কুসুমকুমারী দেবী যিনি ছিলেন কবি জীবনানন্দ দাসের মা।তিনি ছিলেন এক অসাধারন প্রতিভার অধিকারী। ১৮৯৪ সালে তাঁর বিয়ে হয় বরিশালের সত্যানন্দ দাসের সঙ্গে। কুসুমকুমারীর পরিবার এসেছিল কাছের গ্রাম’ গৈলা’ থেকে, যেখানে জন্ম নিয়েছিলেন বৈদ্য জাতের বহু নাম করা মানুষ। তাঁর বাবা চন্দ্রনাথ দাস বরিশাল ব্রাহ্ম সমাজে যোগ দেন। মেয়ের মতো চন্দ্রনাথ ও এক রকম কবি ছিলেন।
কবি জীবনানন্দের মা বরিশালে চতুর্থ শ্রেনী পর্যন্ত পড়াশুনা করেছিলেন।তিনি যেখানে পড়তেন সেটি একসময় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাঁব বাবা তাঁকে কলকাতার বেথুন স্কুলে ভর্তি করে দেন। স্কুলটা কিছুটা ব্রাহ্ম মনোভাবের হলেও তখনকার দিনে একজন মফস্বলের বালিকার জন্য যথেষ্ট আধুনিক ছিল।
 
তাঁর পূত্র জীবনানন্দ তাঁর মা’য়ের সম্বন্ধে লিখেছেন :
‘’আমার মা শ্রীযুক্তা কুসুমকুমারী দাস বরিশালে জন্মগ্রহন করেন। তিনি কলকাতার বেথুন স্কুলে পড়তেন। খুব সম্ভব তিনি ফার্স্ট ক্লাশ অবধি পড়েছিলেন। তারপরেই তাঁর বিয়ে হয়ে যায়। তিনি অনায়াসেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ পরীক্ষায় খুব ভালো করতে পারতেন’’। এ ব্যাপারে তাঁর সন্তানদের চেয়ে তাঁর মা’য়ের বেশি শক্তি ছিল বলে মনে হচ্ছে।
 
কুসুমকুমারীর কলকাতা স্কুলের অভিভাবক এবং তখনকার ব্রাহ্মদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় রামানন্দ চট্টপাধ্যায়ের প্রচেষ্টায় ১৮৯৫ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হতে থাকে শিশুদের মাসিক পত্রিকা ‘মুকুল’।শিবনাথ শাস্ত্রী আরেকজন নামকরা ব্রাহ্ম যিনি দাস পরিবারের বন্ধু ছিলেন তিনি পত্রিকাটির নামমাত্র সম্পাদক হিসাবে তাঁর নামটি ব্যবহার করতে দেন।
 
 
ব্রাহ্ম সমাজের রবিবাসরীয় নীতি বিদ্যালয়ের সংগে যুক্ত ছিল ‘মুকুল’।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সত্যজিৎ রায়ের ঠাকুরদা উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী সহ বাঙালী সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা এই পত্রিকার লেখক ছিলেন। আরও দুজন লেখক ছিলেন — সত্যানন্দ ও কুসুমকুমারী। সত্যানন্দ নেপোলিয়নের উপর একটা সংক্ষিপ্ত ইতিহাস নির্ভর লেখা লিখেছিলেন। প্রথম বছরে কুসুমকুমারীর কয়েকটা কবিতা ছাপা হয় মুকুলে।এগুলির মধ্যে ‘আদর্শ ছেলে’ বাঙালী শিশুদের জন্য কাব্য সংকলনের একটি প্রধান কবিতা হয়ে দাঁডায়।
 
আদর্শ ছেলে ___
আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে
কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে ?
মুখে হাসি, বুকে বল তেজে ভরা মন
“মানুষ হইতে হবে” — এই তার পণ,
 
১৯০১ সালে রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় বাংলা থেকে এলাহাবাদ বদলি হয়ে গেলে, সেখান থেকে তিনি আরেকটা পত্রিকা বের করেন। এটা ছিল বাঙালিদের সবচেয়ে সম্মানজনক পত্রিকা ‘প্রবাসী’।
এখানেও কুসুমকুমারির অল্প কয়েকটা কবিতা প্রকাশিত হয়। সবচেয়ে বেশি প্রায় শ’খানেক কবিতা ছাপা হয় ‘ব্র্হ্মবাদীতে’।
এমনকি একসময় তিনি শিশুতোষ কবিতার বইও বের করেন ‘কবিতা মুকুল’ নামে।তারপর প্রাচীন সংস্কৃত পুরান থেকে গল্প নিয়ে বের করেন ‘ পৌরানিক আখ্যায়িকা।
 
 
মা’কে জীবনানন্দ দেখেছেন ঘরের টুকিটাকি কাজের ফাঁকে, এমনকি কোন কাজের মাঝখানেও কবিতা লিখতে।
 
