মাটির নিচে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকা কিছু মানুষ এবং তাদের ব্যবহার্য জিনিসপত্র ইতিহাসবিদদের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে সাহায্য করে। তারা যা লিখে রাখেন, তা আমাদের সেই সময়কার সমাজ ও সভ্যতা সম্পর্কে জ্ঞান লাভের পথ প্রসারিত করে দেয়। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে দক্ষিণ ইউরাল অঞ্চলের কিচিগিনো / কিচিগিনা সমাধি টিলাগুলোর একটি থেকে পাওয়া সার্মাটীয় (Sarmatian) নারী সমাধিটি প্রাচীন যাযাবর সমাজের অভিজাত কাঠামো, তাদের চিকিৎসা-জ্ঞান এবং নারীর সামাজিক ও আধ্যাত্মিক ভূমিকা সম্পর্কে এক অসাধারণ ছবি তুলে ধরে।
সমাধিটি ছিল পঞ্চাশ থেকে ষাট বছর বয়সী একজন নারীর। তাঁর শারীরিক বৈশিষ্ট্য ছিল ককেশীয়। জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে তিনি প্রবলভাবে মেরুদণ্ডজনিত রোগে ভুগছিলেন। কিন্তু এই শারীরিক দুর্বলতা নিয়েই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করার পর তাঁকে এই সমাধিতে শায়িত করা হয়। তাঁর এই সমাধি প্রাচীন বিশ্বের অন্যতম বিস্ময়কর নিদর্শনে পরিণত হয়েছে।

“সার্মাটীয় পুরোহিতা”-এর মুখাবয়ব পুনর্গঠন — মানববিদ্যা ভিত্তিক ভাস্কর্য রচনা, নির্মাতা এ. আই. নেচভালোডা, ২০০৮ © State Museum of the South Ural History
এই নারীর সঙ্গে আবিষ্কৃত হয় এক বিস্ময়কর তথ্য। নারীর বাম হাতটি কৃত্রিমভাবে প্রতিস্থাপিত হয়েছিল। নিশ্চয়ই কোনো এক সময়ে তিনি প্রচণ্ড ব্যথা পেয়েছিলেন। সেই ব্যথা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই তৎকালীন চিকিৎসকেরা তাঁর হাতের এই প্রতিস্থাপনের ব্যবস্থা করেছিলেন। সেই কৃত্রিম হাতের আঙুলে পরানো ছিল সোনার তারের আংটি। ডান এবং বাম হাতের আংটিগুলো প্রায় একই রকম ছিল। এই ধরনের অস্ত্রোপচার সেই সময়ের উন্নত চিকিৎসা ও কারিগরি দক্ষতার প্রমাণ বহন করে। একই সঙ্গে এটি নারীর উচ্চ সামাজিক মর্যাদারও সুস্পষ্ট প্রমাণ।
নিখুঁত সূচিকর্মে সজ্জিত অত্যন্ত সুন্দরভাবে অলংকৃত এক পোশাকে এই নারীকে সমাধিস্থ করা হয়েছিল। পোশাকটির গায়ে ছোট ছোট কাঁচের পুঁতি এবং সোনার পাত লাগানো ছিল। তাঁর সারা গায়ে ছিল অসাধারণ সূক্ষ্ম নকশার অলংকার। ব্রোঞ্জের তৈরি চুড়ি এবং তামার ওপর মোটা সোনার পাত পরানো গলার নেকলেস ছিল তাঁর অলংকারের অংশ। এটি সে সময়কার যাযাবর জাতির অভিজাতদের জন্য তৈরি কারুশিল্পের এক পরিচিত নকশা। সেই সঙ্গে তাঁর সঙ্গে দেওয়া ছিল সোনার আংটি, কার্নেলিয়ান ও আগেট পাথরের পুঁতি। এই পুঁতিগুলোর উৎস ভারতীয় ও ইরানি কর্মশালা বলে মনে করা হয়। এত দূরদেশ থেকে সংগ্রহ করা এই সমস্ত পণ্য এই অঞ্চলের বিস্তৃত বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগের প্রমাণ বহন করে।
সমাধির ভেতরে রাখা ছিল ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান সংক্রান্ত সামগ্রী। এই সামগ্রীগুলো এই নারীর পরিচয়কে আরও গভীর মাত্রা দেয়। তাঁর হাতের পাশে রাখা ছিল হাতলওয়ালা একটি আয়না। এটি একটি চামড়ার থলির ভেতরে সংরক্ষিত ছিল, যদিও সময়ের আবর্তে থলিটি পচে গিয়েছিল। সেই থলির ভেতরে পাওয়া যায় একটি মানুষের দাঁত, একটি চকের টুকরো এবং রক ক্রিস্টাল। মনে করা হয়, বিভিন্ন ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, ভবিষ্যদ্বাণী কিংবা চিকিৎসার কাজে এগুলো ব্যবহৃত হতো। তাঁর পায়ের কাছে রাখা একটি ব্রোঞ্জের পাত্রে কার্বনের চিহ্ন পাওয়া গেছে। মনে করা হচ্ছে, এটি ভেষজ পানীয় বা ঔষধি মিশ্রণ তৈরি করতে ব্যবহৃত হতো। ডান হাতের পাশে রাখা ছুরি এবং হাড়ের তৈরি একটি চামচ চিকিৎসা বা আচারিক কাজের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত হতে পারে।

