চন্দ্রবংশীয় শাষনের একশো পঁচাত্তরতম উত্তরাধিকারী মহারাজ বীরচন্দ্র মানিক্য। তিনি মনে প্রানে বৈষ্ণব। ইংরেজ শাষিত ভারতের মধ্যে তিনি এক স্বাধীন নরপতি। কিংবদন্তী অনুসারে তিনি মহাভারতের যযাতির বংশধর। ভোগ – বাসনায় অতৃপ্ত মহারাজ যযাতি তার পুত্রদের কাছে যৌবন ধার চেয়েছিলেন। যে ক’জন পূত্র তাদের পিতার এই উদ্ভট খেয়ালের বিরোধিতা করে তাদেরকে যযাতি নির্বাসনে পাঠান। সেই নির্বাসিত পুত্রদের একজন ছিলেন দ্রুহ্যু, তিনি আর্যাবর্ত ত্যাগ করে অনেক দুরে এসে, উত্তর- পূর্ব ভারতের সীমানায় কিরাত রাজ্যের স্থানীয় রাজাকে পরাজিত করে ত্রিপুরা রাজ্য গড়েন।

এই রাজ্যের প্রজারা সবাই আদিবাসী, বহু উপজাতিতে ভাগ করা, তাদের ভাষাও এক নয়। দুরত্ব ও দূর্গমতার কারনে আর্য সভ্যতা এখানে প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। বৌদ্ধ ধর্ম, হিন্দু ধর্ম, ইসলাম, অনেকে খ্রীষ্ট ধর্মে দীক্ষিত হয়েছে কিন্তু এরা নিজেদের ভাষা এবং আচার ছাড়েনি। অবশ্য রাজবংশ নিজেদের আর্য হিন্দুত্বের উত্তরাধিকার প্রমান করতে ব্যাস্ত।

ত্রিপুরার সরকারি ভাষা বাংলা, কিছু সরকারি কর্মচারি দরবারে ইংরেজি ভাষা প্রচলনের চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু রাজা বীরচন্দ্র মানিক্য তাদের ধমক দিয়ে সেটা বন্ধ করেছেন। সিপাহী বিদ্রোহের পর পুরা ভারত ইংরেজরা শাসন করেছে কিন্তু ত্রিপুরা এমন একটি রাজ্য যেখানে মোঘল শাসন বা ইংরেজ শাসন কোনটাই ছিলোনা।

মনিপুরি মেয়েরা এই বংশের রানী হয়ে আসতো। মহারাজের পত্নী এবং উপপত্নীর সঠিক সংখ্যা তিনি নিজেও জানতেন না। আসাম ও মনিপুরের অনেকগুলি অঙ্গ রাজ্যের মেয়েরাই তাঁর মহিষী, এছাড়াও বিভিন্ন উপজাতীয় দলপতিরা মাঝে মাঝে তাঁকে তাদের গোত্রের মেয়ে উপহার দেয়, তারা রাজবাড়িতে জায়গা পায়, তাদের বলা হয় কাছুয়া। বীরচন্দ্রের বৈধ পুত্র-কন্যার সংখ্যা পঁচিশ।

তিনি ছবি আঁকেন, ফটোগ্রাফি চর্চা করেন, কবিতা লিখেন এবং আবৃত্তি করেন, গানবাজনাও খুব ভালবাসেন, মাঝে মাঝে নিজেও গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠেন। মহারাজ বীরচন্দ্রের অসাধারন জীবনীশক্তি, টানা দুই তিন দিন ও রাত না ঘুমিয়েও তাজা থাকতে পারেন। যখন গানবাজনা শোনার নেশা চাপে তখন একটানা সুর চলতেই থাকে, ওস্তাদদের তিনি থামতে দিতে চান না। তাঁর জেষ্ঠ্য রানী ভানুমতি, যিনি ছিলেন তাঁর বাল্যকালের খেলার সাথী, তাঁর মৃত্যুর পর যখন তিনি খুব ভেঙ্গে পড়েন, সে সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ভগ্নহৃদয়’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলি পড়ে তাঁর মন কিছুটা শান্ত হয়।

