প্রাচীন মেসোপোটেমিয়া সভ্যতার অন্যতম বড় একটি সাম্রাজ্য ছিল এসিরীয় সভ্যতা। ২১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে একটি নগর রাষ্ট্র হিসেবে পাদপ্রদীপের আলোয় এসে ১৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে একটি পুরোদমে সাম্রাজ্যে রূপান্তর হওয়া এসিরীয়ানরা ইতিহাসে স্মরণীয় ছিল অন্য এক রূপে। কঠোর সামরিকবাদ আর আগ্রাসী আচরণ এই সভ্যতাকে সমীহ জাগানো এক শক্তিতে রূপান্তর করেছিল। স্বৈরাচারী শাসনের সকল বৈশিষ্ট্যই ছিল এসিরীয় সাম্রাজ্যে। ফলে তাদের সামরিকবাদও বেড়ে উঠেছিল আপন গতিতে। দ্বিতীয় সারগন এসিরীয় সামরিক শক্তিকে সবচেয়ে সুপ্রতিষ্ঠিত করে গিয়েছিলেন। একজন সামান্য সামরিক কর্মকর্তা থেকে তিনি বনে গিয়েছিলেন মহান এসিরীয় সাম্রাজ্যের সর্বময় কর্তা। মেসোপোটেমিয়া অঞ্চল, সিরিয়া, ফিনিশিয়, ইসরায়েল ও মিশরের কিছু এলাকা নিয়ে এসিরীয়রা ভৌগোলিক সীমানার দিক থেকে বড় একটি শক্তিতে পরিণত হয়। আর এই বৃহৎ শক্তিকে টেকসই করার জন্য প্রয়োজন পড়ে একটি সুশৃঙ্খল ও প্রতাপশালী সামরিক কাঠামোর।

এসিরীয় সামরিকবাদ কিভাবে গড়ে উঠেছিল?

প্রাচীন যুগের এসিরীয়রা কৃষিকাজের মাধ্যমে প্রায় নিরীহ জীবনযাপনই করতো। তবে তাদের ভৌগোলিক অবস্থা এমন ছিল যে, ব্যবিলনীয়, কাসাইট, হিট্টাইটদের মতো শক্তির গোষ্ঠী তাদেরকে বেষ্টিত করে রাখতো। বৃহৎ এই শক্তিগুলো থেকে আক্রমণের সম্ভাবনা সবসমই ছিল। আর এই ঝুঁকি থেকে নিজেদের নিরাপত্তার জন্য এসিরীয়রা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সুদৃঢ় করার পরিকল্পনা নেয়। এসিরীয়দের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য মালভূমি ও মরুভূমি অধ্যুষিত হওয়ায় এই অঞ্চলে কৃষিজমির স্বল্পতা ছিল। তাই নিজেদের অর্থনীতি সমৃদ্ধ করতে তারা নিজেদেরকে সাম্রাজ্যবাদী হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা চালায়।

স্ট্যান্ডিং শিল্ড সহ অ্যাসিরিয়ান সৈনিক, ছোট ঢাল সহ সৈনিক, তীরন্দাজ।

এসিরীয়রা যখন নগর রাষ্ট্র ছিল তখন তাদের ওপর ব্যবিলনীয়, হিট্টাইট, হুবিয়ান ইত্যাদি জাতি প্রভূত্ব কায়েম করেছিল। পরাধীন এসিরীয়রা স্বাধীনতার স্বাদ পাওয়ার জন্য বিচ্ছিন্নভাবে সংগ্রাম চালালেও তাদেরকে দমন করা হয়েছে কঠোরভাবে। ব্যবিলনীয় শাসনে এসিরীয়ানরা সবচেয়ে বেশি দমনপীড়নের শিকার হয়েছে। একটি ছোট নগর রাষ্ট্র থেকে একটি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে তাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে দুই হাজার বছর। ধারাবাহিক এই নিষ্পেষণ পুরো জাতির মধ্যে এক সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব জাগিয়ে তুলে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তারা তাদের সামরিক শক্তিকে সমৃদ্ধ করে।

