British Empire Spearheaded by plebians, this was a mutiny that shook the British Empire , Wikimedia

মঙ্গল পান্ডের ফাঁসির ঠিক উনপন্চাশ দিন পর আগুন জ্বলে উঠলো আম্বালায়। মাঝরাতে সিপাহি ব্যারাকের ছাউনিতে আগুন জ্বলে উঠে ।প্রতিদিন এটা বাড়তে থাকে। কে বা কারা এই আগুন লাগায় সেটা টের পাওয়া যায়না। তবে যে সব সিপাহি চর্বির মতো জিনিষ মাখানো খোলস সমেত কার্তুজ ব্যাবহার করে, আগুন লক লক করে শুধু তাদেরই ছাউনিতে।

দিল্লীর জুমা মসজিদের গায়ে হঠাৎ করে দেখা গেল এক ইস্তেহার। পারস্যের শাহ হিন্দুস্তানের মুসলমানদের উদ্দেশ্য করে আহ্বান জানিয়েছেন জেহাদে যোগ দেয়ার জন্য। তিনি খুব শিগগির বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে ব্রিটিশ রাজকে উৎখাত করতে আসছেন। এতো পারস্য থেকে আসেনি , তবে কে লাগাল এই ইস্তেহার? দিল্লীর ইংরেজ সেনা নায়ক সাইমন ফ্রেজার রাগে জনতার সামনে সেটি কুচিকুচি করে ছিঁড়ে ফেললেন। পরদিন ঐরকম একটা ইস্তেহার দেখা গেল লালকেল্লার দেয়ালে। আফগানস্থানের শাষক দোস্ত মহম্মদও নাকি তাঁর ফৌজ নিয়ে ভারতে আসছে পারস্যের শাহের সাথে যোগ দিতে। কানপুরের কাছে বিঠুরে নানাসাহেব ক্ষুব্ধ এবং অপমানিত কারন ইংরেজ তাঁর জায়গীর কেড়ে নিয়ে বছরে আট লক্ষ টাকার পেনশন বন্ধ করে দেয়। ইংরেজরা হিন্দু ও মুসলমান জায়গীরদার ও ভূমির মালিকদের সম্পত্তি জোর করে কেড়ে নিচ্ছে, বনেদী বংশগুলির মান সম্মান মাটিতে লুটাচ্ছে। অর্থ সম্পদ সবই চলে যাচ্ছে ইংরেজদের হাতে। হিন্দুস্থানের হিন্দু- মুসলমান সবার ধর্মই বিপন্ন। তখনো তৈমুর বংশের শিখা, আকবর- শাজাহানের উত্তরাধিকারী বাহাদুর শাহ বেঁচে আছেন মৌলভী আহমদ উল্লাহ প্রচার করছেন বিদ্রোহের বানী। এক সেনা ছাউনি থেকে অন্য সেনাছাউনিতে কারা যেন হাতে বেলা রুটি চালাচালি করতে লাগল। যে একটা রুটি পাবে সে আরও পাঁচটা রুটি বনিয়ে অন্যদের কাছে পৌঁছে দিবে। কোন চিঠি নেই, রুটিই যেন আবেদন পত্র।

পরের ঘটনা ঘটল মিরাটে। ব্যারাকপুরের মঙ্গলপান্ডের বিদ্রোহের পর ইংরেজ কর্তৃপক্ষ মনে করেছিল, চর্বি মাখানো খোলস সমেত টোটার ব্যাপারে বুঝি শুধু হিন্দু সিপাহীরাই ক্ষুব্ধ । মুসলমান সিপাহীরা তো তখন মঙ্গল পান্ডেকে সমর্থন করেনি। কোন কোন সেনানায়ক প্রস্তাব দিলেন এনফিল্ড রাইফেলের ঐ নতুন কার্তুজ বাতিল করা হোক কিন্তু উর্ধতন কর্মকর্তা সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন। মিরাটে তৃতীয় লাইট ক্যাভারলি খুব বিশ্বস্ত বাহিনী, তাদের মধ্যে থেকে বেছে বেছে নব্বইজন দক্ষ সিপাহীকে আলাদা করে কর্নেল স্মীথ বোঝালেন যে কার্তুজের খোলসে চর্বি মেশানোর প্রশ্নই উঠেনা। এমনকি ঐ কার্তুজ ব্যাবহার করার জন্য মুখে দেবারও দরকার নাই, হাত দিয়ে ছিঁড়ে নিলেই হবে এবং এই নব্বইজন সিপাহী সেটা দেখাবে।

