পনের শতকের আগের কথা বলছি। আটলান্টিক মহাসাগরের দুইপাশে দুইটি ভূখন্ডের অবস্থান। একটিকে যদি বলি পুরনো বিশ্ব ( ইউরোপ, আফ্রিকা, এশিয়া জুড়ে ) তবে আরেকটি নতুন বিশ্ব ( আমেরিকা) । ১৪৯২ সালে ইটালিয়ান নাবিক ক্রিস্টোফার কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করেন। যদিও আমেরিকার প্রকৃত আবিষ্কারক কে তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, তবুও এই দুই বিশ্বের মধ্যে কার্যকর এবং সফল যোগাযোগ স্থাপনের কৃতিত্ব যে সম্পূর্ণই কলম্বাসের, তা নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই।
কলম্বাসের সেই ঐতিহাসিক আবিষ্কারের পর এই দুই বিশ্বে যে পরিবর্তন আসে তাকেই ‘কলম্বিয়ান এক্সচেঞ্জ’ বলা হয়। মূলত এটি ছিল এই দুই বিশ্বের মাঝে পারস্পরিক পরিবর্তন। এর ফলে রোগজীবাণু, খাদ্যশস্য, মানুষ, সংস্কৃতি, উদ্ভিদ, পশুপাখি, মূল্যবান ধাতু সর্বোপরি মানুষের চিন্তাধারার মধ্যে পারস্পরিক যে স্থানান্তর সংঘটিত হয়, তা নব্য আমেরিকায় যতটা হয়েছিল ততটাই সংঘটিত হয়ছিল আফ্রো-ইউরোশিয়ায়। ১৯৭২ সালে আলফ্রেড ক্রসবি নামক একজন মার্কিন ইতিহাস এবং ভূগোলবিদ ‘দ্য কলম্বিয়ান একচেঞ্জ’ শীর্ষক একটি বইয়ে সর্বপ্রথম এই বিষয়টি মানুষের সামনে তুলে ধরেন। তিনিই ‘কলম্বিয়ান এক্সচেঞ্জ‘ টার্মটির জনক। এসব স্থানান্তরের কোনোটা ঘটেছিল ইচ্ছাকৃতভাবে আবার কোনোটা অনিচ্ছাকৃত বা দুর্ঘটনাজনিত।
এর আগে আদিবাসী আমেরিকানদের কোনো রোগবালাই ছিল না বললেই চলে।এমনকি সর্দি কাশি কী, তারা তাও জানত না। তাই সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে শরীরে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও ছিল না। সুস্থ-সবল দেহ তাদের।বনে- বাদারে চড়ে বেড়াতো। শিকার করে আর বনের ফলমূল খেয়ে বাঁচত। কলম্বাসের আমেরিকায় পদার্পণের মাধ্যমে পুরাতন বিশ্ব থেকে জলবসন্ত, গুটিবসন্ত, হাম, টাইফয়েড, কলেরা, প্লেগ, ডিপথেরিয়া, হুপিং কাশি, ম্যালেরিয়া প্রভৃতি সংক্রামক রোগের জীবাণু নতুন বিশ্বে স্থানান্তরিত হয়। ফলে এসব সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যেতে থাকে লাখ লাখ মানুষ।১৪৯২ সালের পরবর্তী এক-দেড়শ’ বছরের মধ্যেই পুরো ভুখণ্ডের ৮০- ৯৫% মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। হিস্পানোলা দ্বীপের ৬০ হাজার থেকে ৮০ লাখ জনসংখ্যা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় মাত্র ৫০ বছরের মধ্যে।
অপরদিকে নতুন বিশ্ব তথা আমেরিকা থেকে পুরাতন বিশ্বে যে মারাত্মক রোগটি স্থানান্তরিত হয়, সেটি হচ্ছে যৌনবাহিত রোগ সিফিলিস। কলম্বাসের নাবিকেরা সিফিলিস রোগের জীবাণু ইউরোপে বহন করে নিয়ে আসে। জীবাণুবাহক নাবিক হতে সিফিলিস তাদের স্ত্রী এবং স্থানীয় যৌনকর্মীদের মাধ্যমে পুরো ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। মাত্র ৫ বছরের মধ্যে ইউরোপে সিফিলিস মহামারী আকার ধারণ করে এবং ১৪৯৮ সালের মধ্যে আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং ভারত, ১৫১৫ সালে অস্ট্রেলিয়া এবং ১৫৬৯ সালের মধ্যে জাপানে ছড়িয়ে পড়ে।
