১৫৭৬ সালের ১২ জুলাই রাজমহলের নিকট গঙ্গার তীরে সংগঠিত যুদ্ধে মুঘল জেনারেল খান জাহানের নিকট বাংলার শেষ সুলতান দাউদ শাহ কররানী পরাজিত হন। পলায়নপর সুলতান দাউদ নদীর ধার দিয়ে পশ্চাদপসরণ করছিলেন। কিন্তু নদীর পাড়ের এঁটেল মাটিতে তাঁর ঘোড়ার খুর আটকে যায়। মুঘল সৈন্যরা তাঁকে ধরে ফেলে এবং মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে। এর দ্বারা ১৩৫২ সালে সৃষ্ট স্বাধীন বাংলা সালতানাতের চির বিলুপ্তি ঘটে। ১৯৭১ সালের আগে আর বাংলায় কোন স্বতন্ত্র রাষ্ট্রশক্তির উন্মেষ ঘটেনি।
যাহোক, সুলতান দাউদের মৃত্যুর সাথে সাথেই কিন্তু বাংলা মুঘলদের দখলে যায়নি। বাংলায় মুঘল শাসন প্রতিষ্ঠিত হতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। প্রকৃতপক্ষে বাংলায় মুঘল অধিকার পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত হবার আগেই ১৬০৫ সালে সম্রাট আকবরের মৃত্যু হয়। সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে ১৬১২ সালে অবশেষে বাংলা পাকাপাকিভাবে মুঘল অধিকারে আসে। ১৭১৭ সাল নাগাদ এই অধিকার পলকা হয়ে ওঠে। মুঘল সম্রাটের নামমাত্র আনুগত্য ঘোষণা করে এই সময়ে নবাব উপাধিধারী শাসকেরা স্বাধীনভাবে বাংলা শাসন করেন।
আমাদের মধ্যে যে ভুলটি এখন মজ্জাগত হয়ে গেছে, এবং যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশটি আমরা কেউই খেয়াল করিনা, তা হচ্ছে, নবাব মুর্শিদ কুলী খাঁ থেকে শুরু করে নবাব সিরাজ উদ দৌলা পর্যন্ত সকলেই স্বাধীন ছিলেন। কিন্তু সার্বভৌম ছিলেন না। তাঁরা স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত প্রয়োগ করতেন, কিন্তু জুমার খুতবা এবং মুদ্রায় মুঘল সম্রাটের নাম উৎকীর্ণ থাকতো। তাঁরা সার্বভৌম রাজার মতো ঝরোকা দর্শন বা উঁচু মঞ্চে বসতেন না। বলা বাহুল্য, এসব ছিলো সেই যুগে একজন প্রকৃত স্বাধীন শাসকের স্বাধীনতার সার্বজনীন মানদণ্ড।
যাহোক, ১৫৭৬ সালে মুঘলরা বাংলার সুলতানকে হত্যা করতে সমর্থ হলেও ১৬১২ সালের আগে বাংলায়, বিশেষ করে আজকের বাংলাদেশে মুঘল অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এই ৩৬ বছরের সময়কালকে তাই মুঘল আমল বলার চেয়ে ভূঁইয়ার আমল বলে গণ্য করাই বাঞ্ছনীয়। এই সময়ে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ওয়র লর্ড, ভূঁইয়া বা জমিদারদের কতৃত্ব ছিলো। তাঁরা কখনো বিচ্ছিন্নভাবে, এবং কখনো সম্মিলিতভাবে পরাক্রমশালী মুঘল সাম্রাজ্যের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রাম চালান, এবং নিজেদের স্বাধীনতা ধরে রাখেন।
