এক বাদশাহের কথা
সূদীপ জোয়ারদার
ভয়ে বুক কাঁপছে মৌলবির। বাদশাহের দরবারে তলব। কে যানে হয়তো প্রাণদণ্ডই দিয়ে বসবেন। কিন্তু সত্যিই কি অপরাধী তিনি? হতে পারে তাঁর ছাত্র বাদশাহের ছেলে।
তিনি তো গুরুজন l একজন ছাত্রের কাছে বাবার মত।এটুকু পাওনাই তো তার।.বাদশাহের সনদলিপি। শুরু হয় ভূমিকম্প। চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেদিনের দৃশ্য। পায়ে জল ঢেলে দিচ্ছে ছাত্র, বাদশাহ-তনয় আর তিনি ধীরে ধীরে পরিষ্কার করছেন পা। হঠাৎ চোখ তুলে দেখেন স্বয়ং বাদশাহ দূর থেকে এদিকে তাকিয়ে রয়েছেন। বাদশাহের সেই নীরব দৃষ্টি। আর ভাবতে পারেন না মৌলবি। ভয়ে আশঙ্কায় জড়োসড় হয়ে ধীরে ধীরে হাজির হন বাদশাহের দরবারে। বাদশাহ মৌলবিকে কাছে ডাকেন। শুধোল, আমার পুত্র কি আপনার কাছে কিছু শিখেছে ? মৌলবি প্রশ্নের ধরন বুঝতে না পেরে নিরুত্তর। বাদশা একটু চুপ করে থেকে বলেন, আমি তো দেখলাম পুত্র আপনার কাছে শিখেছে শুধু বেয়াদবি আর গুরুজনে অবহেলা। তা না হলে আপনার পায়ে জল ঢালার সময় সে নিজে কেন পা পরিষ্কার করে মুছে দিল না? মৌলবিতো অবাক । ভেবেছিলেন গর্দান যাবে অথচ শুনছেন কিনা উল্টো অভিযোগ।
মৌলবির মত অন্য আর একদিন অবাক হয়েছিলেন সমস্ত রাজধানীবাসীই। এতদিন পর্যন্ত বাদশাহকে ঝরকা দর্শণ না করে রাজধানীবাসীদের অন্নগ্রহণ করা চলত না। এটা একেবারে সংস্কারের মত দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। ১০৭৯ হিজরীর একদিন বাদশাহ ঘোষণা করলেন এই ব্যক্তিপূজার আর দরকার নেই। রাজধানীবাসীদের বুঝি পাওনা ছিল আরও কিছু। তাই এই আদেশ নিয়েই ক্ষান্ত হলেন না তিনি। পরের দু’বছর দুটি ফরমান জারি করে তিনি বললেন-এখন থেকে বাদশাহকে কুর্নিশের প্রচলিত প্রথা বন্ধ। কাউকে মাথা নত করে অথবা হাত তুলে অভিবাদন জানানোর দরকার নেই। শুধু মুখে প্রচলিত সম্ভাষণ জানালেই হবে।
বাদশা ছিলেন গোঁড়া ধার্মিক। অন্য ধর্মের লোককে তা বলে তিনি কম ভালোবাসতেন না। হিন্দু সন্ন্যাসী হিন্দু সৈনিকদের তিনি দান করলেন অনেক ভূমি ও সম্পত্তি। মেবাবের রাজা রাজসিংহকে প্রেরিত একটি নিশান-এ বাদশাহ লিখলেন- যে রাজা অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি অসহিষ্ণুতা দেখায় সে ঈশ্বরের বিরুদ্ধেই অপরাধী। রক্ষণাবেক্ষণের জন্য অনেক মন্দির বাদশাহের কাছ থেকে পেল অর্থসাহায্য। উজ্জায়িনীর মহাকালেশ্বর মন্দির, চিরকুটের বালাজি মন্দির, গৌহাটির উমানন্দ মন্দির, শত্রুঞ্জয়ীর জৈন মন্দির এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। শিক্ষার প্রতি বাদশাহের ছিল অসীম অনুরাগ। আহমেদাবাদে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণের জন্য বাদশাহ দান করলেন এক লক্ষ চল্লিশ হাজার টাকা। গুজরাটে তৈরি করলেন অসংখ্য বিদ্যালয়। শিক্ষাবিস্তারের পাশেপাশে চলতে লাগল সমাজসংস্কার। যে সতীদাহ প্রথা নিবারণ এর জন্য লর্ড বেন্টিক স্মরণীয় হয়ে আছেন সেই সতীদাহ প্রথা নিবারণ এর জন্য তিনি সচেষ্ট হন বেন্টিক এর অনেক আগেই। কাশ্মীরে এক বিধবাকে স্বামীর চিতায় জীবন্ত দগ্ধ করার খবর শুনে ১৬৬৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি ঘোষণা করলেন এখন থেকে সাম্রাজ্যের আর কোথাও কোনও মহিলাকে জীবন্ত দগ্ধ হতে দেয়া যাবেনা।
ন্যায় বিচারের স্বার্থে চুরির অপরাধে জড়িত ব্যক্তিদের সাক্ষ্যপ্রমাণাদি ছাড়া ধরা যাবেনা, এমন যুগান্তকারী ঘোষণা এই বাদশাহের পক্ষেই বুঝি সম্ভব ছিল। লঘু অপরাধে গুরুদন্ড যে সময়ের প্রচলিত প্রথা সে সময় বাদশা বললেন-সাক্ষ্যপ্রমাণাদি সহ কাউকে যদি ধরাও যায় তবু তাকে শাস্তি দেওয়া যাবে না। কয়েদ করে রাখা হবে, যতক্ষণ না সে অনুতপ্ত হয়।
নিরহঙ্কার, উদার, ন্যায়বিচারের প্রতিমূর্তি কে এই বাদশাহ? না, তাঁকে আমরা চিনি না। কারণ ইতিহাস তাঁকে অন্যরূপে দেখিয়েছে। আধুনিক ইতিহাসকারদের মতে, নিরাপরাধের দণ্ড যাঁরা পেয়েছেন তাঁদের মধ্যে এই বাদশাহ অন্যতম। বাদশাহ এর নাম-ঔরঙ্গজেব।
খালি চোখেও দেখা যায় এমন সূক্ষ্ম বস্তু হল সাবানের বুদবুদের দেওয়াল, যা আমাদের চুলের থেকেও পাঁচহাজার গুন বেশি পাতলা।