রক্তাভ আকাশ যেন কার্থেজের উঁচু বেদিগুলোর ওপর রক্ত ঝরাচ্ছিল। সেই আকাশের নিচে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে এক শোভাযাত্রা ধীর, শোকাভিভূত। বাতাস ভারী ধূপের গন্ধে, আর তার সঙ্গে মিশে আছে মায়ের বুক ফাটা কান্না। কিছু মা ঠিক তখনই তাদের সন্তানকে তুলে দিয়েছে বাল হাম্মনের পুরোহিতদের হাতে। পাথরের বিশাল বেদির উপর এক শিশু প্রায় নবজাতকে রাখা হলো দেবমূর্তির পিতলের তৈরি এক হাতের উপর। দেবতারা যেন কিছুই দেখে না, কিছুই বোঝে না। নিচের থেকে উঠে আসছে আগুনের শিখা। ভয়ংকর লেলিহান শিখা মুহূর্তে গ্রাস করে নিচ্ছে সেই কোমল প্রাণটিকে। জনতা তখন উন্মত্ত প্রার্থনায় বিলিয়ে দিয়েছে নিজেকে।
কার্থেজবাসীর কাছে এটি কোন নিষ্ঠুরতা না। এ ছিল এক চুক্তি, দেবতার সঙ্গে, ভাগ্যের সঙ্গে।
কার্থেজের মানুষ ছিল সাগরের সন্তান ফিনিশীয়দের বংশধর। উত্তর আফ্রিকার অনুর্বর মাটিতে তারা গড়ে তুলেছিল এক অদম্য বাণিজ্য সাম্রাজ্য। তাদের জাহাজ ভূমধ্যসাগরের বুক চিরে নিয়ে যেত ধন সম্পদ। সাথে যেত তাদের গর্বিত ইতিহাস। আইবেরিয়া থেকে সিসিলি পর্যন্ত। কিন্তু এই সাফল্যের বুনটে জড়ানো ছিল এক অন্ধকার সুতোর মতো অতল রহস্য। ইতিহাসবিদ ডায়োডোরাস সিকুলাস লিখেছিলেন, কার্থেজবাসীরা দেবতাদের তুষ্ট করতে শিশু বলি দিতো। নির্দোষ প্রাণের বিনিময়ে তারা কামনা করতো তাদের সমৃদ্ধি। আধুনিক প্রত্নতত্ত্ববিদরা বর্তমানে খুঁজে পেয়েছেন এই প্রাচীন কাহিনির প্রতিধ্বনি।“টোফেট” নামে শিশুদের এক কবরস্থানে, ছোট্ট হাড় আর উৎসর্গের ফলক একসঙ্গে খুঁজে পাওয়া গেছে।

হিব্রুদের শিশু বলি — দেবতা মোলক-এর উদ্দেশ্যে © historicmysteries.com
দেবতা বাল হাম্মন ও তানিতের নামে চলছিল এইসব বলিদান। নিশ্চিতভাবে বলা যায় রোমান লেখক সিসেরো ও লিভির মতোরা, কার্থেজকে শত্রু হিসেবে দেখত। তারাই এই আচারগুলোকে বর্বরতার নিদর্শন হিসাবে আখ্যা দেন। তাদের কলমে কার্থেজ ছিল অন্ধকার, আর রোম ছিল আলোর প্রতীক। খ্রিষ্টপূর্ব ১৪৬ সালে তারা কার্থেজকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়, শহর জ্বালিয়ে ছাই করে, এমনকি ক্ষেতেও নুন ছিটিয়ে দেয় যাতে কিছুই আর জন্ম না নেয়। ভয়ংকর হত্যা চালানো হয় তাদের উপরে। কার্থেজ, এককালে ভূমধ্যসাগরের মুকুটমণি, ইতিহাস থেকে মুছে গেল। কিন্তু প্রশ্নটা থেকেই যায়—
সত্যিই কি ঘটেছিল এমন ঘটনা? নাকি এটা কেবল রোমের সুচতুর প্রচারণা, যাতে কার্থেজকে ধ্বংস করাটা আমাদের চোখে ন্যায্য মনে হয়? সম্ভবত সত্যটা কোথাও মাঝখানে। হয়তো কার্থেজবাসী সত্যিই ভয় আর অন্ধ বিশ্বাসে দেবতাদের তুষ্ট করত, আবার হয়তো রোম নিজের রক্তাক্ত জয়ের ইতিহাসকে পবিত্র দেখানোর জন্য কার্থেজ নামে অন্য এক জাতির মুখে মিথ্যে বর্বরতার মুখোশ এঁকেছিল। শেষ পর্যন্ত, ইতিহাস তো বিজয়ীদের লেখা কাহিনি আর তাদের কালি প্রায়ই আসে পরাজিতের রক্ত থেকে।

কার্থেজের টোফেট ধ্বংসাবশেষে স্থাপিত স্মৃতিস্তম্ভগুলি © historicmysteries.com

