“ইতিহাসের বই দিয়ে ব্যক্তিত্ব বিচার করলে এটি দিনের আলোর মতো স্পষ্ট যে, পুরুষরাই ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক চরিত্র ছিলেন। অন্তত মনে রাখার মতো কোনো চরিত্র যদি থেকে থাকে, তবে পুরুষরাই সবার সামনে চলে আসেন। অবশ্যই এটি একটি অসত্য বিষয়। কিন্তু আমরা এই অসত্য বিষয়টিকেই গলাধঃকরণ করে আসছি, যেখানে পুরুষদের উপস্থিতি স্বীকার করা হলেও একইসাথে নারীদের উপস্থিতির কোন হদিস মেলে না।“ –টাইম ম্যাগাজিন, ৮ মার্চ, ২০১৬ সাল।
পৃথিবীর অর্ধেক লোকসংখ্যার অনুপাতে নারীদের দখল থাকলেও ইতিহাসে তাদের অবদানকে সব সময়ই উপেক্ষা করা হয়েছে। ভারতীয় ইতিহাসের বড় একটি অংশ লেখা হয়েছে রাজকীয় ঐতিহাসিকগণের হাতে। এই ইতিহাসে প্রকটভাবে পুরুষতান্ত্রিকতা ফুটে উঠেছে। বলাই বাহুল্য, পুরুষ ঐতিহাসিকরা স্বাভাবিকভাবেই নিজের স্বজাতীয়দের মহান কর্মযজ্ঞ তুলে ধরতেই আনন্দ পেতেন। নারীদের সামাজিক বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে তারা ছিলেন নিছক তাদের পুরুষ সহযোগীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার পাত্র, যেখানে তাদের হাতে কোনো ক্ষমতা ছিলো না। শুধুমাত্র পুরুষ সহযোগীর ছায়া হয়ে থাকাই যেনো ছিলো নারীদের একমাত্র দায়িত্ব।
পুরুষতান্ত্রিক আবহে রুদ্ধ হয়ে থাকার এই রূঢ় বাস্তবতা কিছু অঞ্চলের জন্য সত্য হলেও অন্যান্য অঞ্চলে নারীরা বেড়ে উঠেছিলেন আপন মহিমায়। অনেক স্বাধীনচেতা নারী নিজের চেষ্টায় শিক্ষা অর্জন করে শিক্ষিত হয়ে উঠেছিলেন। মুঘল ইতিহাসের চুলচেরা বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাই, সাম্রাজ্যে নারীদের অবস্থান সন্তোষজনক না হলেও তারা অন্দরে শিক্ষা গ্রহণ করতেন। সব মুঘল সম্রাটই শিক্ষিত ও সংস্কৃতিমনা হওয়ায় নিজেদের সন্তানের শিক্ষা-দীক্ষার গুরুত্ব তারা উপলব্ধি করেছিলেন। মুঘল রাজকন্যাদের পড়ালেখার জন্য প্রাসাদের ভেতরেই বিশেষ আয়োজন ছিলো। কোনো কোনো রাজকুমারী শিল্প, সংস্কৃতি, যুদ্ধ ও কূটনীতিতে বিশেষ পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন। এদের মধ্যে গুলবদন ছিলেন অন্যতম।
গুলবদন বানু বেগম মুঘল সাম্রাজ্যের একমাত্র নারী ঐতিহাসিক ছিলেন, যার লেখা ‘হুমায়ূননামা’ এখনো পর্যন্ত মুঘল ইতিহাসের উপর কোন নারীর লেখা সর্বশেষ বই। প্রথম মুঘল সম্রাট বাবর ও তার স্ত্রী দিলদার বেগমের ঘর আলো করে গুলবদন বানু বেগম জন্ম নিয়েছিলেন ১৫২৩ সালে আফগানিস্তানে। বাবরের মেয়ে, হুমায়ূনের বোন ও আকবরের ফুপু হওয়ায় গুলবদন মুঘল সাম্রাজ্যের বিখ্যাত তিন সম্রাটের শাসন দেখতে পেয়েছিলেন।