এসিরীয়দের সামরিক শক্তির সমৃদ্ধির পেছনে অস্ত্রশত্রেরও অবদান ছিল। আর অস্ত্রের সমৃদ্ধির পেছনে আশীর্বাদ হয়ে এসেছিল লোহা। এসিরীয়রা হিট্টাইটদের কাছ থেকে লোহার ব্যবহার শিখে। লোহার তৈরি অস্ত্র আর ঘোড়ার ব্যবহার এসিরীয় সামরিক শক্তিকে দ্রুতই শক্তিশালী রূপ দেয়। ঘোড়ার রথ ছিল এসিরীয়দের সবচেয়ে ভয়ংকর সামরিক অস্ত্র। যুদ্ধে ক্ষিপ্রতার কারণে ঘোড়ার রথকে বলা হতো চলমান কোন এক দুর্গ। বিজিত অঞ্চলে এসিরীয়রা প্রথমেই খোঁজ করতো ঘোড়ার। অনেক সময় কর হিসেবেও ঘোড়া আদায় করা হতো।

এসিরীয় সামরিকবাদের পেছনে তাদের ধর্মও অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছিল। দেবতা আসুর ছিলেন এসিরীয় যুদ্ধদেবতা। এসিরীয়দের বিশ্বাস ছিল দেবতা আসুর ও তার পত্নী ইশতার তাদের রাষ্ট্রের নিরাপত্তা দেন। যুদ্ধের দেবতার অনুগত রাষ্ট্রের আচরণ সামরিকবাদ হবে এটা তারা ধরেই নিয়েছিল। তাদের ধর্মে নীতি নৈতিকতার কোন বালাই ছিল না৷ মানুষ উৎসর্গ করা হতো আসুর দেবতার নামে৷ যুদ্ধক্ষেত্রে এসিরীয় সৈন্যরা তাই হিংস্রতা প্রদর্শনে কোন কার্পণ্য করতো না৷

এসিরীয় সামরিকবাদের বৈশিষ্ট্য

এসিরীয় সামরিকবাদের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য ছিল তাদের উন্নত ও টেকসই অস্ত্র সরঞ্জামের ব্যবহার। তারা এমন কিছু অস্ত্র তৈরি করেছিল যা সমকালীন অনেক সভ্যতাই তৈরি করতে পারেনি। লোহার তৈরি তরবারি, শিরস্ত্রাণ, ফলা, বর্শা, ধনুক, বর্ম, দুর্গ বিধ্বংসী অস্ত্র, চাকার উপরে স্থাপিত দুর্গে নিক্ষেপক ছিল তাদের উদ্ভাবন করা নতুন ধরনের সামরিক সরঞ্জাম। তাদের যুদ্ধকৌশল ছিল অনেকটা আত্মরক্ষামূলক। প্রতিরোধ, আত্মরক্ষা ও আক্রমণ এই তিন ফরমেশনে তারা সৈন্য সাজাতো। প্রতিরোধ ও আত্মরক্ষার জন্য ছিল দেয়াল ঘেরা ছোট ছোট নগরী। প্রাচীর বেষ্টিত সেনা ঘাটির দেয়ালে তীর নিক্ষেপের জন্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছিদ্র তৈরি করা হতো। ফলে শত্রুপক্ষ থেকে তীর ভেতরে প্রবেশ করতে না পারলেও ঘাটি থেকে শত্রুপক্ষকে লক্ষ্য করে তীর ছোঁড়া যেত। এসিরীয়রা ভূগর্ভস্থ সূড়ঙ্গ ও দেয়াল বিধ্বংসী যন্ত্র আবিষ্কার করেছিল যা তখনো পর্যন্ত অন্য কোন সভ্যতা উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়নি। রাজা দ্বিতীয় আসুরনাসিরপাল দুর্গের ফটক ভাঙার যন্ত্র ও তার অশ্বারোহী বাহিনী দিয়ে দক্ষিণ আর্মেনিয়া ও মেসোপটেমিয়ার কিছু অঞ্চল জয় করে তার রাজনৈতিক সীমানা ইউফ্রেতিস নদী পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিলেন। নিমরুদে আবিষ্কৃত ৪০০ বর্গফুটের অস্ত্রাগার তাদের উন্নত সামরিক সরঞ্জাম ও কৌশলের প্রমাণ পাওয়া যায়। এসিরীয় সেনাবাহিনী ছিল অনেক সুশৃঙ্খল। হালকা পদাতিক, ভারী পদাতিক, অশ্বারোহী ও রথ বাহিনী এই চার ভাগে বিভক্ত ছিল এসিরীয় সেনাবাহিনী। এর মধ্যে পদাতিক বাহিনীর সৈন্যসংখ্যা বেশি হলেও এসিরীয় অশ্বারোহী বাহিনী ছিল পৃথিবী বিখ্যাত। একদল দক্ষ অশ্বারোহীর কাজ ছিল শত্রুপক্ষের শ্রেণীবদ্ধ ব্যুহ এলোমেলো করে দেয়া। এই চার শ্রেণীর বাইরেও এসিরীয়দের সামরিক প্রকৌশল নামে পৃথক একটি বিভাগ ছিল।  এই বিভাগের অধীনে ছিল আবার দুটি আলাদা দল। একটি ছিল দুর্গের প্রতিরক্ষার জন্য নিয়োজিত। এদেরকে বলা হতো আর্টিলারি কোর। আরেকটি ছিল রিজার্ভ বাহিনী৷ যুদ্ধের সময় অতিরিক্ত সৈন্যের দরকার পড়লে এই বাহিনীর ডাক পড়তো।

টিগলাথ-পিলেসার  এর সৈন্যদের একটি চিত্র

এসিরীয় সামরিকবাদ টিকেছিল ত্রাস ও সন্ত্রাসের ওপর। নিষ্ঠুরতা ছিল এসিরীয় সামরিক বাহিনীর সাধারণ বৈশিষ্ট্য। যেই অঞ্চল তারা দখল করে নিতো সে অঞ্চলের সাধারণ জনগণ ও যুদ্ধবন্দীদের ওপর তারা অবর্ণনীয় নির্যাতন চালাতো এবং তাদেরকে নিজেদের সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভূক্ত করতো। এসিরীয় সৈন্য যখন নতুন অঞ্চল জয় করতো প্রথমে সেই অঞ্চলের আবাসিক এলাকায় অগ্নিসংযোগ করতো। তারপর বৃক্ষ কেটে দিয়ে বিরাণভূমিতে রূপান্তর করা হতো বিজিত অঞ্চলকে। অক্ষম ও বৃদ্ধদের হত্যা করে বাকি জনগোষ্ঠীকে বানানো হতো যুদ্ধবন্দী হিসেবে। যুদ্ধবন্দীদের পাশবিক নির্যাতন করতো এসিরীয় সৈন্যরা। কখনো তাদের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ কর্তন করে জনসমক্ষে প্রদর্শন করা হতো। কখনোবা তাদের হত্যা করে মৃতের মাথার খুলি দিয়ে তৈরি করা হতো পাহাড়। এসিরীয়রা শত্রুপক্ষকে এমন নির্যাতন করে গর্ববোধ করতো। বিভিন্ন সময় উদঘাটিত ফলক ও লিপিতে এর প্রমাণ পাওয়া গেছে। সম্রাট আসুরবানিপালের ফলক থেকে এসব নির্যাতনের সাথে সম্রাটের সরাসরি সম্পৃক্ততার ব্যাপারে জানা গেছে। এসিরীয় রাজা সলেমেনেস নিজে স্বীকার করেছিলেন যে তিনি ১৪,৪০০ জন শত্রুর এক চোখ অন্ধ করে দিয়েছিলেন।