তিনি রবি ঠাকুরের কবিতা পড়ে এতটাই মোহিত হন যে, তিনি তাঁর সচীব রাধারমন ঘোষকে কলকাতায় পাঠান, কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্য একটি মানপত্র, একজোড়া ধুতি, একটি উত্তরীয়, একটি শাল, হাতির দাঁতের তৈরি দুটি পুতুল আর একটি ছোট্ট মখমলের পাউচে পাঁচটি মোহর পাঠান সম্মানী হিসাবে। রাধারমন রবীন্দ্রনাথকে জানালেন, নিদারুন শোকের সময় তাঁর কবিতা পড়ে মহারাজ যে সান্ত্বনা পেয়েছেন তার কোন তুলনা হয়না। রবীন্দ্রনাথ তখন সদ্য যুবক, কথাগুলি শুনতে শুনতে তিনি কিছুটা সংকুচিত, কিছুটা গর্ববোধ ও করছেন। যাক, তাঁর কবিতা তাহলে একটা মানুষকে শোকে সান্ত্বনাও দিতে পারে ! মহারাজ বীরচন্দ্র অসুস্থ হবার পরে যখন কলকাতায় চিকিৎসার জন্য আসেন, তখন রবি ঠাকুরের সাথে তাঁর দেখা হয়। রবীন্দ্রনাথের ‘চিত্রা’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলি মহারাজ বীরচন্দ্রের খুব পছন্দের। বইটির কাভার পছন্দ না হওয়ার তিনি বলেন, এত সুন্দর কবিতা, এতো সোনার জলে ছাপানো উচিত , তারপর মরক্কো চামড়ায় বাঁধালে সেটা এর উপযুক্ত হয়।

‘’কত কথা তারে ছিল বলিতে । চোখে চোখে দেখা হল পথ চলিতে’’। মহারাজ বীরচন্দ্র যখন অসুস্থ ছিলেন তখন একদিন রবি ঠাকুরের গলায় এই গানটি শুনে তিনি মুগ্ধ হয়ে বলেন, এমন গান শুনলে বয়স কমে যায়, কাব্য আর গানের কাছে ওষুধ- বিসুধ কোন ছার। আমার সব অসুখ সেরে গেল। মহারাজের স্মৃতীশক্তি খুব একটা প্রখর নয় কিন্তু গানের বানী তিনি কখনো ভোলেন না। কবি মহারাজকে তাঁর জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে আমন্ত্রণ জানালে তিনি বলেন, সেখানে গেলে আমি ধন্য হবো কিন্তু শর্ত হচ্ছে আমি হাওয়া পরিবর্তনের জন্য দার্জিলিং বা কার্সিয়াং গেলে, আমার সাথে আপনাকেও যেতে হবে।

কাব্য বা সংগীত ছাড়াও মহারাজের আরেকটা সখ ছিল নাটক দেখা। দুটি মঞ্চে চলেছে গিরিশবাবু ও অর্ধেন্দুশেখরের নাটক, তিনি তুলনা করে দেখার জন্য সব নাটকই দেখেন। অর্ধেন্দুশেখরের নাটকটি দেখে তিনি তার প্রশংসা করে, অর্ধেন্দুশেখরকে তিনি দিলেন একটি হিরার আংটি আর একহাজার রুপার টাকা দিলেন নট- নটীদের বেটে দেয়ার জন্য ।

মহারাজা বীরচন্দ্র মানিক্য ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছেলে রথীকে নিয়ে মাহারাজের সাথে কার্শিয়াং গেলেন। বৃ্ষ্টিপাতের দরুন বাইরে বেরনো বন্ধ, তাই ঘরেই বসেছে গান-বাজনা আর গল্পের আসর। মহারাজের ব্যাবহার খুবই আন্তরিক কিন্তু তাঁর সামনে রবি সহজ হতে পারেন না। রাজতন্ত্র সম্পর্কে রবির মনে একটা রোমান্টিক মোহ আছে, সামনে বসা মহারাজাকে তিনি দেখেন ইতিহাস ও রুপকথায় মেশানো এক আদর্শ রাজা হিসাবে। যে রাজা স্বার্থশূন্য, দেশপ্রেমিক, প্রজাদের জন্য নিবেদিত প্রান, আবার তিনিই কাব্য- শিল্প-সংগীতের পৃষ্ঠপোষক। বীরচন্দ্র মানিক্যের চরিত্রে অবশ্যই এরকম কিছু গুন আছে কিন্তু সেই রাজা আর বাস্তবের এই মানুষটি এক নয়। ঠিকহলো বৈষ্ণব পদাবলী নিয়ে একটি বই বের করা হবে। এখানে বৈষ্ণব শাস্ত্রের আলোচনা হলো, পদাবলী সংকলনটিতে কোন কোন পদকর্তাদের রচনা নেয়া হবে এবং বইটি কত বড় হবে সেটাঠিক করা হলো। মহারাজ বলেছেন, কোন প্রকাশক খুঁজতে হবেনা, তিনিই দিবেন একলক্ষ মুদ্রা। ছাপাখানার মেশিন কেনার পয়সাও তিনি দিবেন। এইসব বলতে বলতেই তিনি হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেলেন।

