বাউল গান মূলতঃ বাউল সম্প্রদায়ের গান এবং বাংলা লোকসঙ্গীতের ধারা। বাউলরা তাদের দর্শন ও মতামত বাউল গানের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করে। বাউল গান বাউল সম্প্রদায়ের কাছে সাধনসঙ্গীত। প্রত্যেক মানুষের অন্তরে যে পরম সুন্দর ঈশ্বরের উপস্থিতি, সেই অদেখাকে দেখা আর অধরাকে ধরাই বাউল সাধন-ভজনের উদ্দেশ্য। নিজ দেহের মধ্যে ঈশ্বরকে পাওয়ার তীব্র ব্যাকুলতা থেকে বাউল ধারার সৃষ্টি। বাউল সাধকদের সাধনার মাধ্যম হচ্ছে গান।
লালন শাহের গানের মধ্য দিয়ে বাউল মত পরিচিতি পায়। মানবকল্যাণ কামনায় সবচেয়ে বেশি সুর ধ্বনিত হয়েছে মরমি সাধক লালনের গানে। যখন মার্ক্সবাদের জন্ম হয়নি, তখন বাংলাদেশের এক গ্রামে বসে লালন লেখেন—
এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে,
যেদিন হিন্দু -মুসলমান, বৌদ্ধ- খ্রিষ্টান,
জাতি গোত্র নাহি রবে, শোনায়ে লোভের বুলি,
নেবে না কাঁধের কুলি, ইতর আতরাফ বলি,
দূরে ঠেলে না দেবে, আমীর ফকির হয়ে এক ঠাঁই
সবার পাওনা খাবে সবাই, আশরাফ বলিয়া রেহাই,
তবে কেউ নাহি পাবে।’
বাউল মত সতেরো শতকে জন্ম নিলেও লালন সাঁইয়ের গানের মধ্য দিয়ে উনিশ শতক থেকে বাউল গান জনপ্রিয়তা পায়, তিনিই শ্রেষ্ঠ বাউল গান রচয়িতা। ধারণা করা হয় তিনি প্রায় দু’হাজারের মত বাউল গান বেঁধেছিলেন, যা আমাদের জীবনের সাথে যেমন সম্পর্কিত তেমনই সুরসমৃদ্ধ। জাতিসংঘের শিক্ষা ও গবেষণা সংস্থা ইউনেস্কো তার সদর দপ্তর প্যারিস থেকে ২০০৫ সালের ২৭ নভেম্বর এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী বাউল গানকে মানবতার ধারক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। সারা বিশ্বের ৪৩টি বাক ও বিমূর্ত ঐতিহ্য চিহ্নিত করতে গিয়ে ইউনেস্কো বাংলাদেশের বাউল গানকে অসাধারণ সৃষ্টি বলে আখ্যা দিয়ে একে বিশ্ব মানবতার ঐতিহ্যের ধারক বলে ঘোষণা দেয় ‘দি রিপ্রেজেন্টিটিভ অব দি ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি’ হিসাবে তালিকাভুক্ত করে।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ভাবে বাউলদের সাধনা ও গান সম্পর্কে প্রাথমিকভাবে যারা আগ্রহী ছিলেন,তারা হলেন : কাঙাল হরিনাথ মজুমদার, নবকান্ত চট্টোপাধ্যায়, সরলা দেবী, ইন্দিরা দেবী, পরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলার বাউল ও বাউল গান সম্পর্কে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত
‘আমার সোনার বাংলা
আমি তোমায় ভালবাসি’
সুরটি নেয়া হয়েছে বাউল গগন হরকার গানের সুর ‘আমি কোথায় পাবো তারে’ থেকে ।
প্রাচীন বৌদ্ধ সহজিয়াদের সাহিত্য-সংস্কৃতির নিদর্শন আনুমানিক ৬৫০-১২০০ খ্রিষ্টাব্দে রচিত চর্যাগীতির অনেক পদের সাথে বাংলার বাউলদের দেহ-সাধনার কথা যেন একইরকম ভাবে শোনা যায়। যেমন- চর্যার প্রথম পদেই লুইপা যে দেহ সাধনার কথা বলেছেন, তা হলো- ‘কাআ তরু বর পঞ্চ বি ডাল।/চঞ্চল চিএ পৈঠ কাল॥/দৃঢ় করিঅ মহাসুহ পরিমাণ।/লুই ভণই গুরু পুচ্ছিঅ জান॥’ মানে মানবদেহে গাছের শাখার মতোই পাঁচটি ইন্দ্রিয় রয়েছে, আর তাদের চঞ্চলতার জন্য মৃত্যু ধেয়ে আসে। কিন্তু তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে মহাসুখের দেখা মেলে’। লুইপা আরো বলেন- গুরুর কাছ থেকেই সেই দেহ-সাধনায় মহাসুখ পাবার কৌশল জানা যায়। এ ধরনের কথার ভেতর দিয়ে দেহ-সাধনার জন্য যে গুরু আবশ্যক সেই নির্দেশনা পাওয়া যাচ্ছে। বাংলার বাউলরা আজও দেহ-সাধনার জন্য চর্যায় বর্ণিত সেই গুরুকেই আশ্রয় করে থাকেন।
