১৯২৫ সালের ঢাকা; ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশন থেকে বেরিয়ে রেললাইন ধরে নারায়ণগঞ্জের দিকে কিছুদূর এগুলে উয়ারি। উয়ারির শেষ সীমানায় এক সরু রাস্তা চলে দিয়েছে নারিন্দার দিকে। সরু সেই রাস্তার একপাশে বহু পুরাতন খ্রিস্টান কবরখানা আর তার বিপরীতে উঁচু পাচিলঘেরা কম্পাউন্ডের ভেতর দোতলা মস্ত বাড়ি। বাড়িটি বেশ রহস্যময়। প্রধান ফটকটি সচরাচর খুলতে দেখা যায় না, এমনকি রাস্তার দিকের জানালাগুলোও সারাদিন বন্ধ! বোঝা যায়, এ বাড়িতে সাধারণের প্রবেশাধিকার সীমিত। বাড়ির ছাদে বড় বড় অক্ষরে উৎকীর্ণ আছে অদ্ভুত এক ঘোষণা- ‘Aesthetic and Aristocratic Association’। ‘কালচার হাউজ’ নামে এই বাড়ির মালিক বলধার জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী।

বলধা বাগানে বিশিষ্ট অতিথিদের সাথে উপবিষ্ট জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী (সামনে বাম হতে চতুর্থ)

বিশ শতকের প্রথম দশকে জয়দেবপুরের বলধার বসতবাড়ি ছেড়ে ঢাকার উয়ারি এলাকায় জমিদারি কিনে সেখানে দোতলা বাড়ি তৈরি করে বসবাস শুরু করেন জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ। গাছপালার বড় শখ তাঁর; বাড়ির উত্তরপাশের বিস্তৃত স্থানে গড়ে তুলতে শুরু করেন শখের বাগান। উদ্যানচর্চার পাশাপাশি চলে সঙ্গীত আর নাটকের চর্চা। নিজেই নাটক লিখছেন, সে নাটকের বই ছাপাচ্ছেন, আবার বেতনভুক্ত অভিনেতা-অভিনেত্রীদের দিয়ে বাড়ির আঙিনার মঞ্চে সে নাটকের অভিনয়ও চলছে। শরীরচর্চার জন্য গড়ে তুলেছেন কুস্তির আখড়া, জাপান থেকে কুস্তিগীর এসে খেলা শেখাচ্ছে। আর এত সব চর্চার পাশাপাশি শৌখিন নরেন্দ্র নারায়ণ সদাব্যস্ত দুর্লভ সব বস্তু সংগ্রহের নেশায়। সে সংগ্রহের তালিকায় যোগ হচ্ছে দুষ্প্রাপ্য সব বইপত্র থেকে শুরু করে হরেকরকম মুদ্রা, যুদ্ধাস্ত্র, হস্তশিল্প, এমনকি সামুদ্রিক সম্পদের নানা উপকরণ। বাড়িটির একতলায় চারটি কামরাজুড়ে প্রায়  চার হাজার নিদর্শন নিয়ে তিনি গড়ে তুলেছেন নিজের শখের সংগ্রহশালা- বলধা জাদুঘর। বলধা জাদুঘরকে নরেন্দ্র নারায়ণ উল্লেখ করেছেন ‘হোম মিউজিয়াম’ হিসেবে। বিশিষ্ট অতিথিদের স্বাগত জানিয়ে লেখা এক কবিতায় তিনি লিখেছেন-

‘Welcome visitor, hope you will find here some

Of interest, have a look at HOME MUSEUM

If it is in a way kindergarten of all history

Love’s worship on Art, Beauty, Memory and Glory.’

তবে তাঁর মৃত্যুর আগে এই জাদুঘর সাধারণের জন্য উন্মুক্ত ছিল না। নরেন্দ্র নারায়ণ পরলোকগত হন ১৯৪৩ সালে। মৃত্যুর আগে তিনি এক দলিলে বলধা বাগান ও সংগ্রহশালার যাবতীয় ব্যয় মিটানোর জন্য বলধা স্টেটের আয়কে উৎস হিসেবে চিহ্নিত করে যান। তাঁর মৃত্যুর পর সংগ্রহশালার দায়িত্ব বর্তায় মেয়েজামাই অতুলচন্দ্র রায়ের ওপর। তিনি সংগ্রহশালাটি প্রথমবারের মতন দর্শনীর বিনিময়ে আমজনতার জন্য উন্মুক্ত করে দেন। রবিবার বাদে সপ্তাহের বাকি দিনগুলোতে বেলা ২টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত এটি উন্মুক্ত থাকত। এর বদৌলতে ঢাকাবাসী সাধারণ মানুষেরা প্রথমবারের মতন কালচার হাউজের অঙ্গনে ঢুকবার অধিকার পায়। কেমন ছিল এই সংগ্রহশালা? এর এক চমৎকার বিবরন পাওয়া যায় অধ্যাপক আহমদ হাসান দানির বর্ননায়। অধ্যাপক দানি ১৯৫০ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত ঢাকা জাদুঘরের কিউরেটর ছিলেন। তিনি লিখেছেন-

‘As we enter the museum from the roadside we get into a porch where to big drums of bronze, conical in shape, have been kept…..We pass from the porch into a long rectangular hall, which has showcases arranged lengthwise. On our right, we have a stock of books mostly on art and architecture in the upper shelf and textile collections below. But just over the doorway are hung up metal and wooden masks of tiger, deer, etc. ….’

