ভাবুন তো, এমন এক সময় ছিল যখন মৃত্যুই ছিল মানুষের বিনোদন! অবিশ্বাস্য শোনালেও, রোম শহরের হৃদয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কলোসিয়ামের প্রতিটি পাথরের গায়ে যেন সেই ভয়ংকর ইতিহাসের দাগ লেগে আছে। আজ যাকে আমরা বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্যের একটি, স্থাপত্যের বিস্ময় হিসেবে দেখি—কখনো তার ভেতরে প্রতিধ্বনিত হতো পশুর গর্জন, তলোয়ারের ঝনঝন, আর হাজারো অসহায় মানুষের আর্তনাদ।
রোম—যে শহরকে আমরা শান্তির প্রতীক ভাবি, সেই শহরের মাঝখানেই তৈরি হয়েছিল মৃত্যুর মহামঞ্চ। বলা হয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ রক্তক্ষয়েও যত প্রাণ হারায়নি, তার চেয়েও বেশি প্রাণ ঝরেছিল এই কলোসিয়ামের বালুকাবেলায়। তাই আজও যদি কেউ এর অন্ধকার করিডরে দাঁড়ায়, মনে হয় যেন দেয়ালের ফাঁক গলে ভেসে আসছে ভয়ঙ্কর চিৎকার।
কলোসিয়ামের গল্প শুরু হয় সম্রাট নিরোর হাত ধরে। প্রথম শতকে এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে রোম শহরের বিস্তীর্ণ এলাকা ছাই হয়ে গেলে তিনি সেই জমি দখল করে বানান তার বিলাসবহুল প্রাসাদ ডোমাস অরিয়া। তার সামনে দাঁড় করান নিজের বিশাল ভাস্কর্য—কলোসাস অব নিরো। কিন্তু অত্যাচারে ক্ষুব্ধ জনতার বিদ্রোহে নিরো শেষমেশ আত্মহত্যা করতে বাধ্য হন।
এরপর ক্ষমতায় এলেন ফ্লেভিয়ান সাম্রাজ্যের সম্রাট ভেসপাসিয়ান। নিরোর বিলাসিতার পরিবর্তে তিনি চাইলেন জনগণকে উপহার দিতে এক নতুন বিনোদনমঞ্চ। শুরু হলো কলোসিয়ামের নির্মাণকাজ। তবে তিনি জীবিত থাকতে এটি শেষ হতে পারেনি। কাজ সম্পূর্ণ করেন তার পুত্র টিটাস, আর সেখান থেকেই ইতিহাসে জন্ম নেয় “কলোসিয়াম”।

বিশেষ প্রশিক্ষিত যোদ্ধাদের লড়াই দেখতে সম্রাটসহ হাজার হাজার লোকের আগমন ঘটতো; image source: curriculumvisions.com
উদ্বোধনের সময় টিটাস আয়োজন করেন টানা একশ দিনের মহোৎসব। সঙ্গীত, খেলা, শক্তির প্রদর্শনী—সবকিছুর আড়ালে শুরু হয় এক রক্তাক্ত অধ্যায়। প্রথমে পশুর লড়াই, পরে পশুর সঙ্গে মানুষের যুদ্ধ। আফ্রিকার জঙ্গল থেকে আনা সিংহ, বাঘ, হাতি, চিতা—সবাইকে নামানো হতো রক্তের মঞ্চে। হাজারো দর্শকের করতালির মাঝে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হতো অসহায় দেহ।
এরপর এল গ্ল্যাডিয়েটরদের পালা। দাসেরা, যুদ্ধবন্দী কিংবা অপরাধীরা হতো এই ভয়ঙ্কর খেলায় অংশগ্রহণকারী। তাদের সামনে রাখা হতো মাত্র দুটি পথ—জয় অথবা মৃত্যু। প্রতিদিন কেউ না কেউ পড়ে থাকত বালির ওপর রক্তমাখা দেহ হয়ে, আর দর্শকদের উল্লাস থামত না। মাটির নিচে অন্ধকার খাঁচায় দিন কাটত তাদের, মৃত্যুর অপেক্ষায়।
২১৭ সালে আগুনে কলোসিয়ামের কিছু অংশ ধ্বংস হলেও সেই রক্তক্ষয়ী খেলায় কোনো বিরতি পড়েনি। বরং কলোসিয়াম তখন আরও বিখ্যাত হয়ে ওঠে। আশ্চর্যের বিষয় হলো—সাধারণ মানুষ কখনো প্রতিবাদ করেনি। বরং আনন্দে হাততালি দিয়ে উপভোগ করেছে সেই নির্মম দৃশ্য।
কিন্তু প্রকৃতির প্রতিশোধকে থামানো যায় না। ৪৪২ ও ৫০৮ খ্রিস্টাব্দে পরপর দুটি ভয়াবহ ভূমিকম্পে ভেঙে পড়ে কলোসিয়ামের বৃহৎ অংশ। পরে আরও কম্পনে ধসে যায় তিন ভাগের দুই ভাগ। ধীরে ধীরে অবসান ঘটে রোমের সেই রক্তাক্ত বিনোদনের যুগের।
আজ কলোসিয়াম দাঁড়িয়ে আছে বিশ্বের বিস্ময় হিসেবে, ভ্রমণপিপাসুদের স্বপ্নের গন্তব্য হয়ে। কিন্তু এর প্রতিটি স্তম্ভ, প্রতিটি ফাঁকফোকর নীরবে বলে যায় এক কালো ইতিহাসের কথা। হয়তো আপনি যদি সেখানে দাঁড়ান, মনে হবে—ভেসে আসছে সিংহের গর্জন, তলোয়ারের ঝনঝন, আর অসহায় মানুষের করুণ আর্তনাদ।
এ যেন সৌন্দর্যের আড়ালে লুকিয়ে থাকা নিষ্ঠুরতার এক নীরব সাক্ষ্য—যা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, মানুষ বিনোদনের নামেও কতটা নির্মম হতে পারে