‘’ পঁচিশ- ত্রিশ- চল্লিশ বছর আগে আমাদের বরিশালের বাড়িতে পরিবারের লোকসংখ্যা অনেক বেশি ছিল। জেঠিমা ও মা’কে দেখেছি সারাদিন গৃহস্থলির কাজে ব্যাস্ত থাকতে।তখনকার দিনে পরিবারের অবস্থা বিশেষ স্বচ্ছল ছিলনা, কিন্তু জেঠিমা ও মা’য়ের অক্লান্ত কাজকর্মে এবং সর্বোপরি ঠাকুরমার তদারকিতে সহিষ্ণু,নিরলস ও স্বার্থকভাবে সংসারের কাজ সম্পন্ন হতো, সে সব কথা ভাবলে আজও আশ্চর্য লাগে’’।
মা খুব বেশি লেখার সুযোগ পেতেন না, তিনি খুব বড় সংসারের ভিতরে এসে পড়েছিলেন যেখানে শিক্ষা ও শিক্ষিতদের আবহ ছিল বটে কিন্তু দিন রাতের অবিশ্রান্ত কাজের ফাঁকে সময় করে লেখা — তখনকার দিনের সেই অস্বচ্ছল সংসারের একজন স্ত্রীলোকের পক্ষে শেষ পর্যন্ত সম্ভব হয়ে উঠলোনা আর। কবিতা লেখার চেয়ে কাজ ও সেবার ভিতরে ডুবে গিয়ে তিনি ভালোই করেছেন হয়তো।
তাঁর কাজ কর্মের আশ্চর্য নিষ্ঠা দেখে সেই কথা মনে হলেও ভেতরের খবর বুঝতে পারিনি; কিন্তু তিনি আরও লিখলে বাংলা সাহিত্যে বিশেষ কিছু দিয়ে যেতে পারতেন মনে হয়।
 
 
মা’র কবিতায় আশ্চর্য প্রসাদগুন! অনেক সময় বেশ ভালো কবিতা বা পদ্য রচনা করতেন দেখতাম।সংসারের নানা কাজ কর্মে খুবই ব্যস্ত আছেন এমন সময় ব্রহ্মবাসীর সম্পাদক আচার্য্য মনোমোহন চক্রবর্তী এসে বললেন, এক্ষুনি ব্রহ্মবাদীর জন্য তোমার কবিতা চাই। প্রেসে পাঠাতে হবে, লোক দাঁড়িয়ে আছে।
শুনে মা খাতা কলম নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে এক হাতে খুন্তি, আরেক হাতে কলম নাড়ছেন দেখা যেতো।যেন চিঠি লিখছেন, বড় একটা ঠেকছেনা কোথাও; আচার্য্য চক্রবর্তীকে প্রায় তখনই কবিতা দিয়ে দিলেন।
 
পূত্রের জীবন রক্ষার কৃতিত্বও জীবনানন্দের মায়ের ছিল।
ভাই অশোকানন্দ ও বোন সুচরিতার জন্মের আগে জীবনানন্দ যখন খুব ছোট তখন তাঁর যকৃতের ( লিভার) অসুখ হয়।তখনকার দিনে ডাক্তাররা রোগ সারানোর জন্য হাওয়া পরিবর্তনের পরামর্শ দিতেন। সুচরিতা লিখেছেন—
‘’শৈশবে দাদা কঠিন পিড়ায় আক্রান্ত হয়, বাঁচার আশা ছিলনা। মা আর দাদামশায় তাঁকে নিয়ে ঘুরলেন বিভিন্ন স্বাস্হ্যনিবাসে, কত বিভিন্ন জায়গার জনপদে — লখনউ, আগ্রা, দিল্লী।
তখন আমাদের অবস্থা স্বচ্ছল ছিলনা, পুরানো চিঠিপত্র থেকে জানতে পারি। মা’র এই প্রচেষ্টাকে পরিবার- পরিজন সকলেই আত্মঘাতী বলে মনে করেছিলেন।মা তবু বিচলিত হননি,পশ্চিমে দীর্ঘদিন কাটিয়ে সেই শিশুকে সম্পূর্ন নিরাময় করে তিনি ফিরে এসেছিলেন।
 
জীবনানন্দ লিখেছেন—-
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে বেরিয়েছি অনেক দিন হলো, কিন্তু কার কাছে শিক্ষা পেয়েছিলাম আমরা?
আমি পেয়েছি অন্তত তিনজন মানুষের কাছে – একজন মা, একজন বাবা আর একজন ব্রজমোহন স্কুলের হেডমাষ্টার আচার্য্য জগদীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। বরিশাল স্কুল থেকে পাশ করে বেরিয়ে অনেক বড় বড় কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি কিন্তু আজ জীবনের মাঝামাঝি এসে প্রতিনিয়ত টের পাচ্ছি যে আমার জীবনের শিক্ষার ভিত্তি এঁদের হাতেই গড়া।
 
সূত্র —-
অনন্য জীবনানন্দ
জীবনানন্দের সাহিত্যিক জীবনী
Clinton B. Seely