এখন আসি কৃষিজ পণ্যের স্থানান্তর সম্পর্কে। ঐতিহাসিক সেই ঘটনার মাধ্যমে আমেরিকা থেকে এমন কিছু কৃষিজ খাদ্যশস্যের আগমন ঘটে, যা মানুষের খাদ্যাভাসের ব্যাপক পরিবর্তন ঘটায়। যেমন- আলু, মিষ্টি আলু, ভুট্টা, মিষ্টি কুমড়া, কাঁচা মরিচ, ভ্যানিলা, কোকো (যা থেকে চকলেট তৈরি হয়), শিম ইত্যাদি; ফলমূলের মধ্যে রয়েছে পেঁপে এবং আনারস।
স্থানান্তরিত খাদ্যশস্যের মধ্যে আলুর প্রভাব সবচেয়ে বেশি। আলু প্রচুর ক্যালরি সম্পন্ন পুষ্টিকর একটি সবজি। আলু খাওয়ার দরুন ইউরোপের মানুষজন সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হতে থাকল। এতে করে ইউরোপের জনসংখ্যা হু হু করে বাড়তে লাগল। জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধির কারণে নগরায়ণ তরান্বিত হয়েছে। ফলে নগরায়নে আলুর ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নাই।
আজকের দিনে ছোট – বড় সবাই চকলেটের দারুণ ভক্ত। এই চকলেট তৈরি হয় যে কোকো বীজ থেকে তাও আসে আমেরিকা থেকে। ১৪৯২ সালের পরে এটি ইউরোপ, আফ্রিকা, এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে এই চকলেট ব্যবসাকে ঘিরে গড়ে উঠেছে বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি। অন্যদিকে আমেরিকার মাটি এবং জলবায়ু পুরাতন বিশ্বের কিছু ফসল উৎপাদনের জন্য ব্যাপকভাবে উপযোগী ছিল। ফলে ধান, গম, আখ, বার্লি ইত্যাদি ফসলি পণ্য আমেরিকায় নিয়ে আসা হলো চাষাবাদের উদ্দেশ্যে। এসব ফসলের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হচ্ছে আখ। কলম্বাস ১৪৯৩ সালে দ্বিতীয়বার যখন আমেরিকায় আসেন তখন স্পেন থেকে আখ সাথে করে নিয়ে এসেছিলেন। আমেরিকার বেশিরভাগ ভূমিই আখ চাষের উপযোগী ছিল, বিশেষত ক্যারিবীয় এবং ল্যাটিন আমেরিকা অঞ্চল। ফলে এসব অঞ্চলে ব্যাপকভাবে আখ চাষ শুরু হয়।
তারই ফলে আজকের দিনে ব্রাজিল বিশ্বের সবচেয়ে বেশি চিনি উৎপাদনকারী দেশ। এছাড়া মেক্সিকো, কিউবা, কলম্বিয়া, মাকিন যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি দেশ চিনি উৎপাদনে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে। নতুন বিশ্বে আসা কলা, লেবু, কমলা, আঙুর এবং জলপাই এর মতো সাইট্রাস জাতীয় ফলমূল নেটিভদের ভিটামিনের যোগান দিয়েছিল।ফলে তাদের রোগ প্রতিরোধক শক্তি বৃদ্ধি পেয়েছিল। এছাড়াও গরু, ছাগল, ভেড়ার মতো গৃহপালিত প্রাণী কিংবা ঘোড়া, শুকর, গাধা প্রভৃতি প্রাণী আমেরিকায় প্রবেশ করে ইউরোপীয়দের হাত ধরেই।