A scene from the 1857 Indian Rebellion (Bengal Army), a contemporary English engraving by Granger

কার্তুজগুলি আনা হলো কিন্তু পঁচাশিজন সিপাহিই হাত গুটিয়ে রইল। তারা ঘৃনার সাথে জানালো ঐ অপবিত্র কার্তুজ তারা ছোঁবেনা, এব্যাপারে যেন তাদের অনুরোধ না করা হয়। পরদিন কোর্ট মার্শাল হলো সেই পঁচাশিজন সিপাহীর। যেহেতু তারা ব্রিটিশ রাজের হুকুম মানেনি তাই তারা অপরাধী। বেশিরভাগ সিপাহীকে পাঠানো হবে আন্দামানে যাবজ্জীবন দীপান্তরে, বাকি কয়েকজনের দশ বছর সশ্রম কারাদন্ড। তারা একজনও দয়াভিক্ষা চায়নি, তাদের উর্দি আর জুতো খুলে ফেলতে বলা হলো। প্রচন্ড রৌদ্রে তাদের প্রায় নগ্ন করে পায়ে শেকল পরানো হলো। তখন একজন সিপাহী তার জুতো বিচারকদের দিকে ছুঁড়ে বলল, ফিরিঙ্গি রাজ জাহান্নামে যাক, তার সাথে গলা মেলালো অন্য সিপাহীরা। তাদেরকে মিরাট ক্যান্টনমেন্টে খুব কড়া পাহারায় রাখা হলো। চারিদিক চুপচাপ হয়ে গেল, ইংরেজ সেনা নায়কেরা তাদের উর্দি খুলে আরাম করে বসে সময়টা উপভোগ করতে লাগলো। কিন্তু অন্ধকার নামার সাথে সাথে ছাউনিগুলিতে জ্বলে উঠলো আগুন। পঁচাশিজন সিপাহীকে মুক্ত করা হলো, আর তারা গুলি চালাতে লাগলো ইংরেজদের দিকে। সিপাহীদের সামনে ইংরেজরা দাঁড়াতেই পারলোনা, একদিনেই মিরাট ইংরেজমুক্ত হয়ে গেল। পুরা মিরাট শহর সিপাহীদের দখলে চলে এলো। সিপাহীরা সিদ্ধান্ত নিল এখন থেকে দিল্লী হবে স্বাধীন ভারতের রাজধানী। কাজেই চলো দিল্লী।

Fighting during the Siege of Lucknow Photograph Source Public Domain

দিল্লীর লাল কেল্লায় বৃদ্ধ বাহাদুর শাহ্ এখনো দরবার বসান। তাঁর বয়স এখন বিরাশি, অতি দুর্বল, হ্রসকায় এক পুরুষ, চোখে অহংকারের জ্যোতিটুকুও নেই। সাম্রাজ্য নাই তবু তিনি এখনো সম্রাট। শুধু লালাকেল্লার ভেতরকার ছোট নগরীটিই তাঁর অধিকারে, বাইরের দিল্লী শহরটির পরিচালনার ভার পর্যন্ত ইংরেজদের হাতে। তিনি প্রতিদিন লাঠি ঠুকঠুক করে দরবারে আসেন, এসে বসেন ধূলি- মলিন ময়ূর সিংহাসনে। বেশিক্ষণ সোজা হয়ে বসার ক্ষমতা নাই তাই একটি তাকিয়ায় হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে থাকেন, হাতে থাকে আলবোলার নল।

রাজত্ব নেই, প্রজারা এসে তাঁর কাছে নানারকম শোনায়। নারীহরন, জমিদখল, ইংরেজদের অত্যাচারের কাহিনী।এসব শুনতে ভালবাসেন সম্রাট। তিনি মাথা নাড়েন, এবং তাঁরই মতো ক্ষমতাহীন সেনাপতি, আমির বা মুন্সীদের উদ্দেশ্যে হুকুম দেন, এসব অন্যায়ের প্রতিবিধান করান জন্য। তারাও দীর্ঘ সালাম দিয়ে বলে, জো হুকুম জাঁহাপনা। এই সভায় সবাই প্রায় বৃদ্ধ। সম্রাট প্রায়ই তাদের খেতাব দেন কিংবা ইনাম দেন কল্পিত কোন জায়গীর।তারাও মাথা ঝুঁকিয়ে সব গ্রহন করেন।

সম্রাট কখনো কবিতা বলেন, তিনি কবি এবং গীত রচয়িতা। তখন তিনি সম্রাট নন, শুধু জাফর। তিনি একটি কবিতার পদ বললেই তাঁর সভাসদ তারিফ করে বলে ওঠে, বাহবা, বাহবা, বহত খুব। বাহাদুর শাহ্ শুধু নিজে কবি নন, তিনি কবিদের পৃষ্ঠপোষক। রাজা নেই তবু রাজকবি আছে। প্রসিদ্ধ কবি জৌক বাহাদুর শাহের গুরু এবং রাজকবি। মির্জা গালিবকেও তিনি মাসোহারা দিয়ে রাজসভায় রেখেছেন এবং মুঘল সাম্রাজ্যের গৌরবময় ইতিহাস লেখাচ্ছেন। শুধু প্রজাদের অভিযোগ আর কাব্য আলোচনাই নয়, মঙ্গলপান্ডে নামের এক সিপাহীর ইংরেজদের বিরুদ্ধে গুলিবর্ষনের কথাও উঠে আসে। একদিন তিনি আপন মনে এক বয়েৎ আউড়ালেন, রুশিদের দেশের জার কিংবা বড় বড় সুলতানরা যা পারেনি, চর্বিমাখা কার্তুজ বুঝি তাই করে দিল। পারিষদরা বিস্মিত, একি কথা বলছেন সম্রাট? তাহলে এখনো কি তাঁর নির্জীব শরিরের মধ্যে কোন উচ্চাকাংখা সুপ্ত আছে?

সম্রাটের পুত্ররা এবং আত্মীয়রা প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে অনেক রাত পর্যন্ত নানারকম বল্গাহীন নৃত্য- গীত- লাস্যে সময় কাটান, উঠেন অনেক বেলা করে। তাই সকালের দিকে লালকেল্লা মোটামুটি স্তব্ধ থাকে। একদিন দেখা গেল দুর থেকে ধুলো উড়িয়ে ছুটে আসছে এক ঘোড়সওয়ার বাহিনী, দেখতে দেখতে তারা হুড়মুড় করে ঢুকে পড়লো দিল্লীর পূর্ব দিকের রাস্তা দিয়ে। এরাই মীরাটের তৃতীয় লাইট ক্যাভালরি । সিপাহিরা মুসলমান দেখে দিল্লীর নাগরিকরাই লালকেল্লার সিংহদ্বার খুলে দিল। বিদ্রোহীরা সরাসরি ঘোড়া ছুটিয়ে চলে এলো সম্রাটের আবাসের সামনে। বাহাদুর শাহ্ লাঠি ভর দিয়ে চাতালে এসে দাঁড়ালেন। তাঁকে দেখেই সিপাহিরা জয়ধ্বনি দিয়ে বলে উঠলো হিন্দুস্তানের বাদশা বাহাদুর শাহ্, আজ থেকে হিন্দুস্তানে আবার আজাদি এসে গেছে।

“The Sepoy revolt at Meerut,” from the Illustrated London News, 1857

সিপাহিরা ঘোড়া থেকে নেমে আনন্দে নাচা শুরু করলো। লালকেল্লার এতটা অন্দরমহলে তারা কখনো আসেনি, সম্রাটকেও এতটা কাছ থেকে কখনো দেখেনি। সম্রাট বাহাদুর শাহ্ যে এত বৃদ্ধ, এত দুর্বল সেটা তাদের ধারনা ছিলনা। একজন কৌতুক করে চেঁচিয়ে বললো, বুঢ়া জাঁহাপনা আপ ডরিয়ে মাৎ, আপকো হামলোগ ফিন সারে হিন্দুস্তানকো বাদশা বনা দেঙ্গে। সম্রাট তাদের চুপ করতে বললেন কিন্তু সেটা তারা শুনলোনা। সিপাহিদের কন্ঠস্বর আরো তুমুল হলো। তারা এখনি সম্রাটকে তাদের মাঝে পেতে চায়। তারা চায়, সম্রাট তাদের হয়ে লড়াইয়ের ফরমান জারি করুন। সম্রাটের দেহরক্ষী দলও তাদের সাথে যোগ দিয়েছে, দুরে দেখা গেল আরো দলে দলে বিদ্রোহি অশ্বারহী বাহিনী ঢুকছে করছে নগরে।