এই ৩৬ বছরে আকবর ও জাহাঙ্গীর তাঁদের শ্রেষ্ঠ সমরনায়কদের বাংলার ভূঁইয়াদের পরাভূত করতে পাঠান। কিন্তু একে একে এরা সকলেই ব্যর্থ হন। এদের মধ্যে ছিলেন রাজা মান সিং, খান-ই-জাহান হোসেন কুলী খাঁ, মুজাফফর খাঁ তুরবতী, খান-ই-আজম মীর্যা আজিজ কোকার মতো ইতিহাস বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ।
আজিজ কোকার ব্যর্থতার পর ১৫৮৩ সালের ১৮ মে সম্রাট আকবর তাঁর আরেক দক্ষ ও বিখ্যাত জেনারেল শাহবাজ খাঁ কাম্বোকে বাংলায় প্রেরণ করেন। শাহবাজ মুঘল দরবারে উচ্চপদে আসীন ছিলেন। তিনি ছিলেন সম্রাট আকবরের আমীর তোজাক বা কোয়ার্টার মাস্টার জেনারেল। এর আগে শাহবাজ খান ছিলেন মুঘল সাম্রাজ্যের মীর বখশী বা প্রতিরক্ষামন্ত্রী। ১৫৮১ সালে আকবর যখন তাঁর বিদ্রোহী ভাই মীর্যা হাকিমকে দমন করতে নিজে কাবুল গমন করেন, তখন প্রায় দশ মাস রাজধানী ফতেহপুর সিক্রিতে ওয়াকিল বা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সম্রাটের হয়ে সাম্রাজ্যের যাবতীয় দায়িত্বও সামলান শাহবাজ খান কাম্বো।
এসব নিযুক্তি শাহবাজ খানের ওজনই বয়ান করে। তবে তাঁর আবার অন্য বিড়ম্বনাও ছিলো। তিনি পাঠান কাম্বো গোত্রের লোক ছিলেন। মুঘল দরবারে কাম্বোদের নীচ কুলোদ্ভব বলে মনে করা হতো। তবে এই দাবীর পেছনে কোন ভিত্তি পাওয়া যায়না। তবে কাম্বোরা স্বভাবে ছিলেন কঞ্জুস। শাহবাজ খাঁ নিজেও কৃচ্ছ্রসাধনা করতেন।
তবে আমি শাহবাজ খানের প্রতি মুঘল ঐতিহাসিকদের কটাক্ষের একটি কারণ অনুমান করতে পারি। শাহবাজ খান ছিলেন ধার্মিক ও নিষ্ঠাবান সুন্নী। তিনি আকবরের দ্বীনে এলাহী ধর্মের ঘোর বিরোধী ছিলেন। শাহবাজ খান পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ কখনো ছাড়তেন না। তাঁকে দিনের অনেকটা সময় তসবীহ হাতে দেখা যেতো।
একবার ফতেহপুর সিক্রিতে আকবরের বৈকালিক ভ্রমণের সময় ঘটনাচক্রে শাহবাজ খাঁ আকবরের সামনে পড়েন। আকবর খুশি হয়ে তাঁর হাত ধরে পায়চারী করতে শুরু করেন। ইতোমধ্যে আসরের আজান পড়ে গেলে শাহবাজ খান অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করেন। কিছুক্ষণ উশখুশ করে তিনি জোর করে আকবরের হাত ছাড়িয়ে নিজের গায়ের চাদর বিছিয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে যান। হতভম্ব এবং অপমানিত আকবর বারবার ডাকাডাকি করলেও শাহবাজ খাঁ নামাজ ছাড়েননি। এতে সম্রাট ক্রুদ্ধ হন। পরে আকবরের প্রিয় সভাসৎ আবুল ফজল শাহবাজ খাঁর পক্ষে সম্রাটের কাছে সুপারিশ করেন। অসামান্য চরিত্রশক্তি আর যোগ্যতার কারণে আকবর শাহবাজ খানকে শাস্তি দেননি।
সম্ভবত তবে দ্বীনে এলাহীর প্রতি বাড়াবাড়ি রকমের শীতল থাকার কারণে সম্রাটের লোকজন শাহবাজ খানকে বজ্জাত বলে অভিহিত করতে থাকে। আকবর জীবিত থাকতেই ১৫৯৯ সালের ১১ নভেম্বর শাহবাজ খান কাম্বো মারা যান। তাঁর অন্তিম ইচ্ছা ছিলো, তাঁকে যেন আজমীরে শেখ মঈন উদ্দীন চিশতীর কবরের পাশে কবর দেয়া হয়। কিন্তু অদৃশ্য ইশারায় মাজারের খাদেম আপত্তি তোলেন। শাহবাজ খানকে মাজারের দেয়ালের বাইরে দাফন করা হয়। তবে কিছুদিন পরই মাজারের খাদেমরা একটি অভিন্ন স্বপ্ন দেখে ভীত হয়ে শাহবাজ খানের লাশ তুলে মাজারের ভেতরে এনে পুনরায় দাফন করেন। এই কথা আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরীতে রয়েছে।