সম্রাট আকবর যখন তার আত্মজীবনী ‘আকবরনামা’-র জন্য গুলবদনের কাছে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রাথমিক ইতিহাসের বিষয়ে জানতে চান, তখন নিশ্চিতভাবেই গুলবদন হয়ে উঠেছিলেন মুঘল ইতিহাসের জীবন্ত এক ঐতিহাসিক দলিল, যার কাছে গিয়ে আকবর মোটেও হতাশ হন নি। সম্রাট বাবর যখন ভারতে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন, তখন মাত্র ছয় বছর বয়সে ভারতবর্ষে আসেন গুলবদন বেগম। তবে ১৫৪০ সালে শেরশাহের কাছে হুমায়ূনের পরাজয় ঘটলে হুমায়ুনের সাথে তিনি কাবুলে চলে যান। হুমায়ুন তার রাজ্য পুনঃরুদ্ধার করে ভারতবর্ষে ফিরে আসলেও গুলবদন কাবুলেই থেকে যান। ১৫৫৬ সালে আকবর সম্রাট হিসেবে অভিষিক্ত হবার পর ফুপু গুলবদনকে আবারো ভারতবর্ষে নিয়ে আসেন। জীবনের বাকি সময়টুকু তিনি এখানেই কাটিয়েছিলেন। তবে এর মধ্যে সাত বছর তার কষ্টসাধ্য এক হজ্বযাত্রায় কাটাতে হয়েছিলো।
সম্রাটদের শাসনকালীন ইতিহাস লিপিবদ্ধ করার জন্য একজন রাজকীয় ঐতিহাসিক নিয়োগ করার রেওয়াজ প্রচলিত ছিলো। আকবর এ কাজের জন্য রেখেছিলেন পারস্যের ঐতিহাসিক আবুল ফজলকে, যার হাতেই রচিত হয়েছিলো ‘আকবরনামা’। তবে সম্রাট আকবর তার ফুপু গুলবদনের গল্প বলার ধরন খুব পছন্দ করতেন। তাই আকবর তাকে নিজের বাবা হুমায়ূনের জীবন নিয়ে একটি বই লিখতে অনুরোধ করেন। গুলবদন বেগম ছিলেন একজন জ্ঞানী ও বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন ধার্মিক মানুষ। তিনি ফারসি ও তুর্কি ভাষায় দক্ষ ছিলেন। প্রচুর বই পড়তেও পছন্দ করতেন। সম্ভবত এ কারণেই তিনি গল্প বলার অসাধারণ দক্ষতা রপ্ত করেছিলেন। পেছনে ফেলে আসা পুরনো দিনের স্মৃতি দিয়েই তিনি রচনা করলেন ‘আহভাল-ই-হুমায়ূন’ বা ‘হুমায়ূননামা’।
তিনি বইটিতে মুঘল প্রাসাদের প্রতিদিনের ঘটনা লিপিবদ্ধ করেন, যেটি কোনো রাজকীয় ঐতিহাসিকের পক্ষে লেখা সম্ভব ছিলো না। বাকিদের মতো যুদ্ধ ও রাজনীতির আলোচনা না করে তিনি মুঘল সমাজব্যবস্থা ও অন্দরমহলের নানা বিষয় তার লেখায় তুলে ধরেন। ‘হুমায়ূননামা’-র প্রথম অংশে তিনি সম্রাট হুমায়ূনের শাসনকাল ও পরাজয়ের পর তিনি যে নিদারুণ কষ্টের ভেতর দিয়ে গেছেন, তার বর্ণনা দেন। তার পরের অংশে তিনি মুঘল হেরেম ও এর অভ্যন্তরে নারীদের অবস্থা সম্পর্কে বিশদ ব্যাখা দেন।
বাবর যখন মারা যান, তখন গুলবদনের বয়স ছিলো মাত্র আট বছর। তাই তার বাবা সম্রাট থাকাকালের স্মৃতি তার খুব একটা মনে না থাকলেও তাকে নিয়ে শোনা ছোট ছোট কাহিনীও তিনি তার বইয়ে লিপিবদ্ধ করেছিলেন। ভাইয়ের শাসন সম্পর্কে তিনি একটি স্পষ্ট বর্ণনা দেন। ভোজন উৎসব, বিয়ে, জয়োৎসবসহ প্রাসাদের অভ্যন্তরের বিভিন্ন উৎসব সম্পর্কেও বিস্তৃত বর্ণনা পাওয়া যায় তার লেখনীতে। হুমায়ুন যখন কোনো যুদ্ধ জয় করে ফিরতেন, তখন তিনি পুরো শহর আড়ম্বরতার সাথে সাজাতেন এবং সাধারণ মানুষকে উপহার বিলিয়ে দিতেন।
