এখন আসি সমাধিতে আর কি কি ছিল। সিসেনসের কফিনটি সম্পূর্ণ সিলভার দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। শুনলে অবাক হবেন যে ঐ সমাধিতে রূপা দিয়ে তৈরি বাজপাখির মাথার কফিন, সোনার চাদর দিয়ে পেঁচানো দুটি কঙ্কাল, একটি সোনার মুখোশ, ছয়টি সোনার নেকলেস, ছাব্বিশটি ব্রেসলেট আরো অসংখ্য সোনার টুকরো ছিল। সবচেয়ে বড় নেকলেসের ওজন ছিল ৮ কেজি। মুখোশটির ওজন ১০ কেজি। ল্যাপিজ- লাজুলি দিয়ে ১০ কেজি ওজনের নেকলেস, ২ কেজি ওজনের ব্রেসলেট সেখানে ছিল। তার সমাধিতে পাওয়া সোনার এই অলংকার গুলোর কথা শুনলে যে কারো মনে প্রশ্ন জাগতে পারে এতো ভারি ভারি ওজনের গয়না গুলো তৈরি করা সম্ভব হলেও এগুলো পরে সম্রাট কিভাবে নিজেকে সামলাতেন বা কাজ করতেন। যাই হোক সমাধিতে পাওয়া এই সমস্ত গয়না বা সারকোফ্যাগাসের নকশা সেই সময়কার মিশরীয় সোনারুদের কাজের দক্ষতারই প্রমান বহন করে।
তানিস প্রাচীন এক রাজধানী। মিশরীয় ডেল্টা অঞ্চলে অবস্থিত। পিয়ারে মন্টেট ১৯৩৯ সালে মিশরের তানিসে খননকার্য শুরু করেন। দ্বাবিংশতম রাজবংশ সম্পর্কে যে সমস্ত তথ্য আজ আমরা জানি তার বেশিরভাগই মন্টেটের অবদান। তবে একটা মজার বিষয় হচ্ছে তিনি তানিসকে পিরামিসেস ভেবে খননটা শুরু করেছিলেন। এর পেছনে কারণও রয়েছে। তানিসে যে পুরাকীর্তি গুলো তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন তার অনেক গুলো দ্বিতীয় রামেসিসের রাজত্বকালের তৈরি বিভিন্ন মন্দিরের অংশ নিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। প্রথম দিকে তানিসের আমুনের মন্দিরের খনন কাজ শুরু করার পর তিনি বেশ বুঝতে পারলেন মন্দিরটির অভ্যন্তরে এর মধ্যেই লুটেরারা প্রবেশ করেছিল। তবে তার ভাগ্য ভাল ছিল। বেশ কিছু দিন কাজ করার পর তিনি হঠাৎ করেই একটি অক্ষত সমাধি খুঁজে পান। যা আগে কখনোই খোলা হয়নি। সুতরাং প্রথম অক্ষত মন্দির খুঁজে পাবার কৃতিত্ব আমরা পিয়েরে মন্টেটকেই দিতে পারি। তুতেনখামেনের যে সমাধি পাওয়া যায় সেটি ও কিন্তু সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় পাওয়া যায়নি ।
দেখা গিয়েছে সেটিকেও লুটেরারা বেশ কয়েকবার লুট করার চেষ্টা করেছিল। মন্টেট সমাধির দেওয়ালে যে হায়ারোগ্লিফিক্স পেয়েছিলেন সেখানে প্রথম সিসেনসের নাম লেখা ছিল। কিন্তু সমাধির ভিতরে যে কফিনটি ছিল সেখানে সিসেনসের মমি না থেকে দ্বিতীয় শেশঙ্কের মমি পাওয়া যায় এবং সেই সাথে বহু ক্যানোপিক জারও তিনি পেয়েছিলেন। তিনি খুব কনফিউজড ছিলেন । তার বারবার মনে হচ্ছিল এখানে আরও কিছু রয়েছে। ভাগ্য ভালো ছিল তার। ১৯৪০ সালে মন্টেট হঠাৎ করেই আরেকটি কক্ষ খুঁজে পান। কক্ষটি গ্রানাইট পাথর দিয়ে খুব নিখুঁতভাবে বন্ধ করে রাখা ছিল। টানা ৬ দিন ধরে অক্লান্ত পরিশ্রমের শেষে তিনি সম্পূর্ণ অক্ষত একটি কক্ষে প্রথম সিসেনসকে আবিষ্কার করেন। সময়টা খুব একটা ভালো ছিল না। তখন চারদিকে বিশ্বযুদ্ধের দামামা। হিটলার প্যারিসের দোরগোড়ায়। যে কোনো সময় আক্রান্ত হতে পারে প্যারিস। খুব চিন্তার সাথে গোপনে গোপনে তিনি তার কাজ চালিয়ে গিয়েছিলেন এবং এই কাজের সময় মিশরের শাসক ফারুক কাছে থেকে তাকে সহায়তাও প্রদান করছিলেন। ফারুক তাকে নির্দেশ দিলেন তিনি যেন তার খননকার্য বন্ধ না রাখেন। তিনি কাজ করতে থাকলেন এবং পরবর্তীতে আরও একটি কক্ষ পেলেন যেখানে ফারাও আমেনেমোপের মমি ছিল।সেখানে প্রচুর কেনপিক জার পাওয়া গিয়েছে। কেনপিক জার গুলো দেখতে তুতেন খামেনের সমাধিতে পাওয়া জার গুলোর মতনই ছিল। কেনপিক জারের পাশেই আরেকটি কক্ষ ছিল যেখানে সিসেনসের একজন জেনারেলের মমি ছিল। এত বিশাল সমাধি আবিষ্কার হাওয়ার্ড কার্টারের তুতেনখামেনের সমাধি আবিষ্কারের মতনই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু মন্টেটের ভাগ্য তখন চাপা পড়ে গেল বিশ্বযুদ্ধের ভয়ংকর দুর্যোগের আড়ালে। তখন পত্রিকাতে যুদ্ধের ভয়াবহতা, যুদ্ধের তীব্রতা সম্পর্কিত বার্তাগুলো এত বেশি প্রচারিত হতে থাকলও যে মন্টেটের আবিষ্কারগুলো সেগুলোর নিচে চাপা পড়ে গেলো। তার আবিষ্কার নিয়ে পত্রিকায় লেখালেখি, ছবি ছাপানো, কোন কিছুই আর হলো না। তাছাড়া আরেকটি কারণেও এর প্রচার তেমনভাবে হয়নি। মন্টেটের আবিষ্কার গুলো লিখিত রিপোর্টে ফ্রেঞ্চ ভাষায় প্রকাশিত হওয়ার কারণে সাধারণ ইংরেজি ভাষাভাষীর মানুষের কাছে পৌঁছাতে ৭০ বছর সময় লেগে গিয়েছিল। তাই আজ পর্যন্ত তুতেনখামেন, মিশরের বালক রাজা সমস্ত মিডিয়া ও মানুষের মনে রাজত্ব করছে।
কার্টুসের গায়ে লেখা থেকে জানা যায় ঐ বিশেষ বস্তুটি রামেসিসের বংশ থেকে উপহার হিসেবে দেওয়া হয়েছিল। এর অর্থ এই যে তাদের মধ্যে পারিবারিক একটা সম্পর্ক ছিল। প্রত্নতাত্ত্বিকদের এই সময়কার রাজবংশ সম্পর্কে ধারণা ছিল যে অর্থনৈতিকভাবে তাদের অবস্থা দুর্বল হয়ে পড়েছিল। তাদের অবস্থার বেশ অবনতি ঘটেছিল কিন্তু বিশাল প্রাপ্তি থেকে বুঝা যায় প্রত্নতাত্ত্বিকদের ঐ ধারণা সম্পূর্ণ সঠিক ছিল না ।