যাহোক, শাহবাজ খান কাম্বো যখন বাংলায় আসেন, তখন বাংলায় মুঘলদের অস্তিত্বই হুমকির মুখে ছিলো। শাহবাজ খান এসেই ১৫৮৩ সালের ১৫ নভেম্বর পাবনার চাটমোহরের বিদ্রোহী ও বারো ভূঁইয়াগণের মিত্র মাসুম খাঁ কাবুলীকে পরাজিত করেন। প্রথমে বগুড়ার শেরপুর ও কয়েক ঘন্টার মধ্যে দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট পর্যন্ত এলাকা দখল করে শাহবাজ খান ভাটির উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।
এসময় ভাটির অধিপতি মসনদ-ই-আলা ঈসা খাঁ এক অভিযানে কোচবিহার ছিলেন। শাহবাজ খাঁ বগুড়ার শেরপুর ও দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট দখল করে নিলে ঈসা খান কোনমতে ব্রহ্মপুত্র নদ হয়ে কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার এগারসিন্দুরে এসে অবস্থান নেন। এখানে কয়েকটি নদী একত্রে মিলিত হয়েছে। শাহবাজ খান এগারসিন্দুরের বিপরীতে গাজীপুরের কাপাসিয়ার টোকে অবস্থান নেন।
একসময় ঈসা খান ও শাহবাজ খানের সৈন্যদের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। শাহবাজ খান অবস্থান পাল্টে বানার নদীর তীরে অবস্থান নেন। ঈসা খান কূটনীতির আশ্রয় নিয়ে প্রায় সাত মাস শাহবাজ খানকে সেখানেই আটকে রাখেন। তবে শাহবাজ একটি সেনাদলকে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলায় কতরাবোয় ঈসা খানের রাজধানী লুট করতে প্রেরণ করেন। কতরাবো বর্তমানে মাসুমাবাদ নামে পরিচিত। সোনারগাঁও নয়, কতরাবোই ছিলো ঈসা খানের অনেকগুলো রাজধানীর মধ্যে প্রধান রাজধানী। এটা আমাদের মধ্যে প্রচলিত আরেকটি ভুল ধারণা।
কতরাবো লুণ্ঠনের সংবাদে ঈসা খান প্রমাদ গোনেন। ততোদিনে আবার বর্ষা এসে গেছিলো। এই পর্যায়ে ঈসা খান শাহবাজ খানের বাহিনীর অবস্থানের আশেপাশে পনেরোটি স্থানে ব্রহ্মপুত্র নদের বাঁধ কেটে দেন, যাতে শাহবাজ খান নিরুপায় হয়ে কতরাবো আক্রমণে পাঠানো সেনাদলকে নিজের কাছে ডেকে এনে স্বীয় অবস্থানকে সংহত করতে বাধ্য হন। ঈসা খানের উদ্দেশ্য সফল হয়। নিরুপায় হয়ে কিছুটা অপ্রস্তুত অবস্থায় শাহবাজ ঈসা খানের উপর চূড়ান্ত আক্রমণ করেন। তবে ঈসা খানের গেরিলা কৌশলের কারণে যুদ্ধে জয়পরাজয় হচ্ছিলো না। উল্টা ঢাকার মুঘল থানাদার সৈয়দ হোসেনকে ভূঁইয়ারা আটক করে।
ঈসা খান সৈয়দ হোসেনকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে শাহবাজ খানকে তিন দফা সন্ধির প্রস্তাব করেন-