পার্সিরা মারা গেলে তাঁদের দেহ রেখে আসা হয় টাওয়ার অফ সাইলেন্সে৷ শবভোজী পাখিরা ছিঁড়ে খায়৷ অদ্ভুত রীতি এই অন্ত্যেষ্টির৷

জরথুস্ত্রবাদীরা মৃতদেহকে অপবিত্র মনে করেন। তাঁরা, পাহাড় চুড়ায় একটি বড়সড় আধার নির্মান করে সেই আধারের মাঝে পাথর বসিয়ে তার উপর বস্ত্রহীন মৃতদেহ রেখে আসেন। পাহাড় চুড়ার এই আধারটিকে ‘টাওয়ার অব সাইলেন্স’ বলা হয়। পার্সিদের এই স্তম্ভ , ‘টাওয়ার অফ সাইলেন্সকে‘ হিন্দিতে বলে ‘চিল ঘর’ আর পার্সিরা ডাকে ‘দাখমা’। সৈয়দ মুজতবা আলী এর নাম দিয়েছিলেন মৌন শিখর।
যেসব জায়গায় পার্সিদের বসতি রয়েছে, সেখানে লোকালয় থেকে কিছু দূরে পাহাড় চূড়া বা বনে তারা একটা স্তম্ভ বানায়। কেউ মারা গেলে পার্সিরা সেই স্তম্ভের ওপরে মৃতদেহ রেখে আসে। নিমেষে তা শকুনের খাদ্যে পরিণত হয়- টাওয়ারে শুধু কঙ্কাল পড়ে থাকে। তৃতীয় দিনে হাড়গোড়গুলো সংগ্রহ করে অন্যত্র কয়লা ও বালির মিশ্রনের মধ্যে রেখে দেওয়া হয়। মনে করা হয়, এই পদ্ধতি অবলম্বন করলে ভূমি বা বায়ু দুষিত হবেনা। পারসীক ধর্মে পরিবেশ দুষণকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। মানুষ মরলে সাধারণভাবে কবরে সমাহিত করা হয় বা পোড়ানো হয়। এই কাজে আগুন ও মাটির সম্পর্ক রয়েছে ,কিন্তু মাটি, পানি, আগুন এগুলো জোরোয়াস্ট্রিয়ান পার্সিদের কাছে অতি পবিত্র। তাই নাপাক দেহের সৎকারে এগুলোর ব্যবহার পার্সিদের জন্য নিষিদ্ধ। এ থেকে পরিত্রাণে তারা এক অভিনব পদ্ধতি বের করেছিলো। কি আশ্চর্য! তাই না? এই কারণে বলা যায় যে মৌন শিখর জায়গাটা যদিও তথাকথিত ভাবে অন্ত্যেষ্টিস্থল ,তবে সেখানে সৎকারও হয় না, মৃতদেহ কবরও দেওয়া হয় না৷ বরং মৃতদেহ খোলা আকাশের নিচে রেখে যাওয়া হয়৷ যাতে শকুন ছিঁড়ে খেতে পারে সেই দেহ৷ ভেবেই শিউরে উঠছেন? কিন্তু এমনটাই নিয়ম পার্সিদের সৎকারের৷ মৃতদেহকে জগতে উৎসর্গ করা৷ মারা যাওয়ার পরও পৃথিবীর খানিক উপকারে নিজেদের নিয়োগ করা৷ মনে করা হয়, এই পদ্ধতি অবলম্বন করলে ভূমি বা বায়ু দুষিত হবেনা। পরিবেশবিদরা কিন্তু এই পদ্ধতির বিরুদ্ধে কথা বলেন নি l তাদের মতে এর মাধ্যমে মাংশভোজি প্রাণী তার খাবার পাচ্ছে আর মৃতদেহ সৎকারে বনের কাঠের অপচয় হচ্ছে না|
শোনা যায় এই টাওয়ার অফ সাইলেন্সে মানুষের যাতায়াত একেবারেই নেই বললেই চলে৷ কেবল মৃতদেহ রাখতেই পার্সি পরিবারগুলি হাজির হয় এখানে| মৃতদেহ পৃথিবীকে উৎসর্গ করেই সেখান থেকে ফিরে যান মৃতদের পরিবারের লোকজন৷ শোনা যায়, দিনের বেলাতেও এত চুপচাপ থাকে এই টাওয়ার যে পিন ফেললে পর্যন্ত আওয়াজ হয়৷ দিনের বেলাতেও মৃতদের ডেরায় একা যাওয়ার সাহস পাওয়া যায় না মানুষ|
ভাবতে পারেন এমন এক দুর্গের সন্ধান আজ আপনি পেলেন, যার ছাদে রয়েছে মৃতদেহের সারি! যা খাচ্ছে শকুনে!
আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতেও পার্সিদের সৎকার স্থান রয়েছে৷ মৃতদেহ সৎকারের জন্য মুম্বাইতে ৫৭ একর অরণ্য-উদ্যানের মাঝে একস্থানে একটি বিরাটাকার ‘ডখমা’ বা টাওয়ার নির্মান করা হয়েছে। মালাবার পাহাড়ের কাছে এই টাওয়ার অফ সাইলেন্স কেবল জানান দেয় অগুনতি মৃতদেহের অবস্থানের৷ মুম্বইয়ের মতো জনবহুল শহরেও এমন মৃতদের ডেরার কথা জানলে চমকে উঠতে হয় বৈকি! এ ছাড়াও কলকাতার বেলেঘাটা অঞ্চলে রয়েছে ডখমা l জঙ্গলের মধ্যে দখমা তৈরির কাজ শুরু হয় ১৮২২ সালে। মূল উদ্যোক্তা ছিলেন নওরোজি। পূর্ব এশিয়ায় এটাই পার্সিদের প্রথম শেষকৃত্যভূমি। রেঙ্গুন, সিঙ্গাপুর, মালয় থেকেও মৃতদেহ বয়ে আনা হত বহুদিন। এখন আর সেই প্রথা নেই বললেই চলে। পার্সিরাও অনেকে বিকল্প সৎকারের ব্যবস্থা করছেন।
কারা এই পার্সি সম্প্রদায় ? বিশ্বের সবচেয়ে বিত্তশালী সম্প্রদায়ের একটি এই পর্সিরা।পুরো পৃথিবীজুড়ে মাত্র এক লাখ অনুসারী এই ধর্মের।এর মধ্যে পঞ্চাশ হাজার ই বাস করে ভারতে।মূলত তাদের ধর্মের নাম জরথুষ্ট ও তাদের ধর্মগ্রন্থর নাম জেন্দাবেস্তা। তারা অগ্নিপূজক, আগুনকে তারা পরম সত্য ও পবিত্র বলে মনে করে।এই ধর্ম প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছরের পুরোনো। মহাপরাক্রমশালী পারস্য সাম্রাজ্যের ঐতিহ্য ও গর্বের প্রতীক ছিল এই ধর্ম।তবে এখন পুরো ইরান খুঁজলে হাতেগোনা অনুসারী পাওয়া যাবে এ ধর্মের।বলা হয়ে থাকে, পারস্যে ইসলাম প্রবেশের পর নিজ ধর্ম রক্ষা করতে দেশত্যাগী হয়েছিলেন পার্সিরা৷ পালতোলা কাঠের জাহাজে চড়ে তাঁরা এসে পৌঁছান ভারতের পশ্চিম উপকূলে৷

ধর্মরক্ষা করতে দেশত্যাগী হয়েছিলেন পার্সিরা৷ পালতোলা কাঠের জাহাজে চড়ে তাঁরা এসে পৌঁছান ভারতের পশ্চিম উপকূলে৷