তার স্মৃতিকথা থেকে আরও একটি অজানা বিষয় জানা যায়। রাজকীয় নারীদের যে অনিশ্চিত ও ভ্রাম্যমাণ জীবন, তার একটি বাস্তব চিত্র তুলে ধরেন তিনি। মুঘল সাম্রাজ্যের প্রাথমিক সময়টা যেতো নতুন নতুন রাজ্য দখলের যুদ্ধের ভেতর দিয়ে। প্রাসাদের নারীরা এ সময় এক অস্থির অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতেন। প্রিয়তম স্বামী, ছেলে কিংবা বাবা হারানোর শঙ্কা তাদেরকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তুলতো। অভিজাত হওয়া সত্ত্বেও তারা নিদারুণ দুঃখ-কষ্টের মধ্যে জীবনযাপন করতেন। কেননা যুদ্ধ ছাড়াও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব এবং এর ফলে মৃত্যু ছিলো সে সময়ের খুব সাধারণ ঘটনা।
গুলবদনের বর্ণনা অভিজাত নারীদের স্বাধীন ও মুক্ত জীবন সম্পর্কেও একটি স্পষ্ট ধারণা দেয়। নারীরা বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ নিতেন। কেউ খেলতেন পোলো, কেউ ঘোড়ায় চড়তেন, কেউ শিকার করতেন, কেউ কেউ আবার স্বামীর সাথে যুদ্ধেও অংশ নিতেন। তুলনামূলক বয়স্ক নারীরা তাদের অভিজ্ঞতার জন্য বেশ সম্মান পেতেন এবং তাদের উপদেশ খুব গুরুত্বের সাথে দেখা হতো। বিয়ের ব্যাপারে নিজেদের মতামত প্রকাশের স্বাধীনতাও ছিলো মুঘল নারীদের। হামিদা বানু যে হুমায়ূনকে বিয়ে করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন, তা আমরা গুলবদনের বর্ণনা থেকেই জানতে পাই। সম্রাট হুমায়ূনের বয়স বেশি হওয়ায় তাকে বিয়ে করতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন হামিদা বানু, যদিও শেষ পর্যন্ত প্রাসাদের নারীদের পীড়াপীড়িতে হামিদা বানু হুমায়ূনকেই বিয়ে করেছিলেন। হামিদা বানুকে গুলবদন উল্লেখ করেছেন একজন মিষ্টি ও কিছুটা অপ্রস্তুত মেয়ে হিসেবে, যার এই জগৎ সম্পর্কে স্বতন্ত্র একটি ধারণা আছে।
গুলবদনের লেখনী ছিলো অন্যান্য লেখকদের থেকে আলাদা। তিনি সহজ-সাবলীল ফারসি ভাষা ব্যবহার করতেন এবং কোনো ভণিতা ছাড়াই মূল কথায় ঢুকে যেতেন। অনেকটা তার বাবা বাবরের ‘বাবরনামা’-র লেখার ঢং ফুটে উঠতো তার বর্ণনায়। তিনি মুঘল অভিজাততন্ত্রকে প্রকৃত ও বৈচিত্র্যময়ভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি যুদ্ধ ও রক্তপাত পছন্দ করতেন না। ফলে তার লেখায় মুঘল শাসকদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গিই বেশি ফুটে উঠেছে।
“এই স্মৃতিকথাটি খুব সহজ ভাষায় লেখা হয়েছে এবং ঘটনাগুলোর বর্ণনা দেয়া হয়েছে খুব সংক্ষেপে। তিনি মুঘল পারিবারিক ইতিহাসকে এমনভাবে তুলে ধরেছেন, যা গতানুগতিক ঐতিহাসিকদের লেখাতে দেখা যায় না। এই স্মৃতিকথাটি ছিলো তার সময়ের ইতিহাসের একটি নারীবাদী প্রচেষ্টা, যেটি যুদ্ধ ও রাজনীতির বাইরে গিয়ে সমাজ ও সংস্কৃতিকে প্রতিনিধিত্ব করেছিলো।” –ডউন, সানডে ম্যাগাজিন, ২৭ মার্চ, ২০১৬।
দুর্ভাগ্যবশত গুলবদনের লেখা ঐতিহাসিক এই বইটি হারিয়ে গিয়েছিলো। শতাব্দীব্যাপী এই বইটির কোনো হদিস খুঁজে পাওয়া যায় নি। পরবর্তীতে কর্নেল হ্যামিল্টন নামের একজন ব্রিটিশ কালেক্টর বইটি খুঁজে পেয়েছিলেন। ভদ্রলোকের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী কিছু পুরনো ভারতীয় পাণ্ডুলিপির সাথে এই বইটিও বিক্রি করে দেন। ১৮৬৮ সালে ‘হুমায়ূননামা’ ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে আসে। কিন্তু এর পরও বহু বছর কেউ খেয়ালই করেন নি যে, বইটি এই লাইব্রেরিতেই আছে।
লাইব্রেরিতে যখন ‘হুমায়ূননামা’ পাওয়া যায়, তখন তার অনেক অংশই ছিলো ছেঁড়া, কিছু পৃষ্ঠা হারিয়েও গিয়েছিলো; বিশেষ করে হুমায়ূনের অকস্মাৎ মৃত্যুর পর আর কোনো ব্যাখ্যা মেলে না বইটিতে। ধারণা করা হয়, সমকালীন অন্যান্য ইতিহাসের বইয়ের তুলনায় গুলবদনের লেখা এই বইটিকে খুব একটা গুরুত্বের সাথে নেয়া হয় নি; অযত্ন ও সংরক্ষণে অবহেলার কারণে বইয়ের পৃষ্ঠা হারিয়ে গিয়েছিলো। এমনকি জানা যায়, সম্রাট আকবরও একে ততোটা গুরুত্ব দেন নি। তিনি তার ফুপুর কাছে শুধু কিছু স্মৃতিচারণ চেয়েছিলেন, যেনো তিনি তা নিজের আত্মজীবনীতে উল্লেখ করতে পারেন। অনেকে মনে করেন, গুলবদন কিছু কবিতাও লিখেছিলেন এতে, যার একটিও পাওয়া যায় নি। এতো গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক দলিলের প্রতি এমন অবহেলা ছিলো ভীষণ অপ্রত্যাশিত ও দুঃখজনক। ১৯০১ সালে ব্রিটিশ প্রাচ্যবিদ অ্যানেট সুজানাহ বেভারিজকে এই স্মৃতিকথাটি অনুবাদের দায়িত্ব দেয়া হয়।
এটা তো স্পষ্টই যে, নারীদেরকে ইতিহাস থেকে ইচ্ছাকৃতভাবেই বাদ দেয়া হয়েছে। তাদের সাফল্য ও প্রতিভাকে পুরুষের শ্রেষ্ঠত্বের আড়ালে ঢেকে দেয়া হয়েছে। তবে সত্যিটা হলো, ইতিহাসের নানা বাঁকে নারীদের অবদান অস্বীকার করবার কোনো উপায়ই নেই। মহারাষ্ট্রের প্রাক্তন ইতিহাসবিদ, প্রত্নতাত্ত্বিক ও মুদ্রাবিশারদ অনন্ত সদাশিব আলতেকার লিখেছেন, “একটি সভ্যতার চেতনা এবং এর মহিমা ও সীমাবদ্ধতা বুঝতে হলে সেই সভ্যতায় নারীদের মর্যাদা ও অবস্থান কেমন ছিলো, তা আগে জানতে হবে”।
রেফারেন্স:
- ‘লাইফ অ্যান্ড রাইটিংস অফ গুলবদন বেগম (লেডি রোজবডি)’ –অ্যানেট সুজানাহ বেভারিজ