এরা একদিকে যেমন খাদ্যে আমিষের সরবারহ নিশ্চিত করেছিল তেমনি এসব পশুদের মাধ্যমে পরিবহন ক্ষেত্রে সূচনা হয়েছিল এক নতুন বিপ্লবের।নেটিভ আমেরিকানরা শিকারি হওয়ায় ঘোড়ার মাধ্যমে শিকার আরো সহজ হয়ে গিয়েছিল। ফলে খাদ্যের যোগান বেড়ে গিয়েছিল বহুগুণে। এছাড়া গোত্রে গোত্রে বিভিন্ন যুদ্ধবিগ্রহেও ঘোড়ার ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়েছে।
কলম্বাস দ্বিতীয়বার আমেরিকা গেলে ফেরার সময় তিনি তামাক পাতা ইউরোপে নিয়ে আসেন। নেটিভ আমেরিকানরা তামাককে ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করলেও, ইউরোপে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে ধূমপানের মাধ্যমে এর অপব্যবহার শুরু হয়। ল্যাটিন আমেরিকার আরেকটি গাছের কথা না বললেই নয়-‘সিনকোনা’ নামক গাছের নির্যাস থেকে কুইনাইন আবিষ্কার হয়েছিল যা ম্যালেরিয়ার চিকিৎসা এবং প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। কুইনাইন ব্যবহারের ফলে তৎকালীন সময়ে আফ্রিকা এবং এশিয়ায় ম্যালেরিয়া রোগে মৃত্যুহার অনেক কমে যায়। মূল্যবান ধাতুও অনেক নিয়ে আসা হয়েছিল নতুন বিশ্বে।বিশেষ করে রূপা- যা দিয়ে বানানো হতো রৌপ্যমুদ্রা।
কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের পর ঝাঁকে ঝাঁকে ইউরোপীয়ানরা নতুন এই মহাদেশে পাড়ি জমাতে থাকে। স্থানীয় আদিবাসীদের উচ্ছেদ করে তাদের জমি দখল করে ।এখানকার বিশাল বিশাল জমিতে কৃষিকাজ করতে হলে যে প্রয়োজন – শ্রমিকের। সেই প্রয়োজন মিটাতে আফ্রিকা থেকে ব্যাপকভাবে মানুষজন দাস হিসেবে ধরে নিয়ে আসতে শুরু করে। শুরু হয় ট্রান্স আটলান্টিক দাস ব্যবসা নামক ইতিহাসের আরেক কলঙ্কময় অধ্যায়।
এই নির্মম অধ্যায়ে একে একে সামিল হয়েছে পর্তুগিজ, ডাচ, ইংরেজ এবং ফরাসীরা এবং দেখিয়েছে শোষণ, অমানবিকতা ও নির্মমতার চূড়ান্ত পরাকাষ্ঠা। প্রায় সাড়ে তিনশ বছর ধরে চলতে থাকা এই দাস ব্যবসায় আফ্রিকার প্রায় এক থেকে দেড় কোটির মতো নারী, পুরুষ ও শিশুকে দাস বানিয়ে ধরে আনা হয়েছিল। যাদের প্রায় তিন ভাগের এক ভাগই মারা পড়েছিল সমুদ্র পথে নিয়ে আসার সময়।
কলম্বিয়ান এক্সচেঞ্জের সর্বোচ্চ সুবিধাভোগী হলো পুরাতন বিশ্ব, বিশেষত ইউরোপ। এই এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে ইউরোপে আসা খাদ্যশস্য কিংবা নতুন মহাদেশে চাষাবাদকৃত খাদ্যশস্য শিল্প বিপ্লবের মাধ্যমে ইউরোপের উত্থানের পেছনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। অপরদিকে আমেরিকা এবং আফ্রিকা হারিয়েছে মিলিয়ন মিলিয়ন অধিবাসী। যদিও এই দুই মহাদেশ এই বিনিময় প্রক্রিয়ার সুফলও ভোগ করেছে। কিন্তু লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু, প্রাপ্ত সুফলকে ছাপিয়ে গেছে বহুগুণে।
লেখক:
Muniba khanom
Rabab Ahmed