যিনি ছিলেন ভারতবর্ষে মোগল সাম্রাজ্যের স্থপতি এবং প্রথম মোগল সম্রাট, সেই বাবরকে নিয়েই এই ছোট্র ‘সিটি ট্যুর’। ১৪৯৪ সালে বাবর মাত্র এগার-বারো বছর বয়সে বাবার উত্তরাধিকারী হিসেবে বর্তমান উজবেকিস্তানের (তখন বলা হতো Fergana) সিংহাসনে বসেন। আমরা জানি, বাবর ছিলেন তৈমুর লং এবং চেঙ্গিজ খানের সরাসরি বংশধর। বাবরের প্রথম শাসনকাল শুরু হয় অনেকগুলো পরাজয় দিয়ে। সিংহাসনে আরোহনের সাথে সাথেই চরম বিরোধিতার মুখোমুখি হন বাবর। এখানে বলে রাখা ভালো, তখন মধ্য এশিয়ার আশেপাশের প্রায় সব এলাকার শাসকর্তারা ছিল তারই আত্মীয়-স্বজন। এদের মধ্যে বিশেষ করে তার দুই চাচা বাবরকে সিংহাসন থেকে সরাবার অনেক চেষ্টা করতে থাকে। তার নানী আইসন দৌলত বেগমের সহায়তায় এবং কিছুটা তার ভাগ্যের জোরে তাদের সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়।
এর কয়েক বছর পরই বাবর উজবেকিস্তানের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ইরানের সমরকন্দ শহর জয় করে ফেলেন মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সেই, কিন্তু তার রাজ্য উজবেকিস্তান (Fergana) হাতছাড়া হয়ে যায় ঐ একই সময়ে। তিনি উজবেকিস্তান পুনর্দখলের আপ্রাণ চেষ্টা করেন। বাবরের দুর্ভাগ্য, হারিয়ে ফেলেন সমরকন্দও। বাবর হয়ে পড়েন রাজ্যহারা। তিনি ১৫০১ সালে হারানো দু’টি এলাকা আবার দখলের বারবার চেষ্টা করেও মোহাম্মাদ শায়বানী খানের কাছে পরাজিত হন শোচনীয়ভাবে। আরম্ভ হয় বাবরের কঠিন সময়। বাবর তার অল্প কিছু অনুসারী নিয়ে মধ্য এশিয়ার পর্বত মালা এবং তাশখন্দের আশেপাশের অঞ্চলে উদভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়ান কয়েক বছর। ভাগ্যের পরিহাস, উজবেকিস্তানের শাসক হবার মাত্র দশ বছরের মাথায় বাবর হয়ে যান কপর্দকহীন রাজ্যবিহীন এক যাযাবর। এই সময়টায় তিনি আসলে বেঁচে ছিলেন স্থানীয় কৃষক আর তার কিছু বন্ধুদের সহায়তায়। আশেপাশের কোনো রাজ্যই তাকে আশ্রয় দিতে এগিয়ে আসে নি, যদিও এসব রাজ্যের বেশীরভাগ অধিপতিরা ছিল বাবরেরই ঘনিষ্ট আত্মীয়-স্বজন। যেমন, তাশখন্দের শাসক ছিলেন বাবরের আপন মামা, যিনি কিছুতেই বাবরকে তার রাজ্যে দেখতে চান নি। বাবর পরবর্তীতে নিজেই লিখেছেন, “তাশখন্দে অবস্থানকালে আমি অনেক দারিদ্র্যতা ও অপমান সহ্য করেছি। না ছিল আমার কোনো দেশ, না কোনো আশা!” আশাহীন বাবর কি করে ঘুরে দাঁড়ালেন আবার, আসুন দেখি সেই উপাখ্যান।
এতো প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সবকিছু হারা বাবর আস্তে আস্তে তার একটি শক্তিশালী সৈন্য বাহিনী গড়ে তুলেন। ১৫০৪ সালে তিনি করে ফেলেন এক দুঃসাহসিক পরিকল্পনা। বাবর তুষারে আবৃত দুর্গম হিন্দুকুশ পর্বতমালা অতিক্রম করে কাবুল দখল করে ফেলেন, যা কিনা তখন অনেক শাসকের কাছে ছিল অকল্পনীয়। রণকৌশল হিসেবে এরপর তিনি ইরানের সাফাভিদদের সাথে মৈত্রী করে সমরকন্দসহ তুর্কিস্তানের কিছু এলাকা দখল করেন আবারো। হায়রে ভাগ্য বাবরের! এই বিজয় বেশীদিন ভোগ করতে পারলেন না, আবার হারিয়ে ফেললেন সমরকন্দসহ তুর্কিস্তানের বিজিত এলাকাগুলো শায়বানী খানের কাছে। সমরকন্দ হারানোর ব্যথা তাকে বহুদিন তাড়া করে বেড়ায়। এমনকি বিশাল ভারতবর্ষের সম্রাট হবার পরও সমরকন্দে বারবার পরাজয়ের কথা তিনি কিছুতেই ভুলতে পারেন নি। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত বাবর সমরকন্দ না পাবার আক্ষেপ করে গেছেন।
তৃতীয়বারের মতো সমরকন্দ হাতছাড়া হবার পর বাবর মনোযোগ দিলেন ভারতের দিকে। ঐ সময়টায় ভারতের একটি বড় অংশ শাসন করতো আফগানি ইব্রাহিম লোদী, আর রাজস্থান শাসন করতো রাজপূত রাজা রানা সাঙ্গা। ১৫২৬ সালে প্রথম পানিপথের যুদ্ধে ইব্রাহিম লোদীকে পরাজিত করে বাবর ভারতে মোগল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার সূচনা করেন। যদিও প্রথমে রানা সাঙ্গা প্রতিজ্ঞা করেছিল যে, সে বাবরকে সাহায্য করবে ইব্রাহিম লোদীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ের জন্য, কিন্তু রানা খুব তাড়াতাড়িই সে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে। রানা পরে বুঝতে পারলো যে বাবর ভারতবর্ষ ছেড়ে সহজে যাবে না। এই প্রতিজ্ঞা ভঙ্গই ছিল রানার বড় একটি ভুল, এবং এ ভুলের মাশুল তাকে দিতে হলো পরের বছরই। বাবর ১৫২৭ সালে খানওয়ার যুদ্ধে রানাকে পরাজিত করে রাজস্থান দখল করে ফেলেন। এরপর বাবরকে আর পেছনের দিকে তাকাতে হলো না, এগিয়ে চললেন ভারতে নতুন এক ইতিহাস রচনায়।
শিল্প, সাহিত্য, সংগীত এবং বাগানের প্রতি অত্যন্ত অনুরাগী বাবর ১৫৩১ সনে ৪৮ বছর বয়সে আগ্রায় মৃত্যুবরণ করেন। সম্রাট হুমায়ূন ছিলেন বাবরের ছেলে, আর বাবর ছিলেন মহামতি সম্রাট আকবরের পিতামহ। বাবরের মৃত্যুর পর হুমায়ূনের সিংহাসন লাভ, তারপর আকবরের বিশাল সাম্রাজ্য বিস্তার, সে এক আরেক অবাক করা অধ্যায়। আজ আর নয়, আরেক দিন হবে সেই মজার ‘সিটি ট্যুর’!