শুরু হলো ধ্বংসলীলা। শুধু ইংরেজ নয়, খ্রীষ্টান ধর্মের যে কোন মানুষকে হত্যা করতে লাগলো সিপাহিরা। চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে দিল্লী চলে এলো বিদ্রোহীদের দখলে । বাহাদুর শাহ্ জাফর দেখলেন, তিনি সত্যি সত্যি সম্রাট হয়ে গেছেন আর তাঁর অধীনে আছে একটি সেনাবাহিনী। প্রতিদিন বিভিন্ন জায়গা থেকে আরো সৈন্য আসছে । আনন্দ ও উৎসাহিত হয়ে তিনি আবার কবিতা রচনা করতে লাগলেন।

অবিলম্বে এই খবর পৌঁছালো কলকাতায় গভর্নর জেনারেল লর্ড ক্যানিংয়ের কাছে, তিনি একজন ঠান্ডা মাথার অভিজ্ঞ প্রশাসক। তাঁর আগের গভর্নর জেনারেল লর্ড ডালহৌসি অনেকগুলি যুদ্ধ- বিগ্রহ বাধিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন, তিনি চান দেশের শাষন ব্যাবস্থা আবার সুশৃঙ্খল ও সুদৃঢ় করতে। দিল্লী দখলের গুরুত্ব অপরিসীম। দিল্লীতে যদি সিপাহিদের একটি বিরাট বাহিনী সমবেত হয়, তাহলে উত্তর ভারতে ব্রিটিশ শক্তির টিকে থাকাই অসম্ভব ব্যাপার। যেখানে এখনো বিদ্রোহের ধোঁয়া যায়নি, সেইসব ক্যান্টনমেন্টে এই খবর পৌঁছে যাবে। তিনি প্রতি আক্রমন না করে এক বিবৃতি দিলেন যে, বৃটিশ সরকার কিংবা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কখনোই ভারতবাসীদের ধর্মীয় অধিকারে হস্তক্ষেপ করতে চান না। সুতরাং সিপাহিদের জাতিভ্রষ্ট হবার কোন সম্ভাবনা নাই এবং তাদের উত্তেজিত হবার কোন কারন নাই।

এর ফল হলো বিপরীত। দিল্লীতে বাহাদুর শাহের পাশে সেনা নায়করা আনন্দে লাফিয়ে উঠলো। তারা বললো, ফিরিঙ্গীরা ভয় পেয়েছে। তারা এখন সিপাহিদের তোষামোদ করতে চায়।

The Indian Revolt of 1857

লালকেল্লার দেওয়ান-ই-খাস এর দেওয়ালে ফারসী ভাষায় উৎকীর্ন ছিল, ‘’ স্বর্গ যদি কোথাও থাকে, তবে তা এখানেই, তা এখানেই’’। সেপ্টেম্বরের বিশ তারিখে সেই স্বর্গে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়লো বিজয়ী ইংরেজ সেনানী। বিকটভাবে জুতোয় শব্দ তুলে, হাতে অস্ত্র নিয়ে ছোটাছুটি করতে লাগলো। লালকেল্লা জনশূন্য । কয়েকমাসের বাদশাহ বাহাদুর শাহ্ সপরিবারে পলাতক। সৈন্যরা কাউকে খুঁজে না পেয়ে বন্দুকের বাট দিয়ে ভাঙ্গতে লাগলো দেওয়ান-ই-খাসের স্বর্গের দেওয়ালসজ্জা। দুর্লভ পাথরের কারুকাজ করা শিল্প টুকরা টুকরা হয়ে মেঝেতে পড়তে লাগলো। সেনাপতি এগিয়ে এসে কোনমতে তাদের শান্ত করলেন।প্রাঙ্গনে উড়িয়ে দেয়া হলো ইউনিয়ন জ্যাক, যুদ্ধে বিজয়ের জন্য অনুষ্ঠিত হলো থ্যাংকস গিভিং প্রার্থনা।

