দাবা
বাংলাদেশের গ্র্যান্ড মাস্টার নিয়াজ মোর্শেদকে কম-বেশি সবাই চেনেন। ১৯৮৭ সালে বিশ্ব দাবা সংস্থা (ফিদে) নিয়াজ মোর্শেদকে মাত্র ২১ বছর বয়সে গ্র্যান্ড মাস্টারের মর্যাদা দেয়। যা ছিল বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার ১ম গ্র্যান্ড মাস্টার এবং এশিয়ার ৫ম গ্র্যান্ড মাস্টার। কিন্তু অল্পসংখ্যক লোকই জানেন এই দাবা খেলা মোঘল আমলে খুবই জনপ্রিয় খেলা ছিল। তাছাড়া ইতিহাস আছে, দাবা খেলার জন্ম ভারতে; ইউরোপে নয়। প্রকৃতঅর্থে মুসলমানদের মাধ্যমে এই খেলা সারাবিশ্বে ছড়িয়েছে। প্রাচীন ভারতবর্ষের ক্রীড়া সংস্কৃতি নিয়ে কথা বলতে গেলে উঠে আসে নানা জাতি ও তাদের সংস্কৃতির খেলার ইতিহাস। ভারতে জনপ্রিয় খেলাগুলোর মধ্যে প্রথমেই যার নাম আসে, তার নাম দাবা। অনেকের ধারণা খেলাটি ইরান থেকে এসেছে। কিন্তু আসলে এটা ভারতবর্ষের খেলা। সম্রাট আকবর দাবা খেলা খুব পছন্দ করতেন। এটা শুধু খেলা ছিলনা; এর মাধ্যমে যুদ্ধের কৌশলও সাজানোর বুদ্ধির চর্চা হত। এর মাধ্যমে তিনি খেলোয়াড়দের মধ্যে ঐক্য স্থাপন করার চেষ্টা করতেন। মোঘল হারেমেও এই খেলার প্রচলন ছিল। এমনকি জাহাঙ্গীরের স্ত্রী আরাম জান বেগম একজন সুপরিচিত দাবা খেলোয়াড় ছিলেন।
প্রথম স্যার উইলিয়াম জোনস প্রমাণ করেন যে, দাবা ভারতীয় খেলা, যার বাংলা নাম ‘চতুরঙ্গ’। চতুরঙ্গ মানে তৎকালীন ভারতীয় সেনানীতির চারটি মূল অঙ্গ বা স্তরবিন্যাসকে বোঝায়; যথা- হস্তীবাহিনী, রথে আরোহী বাহিনী, অশ্বারোহী বাহিনী এবং পদাতিক বাহিনী। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকে পারস্যরা ভারতীয়দের কাছ থেকে এই খেলাটি শেখে এবং নিজেদের দেশে খেলাটি চালু করে। পারস্যে এটি ‘শতরঞ্চ’ নামে পরিচিত। ধারণা করা হয়, পারসিক ‘শাহ-মাত’ শব্দ থেকে বাংলায় ‘কিস্তিমাত’ এবং ইংরেজি ‘চেকমেট’ শব্দের উৎপত্তি; যার অর্থ ‘রাজা এবার মৃত’ । বিজয়ী দাবাড়ু এটা জেতার পর বলেন। দাবা দুজন বা চারজনে খেলতে পারতেন। আধুনিক দাবার চেয়ে প্রাচীন ভারতীয় দাবা ছিল অনেকটাই অন্য রকমের। ৮x৮ মোট চৌষট্টি খোপে খেলা হতো বলে এর নাম ছিল ‘অষ্টপদ’। ঐতিহাসিক আবুল ফজল, বাদাউনি ও মানুচি তাদের বিবরণীতে মোঘলদের মধ্যে এই খেলার জনপ্রিয়তা সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করেন। এদিকে হরপ্পা সভ্যতায় দাবার গুটি পাওয়া গেছে। প্রাচীন সাহিত্য বাণভট্টের রচনা হর্ষচরিতে দাবার উল্লেখ রয়েছে। পারস্যে ৭ম শতকের লেখা চতুরঙ্গনামা বইও পাওয়া গেছে। মানুচি বলেন, জাহাঙ্গীরের রাজদরবারে সভাসদ খানই-খানান এবং পারস্যের শাহ সাফীর মধ্যে ৩ দিন পর্যন্ত চলেছিল। মজার বিষয় হলো, উজবেকিস্থানের সমরখন্দে ১৩০০ বছর আগের দাবা গুটি পাওয়া যায় ১৯৭৭ সালে আফরাসিয়াব প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কালে। বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মাধ্যমে এই খেলা পরবর্তীতে চীন, জাপান, কোরিয়াই পৌঁছায়।
পচিসি