শুধু উন্নত অস্ত্রশস্ত্র আর নিষ্ঠুরতার ওপরই এসিরীয় সামরিকবাদের শ্রেষ্ঠত্ব ছিল না। রসদ আর সেনাদের যাতায়াত সুবিধার জন্য তারা উন্নত যাতায়াত ব্যবস্থার পত্তন ঘটিয়েছিল। দুর্গম পাহাড়ী রাস্তায় রাজা কিভাবে সৈন্যদের নিয়ে যাচ্ছেন এমন বর্ণনার ফলক পাওয়া গেছে। এই যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করে আসিরীয় গোয়েন্দা ব্যবস্থাও গড়ে উঠেছিল। গোয়েন্দারা প্রদেশগুলোতে সহজে ভ্রমণ করে রাজাদের কাছে গোপন খবর জানিয়ে যেত। সংবাদ বাহক হিসেবে ডাকঘর প্রথারও উত্থান ঘটেছিল এসিরীয় সাম্রাজ্যে।

কঠোর সামরিকবাদের প্রভাব কেমন ছিল সাম্রাজ্যে?

এসিরীয় সামরিক আচরণ পুরো রাষ্ট্রের সাথে রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে গিয়েছিল। সামাজিক ও প্রশাসনিক খাতে এর প্রভাব ছিল সুস্পষ্ট। কঠোর সামরিকবাদের ফলে সামরিক অফিসাররা ছিল স্বেচ্ছাচারী৷ অফিসার এমনকি সাধারণ সৈনিকও সমাজে উঁচু হিসেবে গণ্য হতো। সাধারণ সৈনিক ও অফিসাররা রাষ্ট্রের জনগণের ভূমি দখল করে নিতো। এর প্রতিবাদের জো ছিল না। অনেক সময় দেখা যেত মানুষ ভূমিহীন হয়ে পড়েছে। কিছু উচ্চাভিলাষী সামরিক অফিসাররা ক্ষমতালিপ্সুও হয়ে পড়েছিলেন। দ্বিতীয় সারগন এই পন্থায়ই ক্ষমতালাভ করেছিলেন। এছাড়া অনেক নতুন অঞ্চল বিজয়ের ফলে এসিরীয় সাম্রাজ্যে ভূমিদাস ও ক্রীতদাস আশংকাজনক হারে বেড়ে গিয়েছিল। প্রচণ্ড সামরিক প্রভাব এসিরিয় বেসামরিক প্রশাসনকে প্রস্ফুটিত হওয়ার সুযোগ দেয়নি। আধুনিক যুগের মতো সামরিক কর্মকর্তারা বেসামরিক সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করতো। অনেক সময় দেখা যেত সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারা দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ছে। অর্থনীতির ক্ষেত্রে কৃষি ও ব্যবসায় নিরুৎসাহ এসিরীয় সাম্রাজ্যকে লুটের অর্থনীতিতে পরিণত করেছিল। সাম্রাজ্যের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশও এই চরম সামরিকবাদ ব্যাহত করেছে।

অ্যাসিরিয়ান অশ্বারোহী বাহিনী

সামরিক শক্তিতে রাষ্ট্র বা সাম্রাজ্য অনন্তকাল টিকে থাকবে এমন আশা কেউই করতে পারে না। এসিরীয় সাম্রাজ্যের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছিল। নিষ্ঠুরতা, সাধারণ জনগণের বিদ্রোহ, বিজিত অঞ্চলের বিদ্রোহ আর ষড়যন্ত্র-প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে এসিরীয় সাম্রাজ্য বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। রাজকোষে দেখা দেয় অর্থের সংকট। নতুন কোন যুদ্ধ পরিচালনার মত অর্থেরও যোগান দেয়া কঠিন হয়ে পড়ে। আর এই সুযোগে বহিঃশক্তির আক্রমণ নিঃশেষ করে দেয় মহাপরাক্রমশালী এসিরীয় সাম্রাজ্যকে। 

 
তথ্যসূত্র 
 
সভ্যতার ইতিহাস, প্রাচীন ও মধ্যযুগ- ড  আবু মোঃ দেলোয়ার হোসেন, মোঃ আব্দুল কুদ্দুস শিকদার