামী দামী উপহার দিতেন।’ সেখানে রসিকতা ও কবিতার আদান-প্রদানের পাশাপাশি নাচ ও সঙ্গীত পরিবেশন করা হত। ধারণা করা হয়, হয়তো সে কারণেই খসরুর অধিকাংশ গজলে সাকী বা মদের পেয়ালা ধারনাকারীর চিত্রটি বারবার ফুটে উঠেছে।
সুলতান জালালউদ্দিনের মৃত্যুর পর আলাউদ্দিন খিলজি ১২৯৬ সালে সিংহাসন আরোহণ করেন। সংগীত ও কবিতার চেয়ে সামরিক বিজয় নিয়ে বেশি আগ্রহী সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির দরবারেও আমির খসরু প্রধান কবি হিসাবে নিযুক্ত হন। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, বর্তমানে বিতর্কিত আলাউদ্দিন খিলজির সাথে চিতরের রানী পদ্মাবতীর যে গল্প তুলে ধরা হচ্ছে, সে বিষয়ে কবি ও আলাউদ্দিন খিলজির জীবনী লেখক আমির খসরু কিছুই লেখেননি, শুধু চিতোর বিজয়ের ইতিহাস লিখে গেছেন। খাজাইনুল ফুতুহ নামক বইতে খসরু আলাউদ্দিন খিলজির বিজয়ের ইতিহাস রচনা করেন, যেখানে চিতোর, গুজরাট, দেবগিরি এবং গভীর দক্ষিণের বিরুদ্ধে আলাউদ্দিনের বিজয়াভিযান সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে লিখেছিলেন। এই সময়েই তিনি তাঁর বিখ্যাত পাঁচটি দীর্ঘ কাব্যের মসনবি লিখেছিলেন। সেগুলো হলো: মাতলাউল আনোয়ার, শিরিন খসরু, মজনু-লায়লা, আইন-ই-সিকান্দারি এবং হাশত-বেহেশত। এগুলো একসাথে ‘পাঞ্জ-গঞ্জ’ নামে পরিচিত। এই সমস্ত মসনবিগুলি উস্তাদ নিজামউদ্দিন আউলিয়াকে উৎসর্গ করেছিলেন। তাঁর আরেকটি বিখ্যাত কাব্য রচনা ‘দেভাল রানি ও খিজর খাঁন’ যেখানে আলাউদ্দিন খিলজির সুদর্শন পুত্র খিজর খান এবং গুজরাটের রাজকন্যা দেভাল রানির একটি মর্মান্তিক প্রেমের গল্প বলা হয়েছে।
তিনি হিন্দি এবং উর্দু ভাষার বিশুদ্ধতা ও উন্নয়নে বিরাট অবদান রেখেছেন। যে কারণে বিশ্বজুড়ে তাঁকে ‘তুতি-ই-হিন্দ’ বা ‘ভারতের তোতা’ বলা হয়। তাঁর রচনাবলীর বেশিরভাগ অংশ ছিল ‘হিন্দাভি’ ভাষায়, যা ব্রজভাষার একটি উপভাষা। এটি দিল্লির আশেপাশে এবং বর্তমানে পশ্চিম উত্তর প্রদেশে প্রচলিত। বলা হয়ে থাকে আমির খসরুই উর্দু ভাষার জনক। ভারতের শাস্ত্রীয় সংগীতেও তাঁর বিশেষ অবদান রয়েছে। সূফী কবি ও সংগীতশিল্পী আমির খসরু দেহলভী আরবিক, ফারসি এবং হিন্দাবি ভাষার (যেগুলো আজও উত্তর ভারত ও পাকিস্তানের লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা নামে পরিচিত হিন্দুস্তানী, দেহলভী ভাষা) শব্দের সমন্বিত শ্লোকের একটি শব্দভাণ্ডার বা অভিধান ‘খালিখ বারী’ তৈরি করেছিলেন। এই সকল কারণেই আজও মৃত্যুর প্রায় ৭০০ বছর পরেও আমির খসরু এতো জনপ্রিয় ও প্রাসঙ্গিক আমাদের কাছে। এই মহান সাধক আমির খসরু ১৩৫৫ সালের অক্টোবরে ৭০ বছর বয়সে মারা যান। আধ্যাত্মিক সুফি হজরত নিজামউদ্দিন আউলিয়ার সমাধীর নিকটে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়েছিল।
তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া ও ইন্টারনেটের কিছু প্রবন্ধ থেকে তথ্য নেয়া হয়েছে।