বাংলায় স্বাধীন সুলতানি আমলের শুরুটা নিঃসন্দেহে এক গৌরবময় অধ্যায় ছিলো। দিল্লির অধীনস্থতা থেকে বাংলায় আলাদাভাবে ইলিয়াস শাহী বংশের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সুলতানি আমলের সূচনা করেছিলেন সুলতান ইলিয়াস শাহ। তবে এই ইলিয়াস শাহী বংশের পতন এবং এর ঠিক পরবর্তী শাসনকাল নিয়ে বাঙালিরা প্রায়ই লজ্জায় ভুগে থাকেন। হিন্দু-মুসলমান তথা সব সম্প্রদায়ের বাঙালি শাসকদের জন্যই এই সময়কালটি বাংলার অন্ধকার যুগের সামিল।
১৪৮৭ সালে সুলতান জালাল উদ্দিন ফতেহ এর হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে ইলিয়াস শাহী বংশের সমাপ্তি ঘটেছিলো এবং সুলতানের এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিলো তারই এক সেনাপতির হাতে, যিনি ছিলেন মূলত হাবশী গোষ্ঠীভুক্ত ব্যক্তি। আর এর ঠিক পরপরই বাংলার ক্ষমতা চলে গিয়েছিল হাবশীদের অধীনে। ১৮৮৭ সাল থেকে ১৮৯৩ সাল পর্যন্ত প্রায় ৬ বছর মোট চার জন হাবশী শাসকের অধীনে শাসিত হয়েছিলো বাংলা। সুদূর পূর্ব আফ্রিকা থেকে আসা এই জনগোষ্ঠী মূলত ক্রীতদাস হয়েই ভারতবর্ষে এসেছিলেন এক সময়। এ কারণেই হাবশীদের ক্ষমতায়নকে লজ্জাজনক এক পর্যায় ভেবেই আড়াল করে রাখতে চেয়েছেন অধিকাংশ বাঙালি শাসক।
কারা এই হাবশী? কি করেই বা বাংলা তথা ভারতবর্ষে এলেন তারা? আর কি করেই বা এতো ক্ষমতাধর হয়ে উঠলেন? পূর্ব আফ্রিকার আবিসিনিয়া (বর্তমানে যেটি ইথিওপিয়া) থেকে ইসলামিক যুগের আবির্ভাবের আগেই আরবীয় ব্যবসায়ীরা ক্রীতদাস কেনা-বেচা করতেন। সে সময় ভারতবর্ষ ছিলো ভীষণ সমৃদ্ধ ও বাণিজ্যিকভাবে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ। সে হিসেবে ভারতবর্ষের সাথে প্রায় প্রত্যেক দূরবর্তী অঞ্চলেরই বাণিজ্যিক যোগাযোগ বিদ্যমান ছিলো। আরবের ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে প্রচুর পরিমাণে হাবশী ক্রীতদাসদেরকে ভারতবর্ষে নিয়ে আসা হতো। কালো বর্ণের এই পূর্ব আফ্রিকান জনগোষ্ঠী প্রচন্ড শক্তিশালী ও পরিশ্রমী ছিলো বিধায় হাবশী ক্রীতদাস আদান-প্রদানের এই ব্যবসা দিনে দিনে অত্যন্ত জমজমাট হয়ে উঠছিলো। তবে পরবর্তীতে শুধু ক্রীতদাস হিসেবেই নয়, ভাড়াটে সৈন্য হিসেবে এবং ব্যবসায়ী হিসেবেও হাবশীদের আগমন ঘটেছিলো ভারতবর্ষে।
হাবশীদের ক্ষমতায়নের শুরুটা হয়েছিলো ইলিয়াস শাহী সুলতান রুকনউদ্দীন বার্বক শাহের উদারতায়। এ ক্ষেত্রে তিনি দূরদর্শিতা প্রদর্শনে ব্যর্থ হয়েছিলেন। হাবশী সেবকদেরকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন করেছিলেন তিনি। সেনাবাহিনীতেও শক্তিশালী হাবশীদের গুরুত্ব ছিলো অত্যাধিক। হাবশীদের যোগ্যতায় মুগ্ধ হয়ে ভারতবর্ষের শাসকেরা বিভিন্ন সময় তাদেরকে ক্ষমতাসীন আসনে বসিয়েছিলেন, যার মূল্যও তাদেরকে দিতে হয়েছিলো পরবর্তীতে।
ইতিপূর্বে তেরো শতকের সুলতান শামসুদ্দিন ইলতুতমিশের মেয়ে রাজিয়া সুলতানার সময়কালেও তার হাবশী সেবক জামাল উদ্দীন ইয়াকুত এর ক্ষমতায়নের কাহিনীটি বহুল আলোচিত হয়েছিলো। সামান্য একজন ক্রীতদাস থেকে সুলতানার উদারতায় জামাল উদ্দীন ইয়াকুত পরিণত হয়েছিলেন একজন অভিজাত ব্যক্তিতে। কথিত আছে, সুলতানা তার পরামর্শ ছাড়া কখনোই কোনো সিদ্ধান্ত নিতেন না। ‘আমীর-উল-উমারা’-র মর্যাদা দিয়েছিলেন তিনি জামাল উদ্দীন ইয়াকুতকে।
হাবশীদের ক্ষমতায়নের এই ধারাবাহিকতা চলমান ছিলো প্রায় সপ্তদশ শতক পর্যন্ত। ইলিয়াস শাহী সালতানাতের শেষ সুলতান জালাল উদ্দিন ফতেহ এক পর্যায়ে উপলব্ধি করেছিলেন হাবশীদের এই শক্তি বৃদ্ধির আকস্মিকতা ও ভয়াবহতা। তিনি এদের ক্ষমতায়নকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য বিভিন্ন রকম উদ্যোগ নিতেও শুরু করেছিলেন। এরই ফলাফলস্বরূপ নিজের হাবশী প্রাসাদরক্ষী গিয়াসউদ্দীন বার্বক শাহ এর হাতে নিহত হন সুলতান জালাল উদ্দিন ফতেহ। এই ঘটনার মাধ্যমেই ১৪৮৭ সালে ইলিয়াস শাহী বংশের সমাপ্তি ঘটে এবং গিয়াসউদ্দীন বার্বক শাহ ভারতবর্ষে তথা বাংলায় হাবশী সালতানাতের সূচনা করেন।
তবে হঠাৎ ক্ষমতাপ্রাপ্তি হাবশী সালতানাতের শাসকদেরকে লোভী, বিবেকহীন ও বিশৃঙ্খল করে তুলেছিলো। এ কারণে হাবশী সালতানাত বেশি দিন স্থায়ী হয় নি। ছয় বছরের মাথায় ১৪৯৩ সালে পতন ঘটে বাংলায় হাবশী শাসনের। তবে হাবশীরা এই উপমহাদেশে এর পরও প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করে গেছে বহু বছর।
ভারতবর্ষের কৃষ্ণাঙ্গ নায়ক মালিক অম্বর এর কথা তো উল্লেখ না করলেই নয়। হ্যাঁ যোগ্যতাসম্পন্ন ও মেধাবী এই ব্যক্তিও ছিলেন হাবশী গোষ্ঠীভুক্ত। সামান্য ক্রীতদাস থেকে তিনি পরিণত হয়েছিলেন উপমহাদেশের কিং-মেকারে। তিনি শাসক তৈরী করতেন এবং পরোক্ষভাবে নিজেই তাদেরকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতাও অর্জন করেছিলেন। তিনি ছিলেন মুঘলদের সবচেয়ে বড় ভীতি। তার জীবদ্দশায় দক্ষিণ ভারতবর্ষকে মুঘলরা কোনো দিনও অধিকার করতে পারেন নি। তার বিশাল সেনাবাহিনীর কাছে মুঘল সেনাবাহিনী ছিলো নিতান্তই তুচ্ছ।
‘হাবশী’ মূলত ছিলো আরবদের দেয়া নাম। তবে কৃষ্ণাঙ্গ এই গোষ্ঠীর সম্মান রক্ষার্থে পরবর্তীতে তাদেরকে ‘সিদি’, ‘সিদ্দি’, ‘সাঈদ’, ‘আফ্রো-ইন্ডিয়ান’, ‘জানজি’ বা ‘জিনজি’ প্রভৃতি বিভিন্ন নাম দেয়া হয়েছিলো।
ভারতবর্ষের দক্ষিণ-পশ্চিমে কোনকান উপকূলের একটি দ্বীপ জানজিরায় এই হাবশী বা সিদিরা গড়ে তুলেছিলেন নিজেদের ‘সিদি সাম্রাজ্য’, যা ১৯৪৭ সালে দেশভাগের আগ পর্যন্ত স্বাধীনভাবে বহাল ছিলো। বাইরের পরাশক্তির আক্রমণ ঠেকাতে জানজিরায় হাবশীরা নির্মাণ করেছিলেন শক্তিশালী ‘জানজিরা মেহরুব দুর্গ’। এই দুর্গের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলে ডান দিকের দেয়ালে চোখে পড়বে খোদাই করা একটি চমৎকার বাঘের ভাস্কর্য, যার চার পায়ের থাবায় রয়েছে চারটি হাতি। এই ভাস্কর্যটি হাবশীদের অসাধারণ শক্তি ও ক্ষমতাকেই প্রতীকায়িত করে।
ভারতবর্ষের ইতিহাসে হাবশীদের বেশ অবদান রয়েছে। যুদ্ধক্ষেত্রে তো অবশ্যই, তা ছাড়াও স্থাপনা নির্মাণের ক্ষেত্রেও হাবশীরা অনন্য যোগ্যতার পরিচয় দিয়ে গিয়েছেন। আহমেদাবাদ শহরের এমনই একটি স্থাপনা প্রায় ৬০০ বছরের পুরনো ‘সিদি সাঈদ মসজিদ’। এই মসজিদে অসংখ্য সূক্ষ্ম কারুকাজযুক্ত জালি রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে চমৎকার-দর্শন এক বিশেষ জালি। এই জালিটি মূলত বেহেশতে জন্মানো জীবন-বৃক্ষকে প্রতীকায়িত করে। এ ছাড়াও আওরঙ্গবাদ শহরে মালিক অম্বর এর নির্মিত জামে মসজিদ এবং সমাধিসৌধও ভারতবর্ষের অনন্যসাধারণ স্থাপনাগুলোর মধ্যে অন্যতম।
ভারতবর্ষে আসা হাবশীদের মধ্যে অধিকাংশই এখানে স্থায়ী হয়েছিলেন। তারা উপমহাদেশেই নিজেদের পরিবার গড়েছিলেন এবং নিজেদেরকে ভারতবর্ষেরই এক অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করেছিলেন। আজও বর্তমান ভারতের হায়দ্রাবাদ, গুজরাট, কর্ণাটক এবং পাকিস্তানের মাকরান ও করাচিতে প্রায় ২০ হাজারেরও বেশি হাবশী জনগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে। এ ছাড়াও দক্ষিণ এশিয়ার শ্রীলংকা, মালদ্বীপসহ আরও বিভিন্ন দেশগুলোতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে হাবশীদের স্থায়ী আবাস।
রেফারেন্সঃ
- ভারতবর্ষের কৃষ্ণাঙ্গ নায়কঃ মালিক অম্বর
- ভারতবর্ষে সিদি-হাবশিদের আগমন
- জানজিরা: সিদিদের স্বাধীন রাজ্য
- সিদি সাইয়্যিদ জালি
- হাবশি ক্রীতদাস থেকে দিল্লির ‘আমির উল উমারা’
- হাবশি