সম্রাট তখন সদলবলে লুকিয়ে আছেন, লালকেল্লা থেকে চার মাইল দুরে হুমায়ুনের সমাধি ভবনে। সঙ্গে তখনও হাজার খানেক সিপাহি। বিভিন্নজন তাঁকে বিভিন্নরকম পরামর্শ দিচ্ছে। কিন্তু বৃদ্ধ সম্রাট তাদের পরামর্শ মতো কিছুই করলেন না, বিহ্বল ও জড়ের মতো তিনি চুপচাপ বসে রইলেন তাঁর পূর্বপুরুষ হুমায়ুনের সুবিশাল সমাধীভবনে। একচোখ কানা ইংরেজদের বিশ্বস্ত গুপ্তচর রজব আলি সম্রাটের লুকিয়ে থাকার জায়গার খবর ইংরেজদের জানিয়ে দিলে ইংরেজবীহিনীর সবচেয়ে দু:সাহসী এবং হঠকারী সেনাপতি হডসন মাত্র পন্চাশজন অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে হুমায়ুনের সমাধীভবনের দিকে রওয়ানা হলেন। সরকারের নির্দেশ ছিল বাহাদুর শাহ্ কে না মেরে বন্দি করতে হবে, যদিও তার ইচ্ছা করছিল সম্রাটকে মেরে ফেলতে কিন্তু উপরের নির্দেশে হডসন সন্ধি প্রস্তাব পাঠালেন সম্রাটের কাছে। প্রখর রৌদ্রে তিন ঘন্টা অপেক্ষা করার পরও কোন উত্তর এলোনা।

একসময় দেখা গেল, মসলিনের পর্দা ঘেরা একটি পাল্কি খুব ধীরে ধীরে বেরিয়ে এলো। তার মধ্যে শুয়ে আছেন এক ক্ষুদ্রকায় বৃদ্ধ যার গোঁফ, দাঁড়ি এবং চুল শ্বেত- শুভ্র। ঠোঁটে আলবোলার নল, সম্রাট সম্পূর্ন বাক্যহীন। সাময়িক ভাবে তাঁকে বন্দী করে রাখা হলো লালকেল্লার একটি ছোট্ট ঘরে। তাঁর খাবারের জন্য বরাদ্দ হলো দৈনিক দু’আনা। রাজকুমারদের হুমায়ুনের সমাধী থেকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে আসার পথে তাদের দামি কাপড়- চোপড় খুলিয়ে প্রায় নগ্ন অবস্থায় দাঁড়ানো রাজকুমারদের বুকে বন্দুক ঠেকিয়ে খুন করা হলো, ইংরেজ সেনারা দিল্লীবাসীকে দেখানোর জন্য লাশ ফেলে রাখলো রাস্তায়। এক অতিরিক্ত ইংরেজ তোষামোদকারী দুই রাজকুমারের মাথা কেটে থালায় সাজিয়ে উপহার হিসাবে পাঠালো বাহাদুর শাহ্ এর কাছে।

রুল অব ল এখন মুলতবি, খ্রীষ্টান হত্যার বদলা নিতে ইংরেজ সৈন্যদের আর কোন বাধা রইলোনা। সব বিদ্রোহ নগরী ইংরেজরা উদ্ধার করলো আর হাজার হাজার মানুষকে কামানের সামনে দাঁড় করিয়ে হত্যা করা হলো। সিপাহি বিপ্লবের শেষে ১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ শাসকেরা বাহাদুর শাহ্ কে ক্ষমতাচ্যুত করে ও রেঙ্গুনে নির্বাসনে পাঠায়, এবং সেখানেই তার মৃত্যু হয়।

An 1858 photograph by Felice Beato of a mosque in Meerut where some of the rebel soldiers may have prayed

বিদ্রোহ দমনের পর ইংরেজ সমাজ এবং সংবাদ পত্র ভারতীয়দের কুকুর, বাঁদর, নরকের কিট এবং অনেক কদর্য ভাষায় আক্রমন করলো তাদের খবরের কাগজে। কেউ কেউ সরকারকে পরামর্শ দিলো —সেনাবাহিনী থেকে ভারতীয়দের বের করে দিতে। আফ্রিকা থেকে ভাড়াটে সৈন্য এনে কাজ চালাতে, ভারতের সব হিন্দু- মুসলমানদের ধরে জোর করে খ্রীষ্টান বানাতে। গভর্নর জেনারেল লর্ড ক্যানিং এর যুক্তিসংগত আইন- কানুনের বাতিক আছে, তাই তিনি পুরা ভারতবর্ষের উপর এই বিশৃঙ্খলা, প্রতিশোধের পাগলামি এবং অকারন নরহত্যাতে তিনি সায় দিতে পারলেন না, তিনি এগুলি বন্ধের আহ্বান জানালেন। তিনি কড়া হাতে রাশ টানার চেষ্টা করলেন এবং ইংরেজদের বললেন মাথা ঠান্ডা রাখতে কিন্তু ইংরেজরা তাঁকে সম্পূর্ন অবজ্ঞা তো করলোই বিদ্রুপ করতেও ছাড়লোনা । ভারত জুড়ে হত্যাকাণ্ড চলতে লাগলো যথেচ্ছভাবে।