নবাব সিরাজউদ্দৌলার কথিত তরবারি-ফিরাঙ্গি’

কি কি ছিল এই জাদুঘরের সংগ্রহে? প্রথম কক্ষের বিবরণ থেকে দেখা যায় এখানে সংরক্ষিত ছিল বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার ব্যবহৃত তরবারি এবং তাঁর দরবারের গালিচা। তবে তরবারিটি সত্যি নবাবের কিনা তা নিয়ে বিতর্ক আছে। কক্ষে ঢুকবার মুখে ছিল মুঘল আমলের কোনও যুদ্ধে ব্যবহৃত নাকাড়া, কক্ষ জুড়ে শোকেসে রাখা ছিল শত শত বছরের পুরাতন মুদ্রার এক বিশাল সংগ্রহ। ১৮২৯ সালের একটি লিথোগ্রাফের উল্লেখ পাওয়া যায় যেখানে অঙ্কিত আছে ঢাকার নায়েব নাযিমের দরবারের ছবি। দ্বিতীয় কক্ষে ছিল গ্রাম ও নগরজীবনের মিনিয়েচার মডেল, পোড়ামাটির পুতুল দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল নানা পেশার লোকের দৈনিক ব্যস্ততার চালচিত্র। এছাড়া ছিল মুর্শিদাবাদের হাতির দাঁত ও ঢাকার ফিলিগ্রি ও শঙ্খের কাজের নানা নিদর্শন। হাতির দাঁতের তৈরি আসবাবপত্রের নিদর্শনও প্রদর্শনীতে ছিল। মুর্শিদাবাদ এবং লখনৌ এর অনেক সঙ্গীতসাধক ও সমঝদারের সাথে জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণের সখ্যতা ছিল। সেই সূত্রে এই দুই এলাকা থেকে প্রচুর দুষ্প্রাপ্য উপকরণ তিনি সংগ্রহ করেছিলেন। তৃতীয় কক্ষের যুদ্ধাস্ত্র সামগ্রীর সংগ্রহ ছিল সবচেয়ে আকর্ষণীয়। এখানে ছিল বন্দুক, গদা, বর্শা , যুদ্ধে ব্যবহৃত লোহার জামা, শিরস্ত্রাণ, বাহুস্ত্রাণ এবং তরবারির এক বিপুল সংগ্রহ; এর মাঝে টিপু সুলতানের ব্যবহৃত তরবারিও ছিল।  চতুর্থ কামরায় ছিল প্রবাল এবং সামুদ্রিক অন্যান্য উপকরণের সংগ্রহ। স্টাফড বা মমীকৃত বেশ কিছু প্রাণির দেহাবশেষ ছিল; কাঁচবন্দী বড় এক বাঘের কথা এসেছে কয়েকটি লেখায়। এর বাইরে ছিল হরেকরকম ভাস্কর্য।

মুর্শিদাবাদের হাতির দাঁতের হস্তশিল্প

বলধা জাদুঘর সাধারণের জন্য উন্মুক্ত হওয়ার পর এর জনপ্রিয়তা নিমতলিতে অবস্থিত তৎকালীন ঢাকা জাদুঘরকে ছাড়িয়ে যায়। ১৯৬৩ সালে ঢাকা জাদুঘর বলধা জাদুঘরের অধিকাংশ সংগ্রহ অধিগ্রহণ করে। সংগ্রহযোগ্য নয় এমন অনেক বস্তু বিক্রি করে প্রাপ্ত অর্থ জাদুঘরের তহবিলে জমা রাখা হয়। ঢাকাবাসীর অনেকের সংগ্রহে সেসব বিক্রিত বস্তুর খোঁজ মিলবে।

হাতির মস্তকাবরণ

বলধা জাদুঘরের উয়ারির সেই ভবনটি ভেঙে ফেলা হয়েছে বহু আগে। সেখানে উঠেছে বহুতল ভবন। মুছে গিয়েছে জাদুঘরের নাম। শুধু বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে ‘বলধা সংগ্রহ’ নামে টিকে আছে জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণের শখের কিছু সংগ্রহ।

 

সহায়ক সূত্র-

১. A General Guide to the Dacca Museum, 1964

২. বলধা গার্ডেন ও নরেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী, ড. মোহাম্মদ আলী খান, মুক্তচিন্তা, ১৯৯৯।