পাচিসি ভারতে মোঘল মহিলাদের খুবই জনপ্রিয় খেলা। আগ্রা ও ফতেপুর সিক্রিতে চতুর্ভূজের মধ্যে মার্বেল পাথরে বর্গাকার আকারে স্থায়ীভাবে র্বোড তৈরি তারই সাক্ষ্য বহন করে। মোঘল চিত্রকর্মের মাধ্যমে আমরা দেখতে পাই সেখানে হারেমের মহিলারা পাচিসি খেলছে। পাচিসি র্বোড চারটি ত্রিভুজ পাশাপাশি স্থাপন করে মাঝখানে কেন্দ্রে একটি চৌকা গঠিত হত।
লুডু
দাবার পাশাপাশি লুডু এবং সাপলুডু খেলার নামও জানা যায়। পাশা বা দ্যুতক্রীড়ার চরিত্র কীরকম হতে পারে, মহাভারতের সৌজন্যে সকলের কাছেই তা মোটামুটি পরিষ্কার। এখানেও ওই বোর্ডের ওপর ঘুঁটি সাজিয়ে খেলা এবং ছক্কা চালার ভাগ্যকৌশলের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে হারজিতের খতিয়ান। লুডু নামটি ব্রিটেনে উনবিংশ শতকে চালু হলেও লুডুর পূর্বতন সংস্করণটির নাম পচিসি, যা কি না মধ্যযুগীয় ভারতে উদ্ভূত হয়েছিল। ছক্কাটি তৈরি হতো একপ্রকার সামুদ্রিক শামুকের খোলস দিয়ে। ‘পচিসি’ অর্থে পঁচিশ, ছক্কার একটিবারের চালে সর্বাধিক স্কোর।
নব কানকড়ি
চোপার বা চৌপার:
পচিসির সমগোত্রীয় আরেকটি খেলা জনপ্রিয় ছিল, যেটির নাম চোপার বা চৌপার। ষষ্ঠ বা সপ্তম শতাব্দীর একটি চিত্রে হরপার্বতীকে চোপার খেলতে দেখা গেছে। অজন্তা গুহাচিত্রে পচিসি ক্রীড়া অঙ্কিত হয়েছে। তবে পচিসি সর্বাধিক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল মুঘল সম্রাট আকবরের আমলে। আকবরের রাজধানী ফতেপুরের প্রাসাদ চত্বরে লালপাথরের ওপর পচিসির একটি বিশাল বোর্ড খোদাই করা রয়েছে। বলা হয়, ষোড়শ শতকে এখানে আকবর পচিসি খেলার রাজকীয় আয়োজন করেছিলেন।
সাপলুডু খেলা আবার অনেকটাই বেশি নৈতিকতায় পরিচায়ক। শিশুদের মধ্যে সনাতন ধর্মীয় নীতিজ্ঞান প্রচার করতে ত্রয়োদশ শতকে সন্ত জ্ঞানদেব এই খেলার প্রচলন করেন এমন বলা হলেও খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে এর উৎপত্তি হয়েছে, এই প্রমাণও পাওয়া গেছে।
তাস
তাসের খেলারও প্রচলন এই ভারতবর্ষেই। রাজারাজড়াদের রাজসভায় পারিষদবর্গের মধ্যে আয়োজিত হতো তাসের প্রতিযোগিতা। ক্রীড়াপত্রম নামের এই প্রাচীন খেলায় তাস তৈরি করা হতো কাপড় কেটে, তার ওপর আঁকা হতো রামায়ণ, মহাভারতসহ নানা কাহিনীচিত্র। তাসগুলোকে যথাসম্ভব মোটা করতে কাপড়ের একাধিক টুকরোও ব্যবহার করা হতো। গঞ্জিফা নামে পরিচিত এই তাসের খেলার প্রচলন ছিল রাজপুতানা, উৎকল, দাক্ষিণাত্য এবং নেপালেও। দেশীয় রাজাদের সভায় যে ধরনের তাসের প্রচলন ছিল, সেটা পরিবর্তিত হয় মুঘল আমলে। আবুল ফজলের ‘আইন-ই-আকবরি’ থেকে জানা যায়, সেই সময় বারো সেটের তাস ব্যবহৃত হতো। প্রতি সেটে তাসের সংখ্যাও হতো বারো। সেখানে দ্বিতীয় স্থানে সবসময় থাকতেন সেনাপতি এবং তার নীচে দশজন সাধারণ সৈনিক। প্রথম স্থানে যিনি থাকতেন তার নাম সেট ভেদে আলাদা হতো, যেমন- অশ্বপতি, গজপতি, নরপতি, ধনপতি, দলপতি, নবপতি, সুরপতি, অস্রপতি, বনপতি, অহিপতি ইত্যাদি। কাপড় ছাড়া কচ্ছপের খোল দিয়েও তৈরি হতো তাস। অষ্টাদশ শতকে ইউরোপীয়রা কাগজের তাস আমদানি করলে প্রাচীন পদ্ধতিটি আস্তে আস্তে বিলুপ্ত হতে থাকে। বদল আসে নিয়মেও। শুরু হয় বাহান্ন তাসের খেলা। সাহেব-বিবি-গোলাম-টেক্কার দাপটে হারিয়ে যেতে থাকে নরপতি, গজপতি, ধনপতিরা।