স্থানীয় এক চিকিৎসক আসার কিছুক্ষন পর তাঁর জ্ঞান ফিরলোঠিকই কিন্তু শরীর খুব দুর্বল। এরপর সবাই কলকাতায় ফিরে এলো। কার্শিয়াং থাকার সময় মহারাজ রবি ঠাকুরকে বলেছিলেন ‘বিসর্জন’ নাটকটা কি ত্রিপুরায় মঞ্চস্থ করা যায়?

তো কলকাতায় ফিরে রবি ঠাকুর মনে করলেন, মহারাজ যখন ঠাকুর বাড়িতে আসবেন তখন ঐ নাটকটি মঞ্চস্থ করতে হবে, এই হিসাবে বেশ জোরে সোরে শুরু হলো মহড়া। মহারাজ বীরচন্দ্রের পা দূর্বল হয়ে গেছে, বেশিক্ষন দাড়িয়ে থাকতে পারেন না। হাতির দাঁতে বাঁধানো রোজউডের একটা ছড়ি কিনে আনা হলো তাঁর জন্য, সেটা নিয়ে তিনি কিছুক্ষন হাঁটা অভ্যেস করলেন।

মহারাজা বীরচন্দ্র মানিক্য ও মহারানী মনমোহিনী।

ঠাকুরবাড়িতে আজ অনেক গন্যমান্য মানুষ আসবেন এই নাটক দেখতে। মহারাজ ঠাকুরবাড়ি গিয়ে প্রথমেই চলে গেলেন গ্রীন রুমে, সব ঠিকঠাক আছে নাকি দেখার জন্য। গল্পটি ত্রিপুরার রাজবংশের কাহিনী, কোন ত্রুটি যেন না থাকে। সবাই খুব সুন্দর অভিনয় করলো তাই তিনি সবাইকে একটি করে মোহর উপহার দিলেন, কিন্তু মুখটা গম্ভীর। তাঁর ভবনে ফিরে তিনি খুব মন খারাপ করলেন, ত্রিপুরায় এই নাটক মঞ্চস্থ করতে হবে, শুধু কলকাতাতেই ভালো ভালো নাটক হবে, ত্রিপুরায় হবেনা?

পুরো মেজাজটা তাঁর বিগড়ে গেলো, বুকে হাত বুলাতে বুলাতে তিনি তাঁর সাথের লোককে বললেন, আমি এখনই ত্রিপুরা যাবো। আমার প্রাসাদে একটা স্টেজ বানাবো, বিসর্জন’ নাটক দিয়েই শুরু করবো। সবাইকে বুঝিয়ে দিবো ত্রিপুরা কারো চেয়ে কম নয়। ‘বিসর্জন’ বইটি হাতে ছিলো, প্রথমে বইটি খসে পড়লো হাত থেকে তারপর তিনিও ঝুপ করে পড়ে গেলেন, নাক দিয়ে রক্ত পড়েছে, ঠোঁটের পাশে ফেনা। সতেরোদিন পর মহারাজের কিছুটা উন্নতি হলো। সবাই খুশি হলো, চিকিৎসক বলে গেলেন এই সময়টা সাবধানে থাকতে কারন যে কোন সময় অঘটন ঘটতে পারে।

মহারাজের শেষ সময়ে রবি ঠাকুর উপস্থিত থাকতে পারেননি করন সেই সময় তাঁর স্ত্রীর প্রসব বেদনা উঠেছিল, পরদিন মৃণালিনীর একটি ছেলে হলো। ছেলের মুখ দেখেই তিনি দ্রুত রওয়ানা হলেন কেওড়াতলার শ্মশান ঘাটে। রবি মৃতদেহের বুকের উপর একটি ফুলের তোড়া রাখলেন। মহারাজ বীরচন্দ্রের আর ত্রিপুরায় ফেরা হলোনা।

বীরচন্দ্র গণপাঠাগার ও নগর মিলনায়তন, কুমিল্লা

#তথ্যসূত্র #প্রথম আলো_লেখক_সুনীল_গঙ্গোপাধ্যায়