বাউল গান কবে থেকে শুরু হয়েছে সে সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য জানা যায় নি, তবে অনুমান করা হয় যে, খ্রিস্টীয় সতেরো শতক কিংবা তার আগে থেকেই বাংলায় এই গানের প্রচলন ছিল। বাউল গানের প্রবক্তাদের মধ্যে লালন শাহ্, পাঞ্জু শাহ্, সিরাজ শাহ্ এবং দুদ্দু শাহ্ প্রধান। এদের ও অন্যান্য বাউল সাধকের রচিত গান গ্রামাঞ্চলে ‘ভাবগান’ বা ‘ভাবসঙ্গীত’ নামে পরিচিত। কেউ কেউ এসব গানকে ‘শব্দগান’ ও ‘ধুয়া’ গানও বলে থাকেন। বাউল গান সাধারণত দুপ্রকার দৈন্য ও প্রবর্ত। এ থেকে সৃষ্টি হয়েছে রাগ দৈন্য ও রাগ প্রবর্ত। এই ‘রাগ’ অবশ্য শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের রাগ নয়, ভজন-সাধনের রাগ।
বৈষ্ণব রসশাস্ত্রের মতো বাউল গানে ‘রাগ’ শব্দটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এখানে ‘রাগ’ অর্থে অভিমান এবং প্রেমের নিবিড়তা বোঝায়। কাঙ্ক্ষিতজনের প্রতি নিবেদিত প্রেমের প্রগাঢ় অবস্থার নামই রাগ। রাগ দৈন্যে এমন ভাবই দেখা যায়। বাউল গান সাধারণত দুটি ধারায় পরিবেশিত হয় আখড়ার ভিতরে সাধনসঙ্গীত এবং আখড়ার বাইরে অনুষ্ঠানভিত্তিক। আখড়ার গানের ঢং ও সুর শান্ত এবং মৃদু তালের। অনেকটা হামদ, গজল কিংবা নাতের মতো। লালন শাহ্-এর আখড়ায় বসে ফকিররা এ ধরনের গান করে থাকে। অন্য ধারার চর্চা হয় আখড়ার বাইরে জনগনের সামনে। এই গানের সঙ্গে সাধারনত একতারা, ডুগডুগি, খমক, ঢোলক,সারিন্দা, দোতারা ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র বাজানো হয়। তাল দাদরা, কাহারবা, কখনও ঝুমুর, একতালা কিংবা ঝাঁপতাল। শিল্পীরা নেচে নেচে গান করে। কখনও গ্রাম এলাকায় রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটলে বাউল গানের মাধ্যমে তা নিরাময়ের জন্য প্রার্থনা করা হয়।
বাউল মতে আত্মা ও পরমাত্মা অভিন্ন। এই দেহস্থিত আত্মাই মানুষ, মানের মানুষ, রসের মানুষ, অলখ সাঁই। বাউলের ‘রসস্বরূপ’ হচ্ছে সাকার দেহের মধ্যে নিরাকার আনন্দস্বরূপ আত্মাকে স্বরূপে উপলব্ধি করার চেষ্টা, এটিই আত্মতত্ত্ব। এর মাধ্যমে অরূপের কামনায় রূপ সাগরে ডুব দেয়া, স্বভাব থেকে ভাবে উত্তরণ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং শান্তিনিকেতন চিরকাল বাউল আর বাউলের গানকে লালন করে এসেছে। ১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবরে ‘হিতকরী’ পত্রিকার মতে, ১১৬ বছর বয়সে লালনের মৃত্যু হয়। আর ১৮৯১ সালে রবীন্দ্রনাথ যান শিলাইদহে। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে লালন ফকিরের দেখা হয়নি। অন্যদের কন্ঠে তিনি লালনের গান শুনেছেন।
ছেঁউরিয়ার লালন মাজারের আশেপাশে এখনও একটি কথা ভেসে বেড়ায় , রবীন্দ্রনাথ নাকি লালন সাঁই-এর গান লেখা মূল খাতাটি এনেছিলেন। কিন্তু আর ফেরত দেননি’। যদিও এ অভিযোগের যথার্থ উত্তর দিয়েছেন উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। তিনি স্পষ্ট ভাবেই জানিয়েছেন, জমিদারি এস্টেটের কর্মী বামাচরণ ভট্টাচার্য ওই খাতাটির গানগুলি নকল করে দিয়েছিলেন। পরবর্তী কালে রবীন্দ্রনাথ তার থেকেই বেছে বেছে কুড়িটি গান ১৩৩২ বঙ্গাব্দের ‘প্রবাসী’তে প্রকাশ করেন। এর পরেই সুধী জনের নজরে আসে বাউল এবং বাউলগান।