সার্মাটীয় যুগের গয়নার সমাহার © State Museum of the South Ural History
কিচিগিনো সমাধিক্ষেত্রটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নস্থল। এখানে মোট এগারোটি সমাধি টিলা রয়েছে। এই সমাধি টিলাগুলোকে অভিজাত সার্মাটীয় বংশের কবরস্থান বলে ধারণা করা হয়। ২০০৭ সালে মাউন্ড–৩-এ খননের ফলে আরও পাঁচটি অক্ষত সমাধি আবিষ্কৃত হয়। এর মধ্যে দুটি ছিল পুরুষ অশ্বারোহীর। তাঁদের সঙ্গে তলোয়ার ও তীরে ভরা তূণী পাওয়া যায়। বাকি তিনটি ছিল নারীর সমাধি। এই নারীদের মধ্যে দুজনের বয়স তুলনামূলকভাবে কম ছিল, কিন্তু তাঁদের সঙ্গে ১৫০টিরও বেশি তীরসহ তূণী পাওয়া গিয়েছিল। এই তথ্য যাযাবর জাতির প্রথার সঙ্গে পুরোপুরি মিলে যায়।
গ্রিক ইতিহাসবিদ হেরোডোটাস এই বিষয়ে বিশদভাবে উল্লেখ করেছিলেন। তাঁর মতে, এই জাতির কিশোরীরা বিয়ের আগে ঘোড়া চালানো, তীর চালানো এবং যুদ্ধবিদ্যায় দক্ষ প্রশিক্ষণ পেত। অন্যদিকে, প্রবীণ নারীর সমাধিটিতে কোনো অস্ত্র বা তীর পাওয়া যায়নি। এটিও হেরোডোটাসের বিবরণের সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তাঁর লেখা থেকে জানা যায়, এই যাযাবর জাতির বিবাহিত নারীরা সামরিক দায়িত্ব ত্যাগ করতেন। অস্ত্রের এই অনুপস্থিতির কারণেই সম্ভবত তাঁর কবরে কোনো অস্ত্র ছিল না।
অস্ত্র না থাকলেও তাঁর সমাধিতে পাওয়া বিপুল সম্পদ, আয়না, দূরদেশীয় পুঁতি এবং চিকিৎসা-সংক্রান্ত সামগ্রী থেকে বোঝা যায়, তিনি শুধু একজন অভিজাত নারীই ছিলেন না; সম্ভবত তিনি ছিলেন একজন সম্মানিত চিকিৎসক, আচারবিশারদ বা পুরোহিত। ধারণা করা হয়, তিনি দক্ষিণ ট্রান্স-উরাল বন–স্তেপ অঞ্চলের এক প্রভাবশালী সার্মাটীয় পরিবারের আধ্যাত্মিক ও চিকিৎসাগত দায়িত্ব পালন করতেন।

সমাধি থেকে পাওয়া সোনা © State Museum of the South Ural History
ভৌগোলিক দিক থেকেও কিচিগিনো সমাধি টিলাগুলোর অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো রাশিয়ার দক্ষিণ ইউরাল অঞ্চলে, চেলিয়াবিনস্ক ওব্লাস্তে, কিচিগিনো নামের একটি গ্রামের কাছে অবস্থিত। এই এলাকাটি ইউরোপ ও এশিয়ার সীমান্তভূমি। এখানে বন ও তৃণভূমি একসঙ্গে রয়েছে। প্রাচীনকালে এই অঞ্চলটি যাযাবর সার্মাটীয় ও সাউরোমাটীয় জাতিগোষ্ঠীর চলাচল ও বসতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল। এই অঞ্চলের উর্বর তৃণভূমি, নদী এবং সহজে চলাচলের উপযোগী পথের কারণে এটি খ্রিস্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দে এই ঘোড়াচালক যাযাবরদের সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক এক মিলনস্থলে পরিণত হয়েছিল।
সব মিলিয়ে কিচিগিনো সমাধি টিলাগুলো প্রাচীন এক জগতের নীরব সাক্ষ্য বহন করে। এখানে ইউরোপীয়, ইরানি, ভারতীয় ও স্তেপ সংস্কৃতির এক সেতুবন্ধন ঘটেছিল। এই সার্মাটীয় নারীর সমাধি শুধু একটি ব্যক্তিগত জীবনের গল্প নয়; বরং তা প্রাচীন ইউরেশীয় সমাজে নারীদের শক্তি, জ্ঞান ও মর্যাদার এক গভীর ঘোষণাপত্র হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে।