পুরাণ বা মহাকাব্যে খলনায়ক মাতুল হিসেবে কংস যতটা আলোচিত, ততটা নন শকুনি যদিও তাঁকেই কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের জন্য দায়ী করা হয়। সাধারণ চক্ষে দেখলে মনে হয় তিনি ছিলেন পান্ডবদের ঘোরতর শত্রু এবং কৌরবদের পরম হিতাকাংখী। কিন্তু , সত্যি এটাই যে গান্ধাররাজের মূল শত্রু ছিলেন ভীষ্ম, ধৃতরাষ্ট্র। কৌরবদের সাহায্য করার আড়ালে শকুনির মূল উদ্দেশ্য ছিল সমগ্র কুরু বংশ ধ্বংস করে দেওয়া | এই অব্দি মোটামুটি প্রায় সবারই জানা, কিন্তু অনেকেই হয়তো জানেন না যে, এই শত্রুতার বীজ লুকিয়ে ছিল গান্ধারীর বিয়েতে |
গান্ধারী এবং শকুনি ছিলেন গান্ধাররাজ ( বর্তমান আফগানিস্তান ) সুবলের সন্তান | জ্যোতিষী ছকবিচার করে বলেন, গান্ধারী স্বামীহীনা হবেন | সতর্কতা নিতে তাঁর সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয় এক ছাগলের | এরপর সেই ছাগটিকে মেরে ফেলা হয় | ধৃতরাষ্টের সঙ্গে বিয়ের সময় এই ঘটনা গোপন রাখা হয় |পরে কুরু বংশে প্রকাশিত হয়ে পড়ে যে বিধবা অবস্থায় গান্ধারীর বিয়ে হয় ধৃতরাষ্টের সঙ্গে ! এই কথা গোপন রাখার জন্য গান্ধার রাজ্য আক্রমণ করেন ভীষ্ম বিরাট কৌরব বাহিনী নিয়ে | যুদ্ধে পরাস্ত হন রাজা সুবল | বন্দি করা হয় শকুনি-সহ তাঁর শতপুত্রকে | তাঁদের প্রাণে হত্যা না করে অভূক্ত রাখা হয়। কারাগারে আটক কয়েকশো গান্ধার যুদ্ধবন্দি | কিন্তু খাবার দেওয়া হত মাত্র একজনের | এইভাবে তিলে তিলে তাঁদের হত্যার পরিকল্পনা নেয় হস্তিনাপুর রাজপুরুষরা |
গান্ধার রাজবংশ তখন স্থির করে, বাঁচিয়ে রাখা হবে চতুরতম বংশধর শকুনিকে | তাই সবাই অনাহারী থেকে ওই সামান্য খাদ্য দেওয়া হত শকুনিকে | এইভাবে বন্দিদশায় একে একে মারা যান শকুনির সব ভাই | মৃত্যু হয় গান্ধাররাজ সুবলেরও | শুধু প্রতিশোধ গ্রহণের লক্ষ্যে জীবিত থাকেন শকুনি | প্রাণধারণের জন্য তিনি নাকি ভাইদের মৃতদেহ পর্যন্ত খেতেন!
বেদব্যাসের মহাভারতে না থাকলেও এই মহাকাব্যের আঞ্চলিক রূপে আছে, সুবল তাঁর পুত্রকে পরামর্শ দেন তাঁর হাড় থেকে পাশার ঘুঁটি বানাতে, এবং শকুনি নাকি সেইরূপ করেন।
যাই হোক, বন্দিদশা থেকে একদিন মুক্তি পেলেন শকুনি | একে অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে দিদির বিয়ে তিনি মেনে নিতে পারেননি | তার উপর চোখের সামনে দেখেছিলেন পরিবারের সবার মৃত্যু | ফলে প্রতিশোধস্পৃহায় জ্বলতে থাকা শকুনি এসে উঠলেন দিদি গান্ধারীর কাছে |গান্ধার সিংহাসন পড়ে থাকল শূন্য | উলুকা এবং বীরকাসুরা নামে শকুনির দুই পুত্র ছিল। পিতাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হস্তিনাপুরে এসেছিলেন উলুকা। কিন্তু পিতামহ ভীষ্মকে হত্যা এবং কুরু বংশ ধ্বংস না করা পর্যন্ত গান্ধারে ফিরে যেতে অস্বীকার করেন শকুনি।পুত্র উলুকাকে শকুনি বললেন, রাজ-ঐশ্বর্যের থেকে তাঁর কাছে অনেক বেশি প্রিয় প্রতিশোধ চরিতার্থ করা |
ধ্বংসের খেলায় নেমে ধূর্ত শকুনি বুঝলেন দুর্যোধন মূর্খ এবং গোয়াঁড় | তাঁকেই তিনি ব্যবহার করলেন নিজের চালের দান স্বরূপ |শকুনি মন্ত্রণা দিতে লাগলেন ভাগনে দুর্যোধনকে | শকুনির লক্ষ্য ছিল কৌরব-পাণ্ডবদের লড়িয়ে দিয়ে পুরো বংশ ধ্বংস করে দেওয়া |সেই দিক থেকে পাণ্ডবদের প্রতি শকুনির কোনও প্রত্যক্ষ রাগ ছিল না। পাণ্ডবরা শকুনির কোনও ক্ষতি করেনি। কিন্তু কুরু বংশের বলেই পান্ডবদেরও শুকুনির কারণে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছিল। তার মন্ত্রণাতেই অয়োজিত হয় পাশাখেলা | যেখানে একে একে সব কিছু হারান পাণ্ডব ভ্রাতারা, হয় দ্রৌপদীর বস্ত্র হরণ | এই পাশা খেলার আসরই কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পূর্বপ্রস্তুতি |
চরিত্রে তামসিক বৈশিষ্ট্যের আধিক্য থাকলেও সাত্ত্বিক শকুনি ছিলেন মহা শৈব | কেরলের কোল্লাম জেলায় পবিত্রেশ্বরমে শকুনির মন্দিরও আছে | ভারতের ইতিহাসেও শকুনির উল্লেখ আছে | গান্ধারের রাজা অম্ভি কুমার ছিলেন রামায়ণের ভরত এবং মহাভারতের শকুনির বংশধর | আলেকজান্ডার যখন ভারত অভিযানে আসেন, তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করেন অম্ভি | পরে সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের হাতে নিহত হন তক্ষশীলায় তাঁর একদা সহপাঠী এবং শকুনির উত্তরসূরী অম্ভি কুমার |