সিপাহি বিদ্রোহ দমন করার পর ইংরেজদের এই প্রতিক্রিয়া দেখে কলকাতার বাবু ও ধনী সমাজ হতভম্ব হয়ে গেল।তারা তো সিপাহি বিদ্রোহ সমর্থন করেনি, বাংলার বিভিন্ন জায়গায় সিপাহিরা ফুঁসে উঠলেও ধনী ও জমিদারশ্রেনী তাদের কোনরকম সাহায্য করেনি। ইংরেজের তল্পীবাহক বলে উত্তর ভারতে সিপাহিরা বাঙ্গালীদেরকে খ্রীষ্টানদের মতই মারধোর করেছে, ব্রাহ্মধর্মের প্রতিষ্ঠাতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর পর্যন্ত সিপাহিদের ভয়ে সিমলা পাহাড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন। তাহলে বাঙালীদের উপর এত রাগ কেন ইংরেজদের? ইংরেজের রাজত্বকালে বাঙালীরা চাকরি করছে, শিক্ষিত বুদ্ধিজীবিদের আর খাদ্য- বস্ত্রের সমস্যা নাই। তাহলে বাঙালীরা ইংরেজের বদলে সিপাহী তন্ত্র চাইবে কেন? চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কারনে জমিদার শ্রেনী আরও ধনী হয়েছে, ইংরেজরা আপামর জনসাধারনকে তাদের পাশাপাশি জমিদারকেও শোষনের সুযোগ দেয়া হয়েছে, তাহলে ইংরেজ ও দেশি জমিদার তো একপক্ষেই থাকবে! সমস্ত ভারতীয়দের প্রতি যখন ইংরেজরা খড়্গহস্ত তখন বাঙালীবাবু ও ধনীরা বিস্মিত, ম্রিয়মান ও প্রতিকারের তা চেষ্টা করতে লাগলো।

Interior of the Secundra Bagh after Campbell’s attack in November 1857 Public Domain

রাজা- মহারাজার দল দিল্লী পতনের পর নবোদ্যমে অভিনন্দন পাঠাতে লাগলো সরকার বাহাদুর সমীপে। বর্ধমানের মহারাজার উদ্দ্যোগে সভা ডেকে ইংরেজদের জয়ে উল্লাস প্রকাশ করা হলো এবং পত্রের মাধ্যমে তা জানানো হলো লর্ড ক্যানিংকে, সেখানে স্বাক্ষর করলেন বর্ধমানের মহারাজা, কলকাতার ধনী শিরোমণি রাজা রাধাকান্ত দেব এবং আরো আড়াই হাজার হোমরা- চোমরা মানুষ। এছাড়াও কৃষ্ণনগরের মহারাজা শ্রীশচন্দ্র, উত্তরপাড়ার জমিদার জয়কৃষ্ণ প্রতেকে ইংরেজদের তোয়াজ করা শুরু করলো। হিন্দুদের এই অবস্থা দেখে মুসলমানরাও আবেদনপত্র দাখিল করে জানালো যে, সিপাহি বিদ্রোহে তাদের কোন সমর্থন ছিলনা। তারাও ইংরেজ- রাজ ভক্ত প্রজা, ইংরেজ রাজত্ব তাদের কাছেও সুখের । ঢাকার নবাব জানালেন তিনি হাতি দিয়ে ইংরেজদের সাহায্য করেছেন, সেখানকার অন্যান্য জমিদার ও মৌলভীরা সবসময় রয়েছে ইংরেজদের পক্ষে। সিপাহি বিদ্রোহ দমনের পর এভাবেই চলতে থাকলো ক্ষমতাসীন ইংরেজদেরকে তোষামুদি করা।

সম্রাট বাবর মধ্যযুগে তাঁর বাবরনামায় লিখেছেন, ‘তিনি শুনেছেন যে ক্ষমতাসীন যে কোন মানুষের প্রতি বাঙ্গালিরা অনুগত থাকেন’। কথাটা যে কতবড় সত্য এর থেকে তা প্রমান হয়। তারপরও সিপাহি বিদ্রোহ এক হিসাবে ব্যার্থ হলোনা। কারন সিপাহিরা যুদ্ধে হেরে গেল বটে কিন্তু এটা উপলক্ষে অনেক মানুষের মনে জেগে উঠলো দেশাত্বোধ।

#তথ্যসূত্র #সেই_সময় #লেখক_সুনীল_গঙ্গোপাধ্যায় #উইকিপিডিয়া #ছবি_ ইন্টারনেট