প্রাচীন কালের বহু গল্প আজও ইতিহাসের পাতায় গৌরবের সাথে টিকে আছে। তার মধ্যেই হিট্টাইটদের কাহিনি যেন যুদ্ধ, ভয় আর কৌশলের জটিল এক মহাকাব্য। ব্রোঞ্জ যুগের সেই সময়ে, খ্রিস্টপূর্ব ১৫৫০ থেকে ১২০০ সালের মধ্যে, আনাতোলিয়ার (আজকের তুরস্কের কেন্দ্রভাগ) এক ইন্দো-ইউরোপীয় জাতি ধীরে ধীরে গড়ে তোলে বিশাল এক সাম্রাজ্য। এই হিট্টাইটরা সীমান্ত পেরিয়ে দখল করে নেয় আনাতোলিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল, উত্তর লেভান্ট, এমনকি শক্তিশালী মিতান্নি রাজ্যকেও তারা পরাস্ত করে। তাদের সাফল্যের মূলে ছিল যুদ্ধ সংস্কৃতি, দেবতার আশীর্বাদে প্রতি বিশ্বাস, প্রযুক্তিতে উদ্ভাবন আর অসাধারণ সামরিক কৌশল। তাদের গল্পই বলব আজ।

হিট্টাইট সাম্রাজ্য এর ম্যাপ © warlordgames.com
হিট্টাইটরা বহুদেবতাবাদে বিশ্বাস করত—অনেকটা মেসোপটেমিয়া কিংবা হুরিয়ানদের মতো। তবে তাদের দেবসভায় সবচেয়ে শক্তিশালী ছিলেন ঝড় ও যুদ্ধের দেবতা “তারহুনা”। তিনি আবহাওয়া, উর্বরতা এবং যুদ্ধের নিয়ন্তা হিসেবে তিনি পূজিত হতেন। যোদ্ধাদের অন্তরে সাহস জাগাতেন তিনি। হিট্টাইটরা বিশ্বাস করত, যুদ্ধের উদ্দেশ্য কেবল সম্পদ সংগ্রহ, ভূমিবৃদ্ধি বা মর্যাদার জন্য নয়—এটি দেবতার সন্তুষ্টির জন্যও। তাই যুদ্ধ ছিল তাদের কাছে ধর্মীয় বিশ্বাসের অংশ।
হিট্টাইট সম্রাটদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সুপিলুলিউমা। তিনি মিতান্নি সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে অভিযান চালান। প্রথমে ব্যর্থ হলেও হিট্টাইট কৌশলের অনন্য দিক—শত্রুর পেছন দিক থেকে আক্রমণ বা ফ্ল্যাঙ্কিং কৌশল—ব্যবহার করে তিনি দখল করেন রাজধানী ওয়াশশুক্কান্নি। এই আঘাতে মিতান্নি রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ে। ঐ দিকে তাদের রাজা তুশরাত্তা নিজ লোকের হাতে নিহত হন। পরবর্তীতে সুপিলুলিউমা সেই রাজার ছেলেকে রাজা হিসেবে নির্বাচিত করেন। তবে ছেলের কাছে তার শর্ত ছিল একটাই—সে ঝড়ের দেবতার কাছে আনুগত্যের শপথ করানো।
হিট্টাইটদের সামরিক শক্তির প্রাণকেন্দ্র ছিল তাদের যুদ্ধরথ। মিশরীয়দের মতো তারাও রথ ব্যবহার করত, কিন্তু হিট্টাইট রথ ছিল কিছুটা ভিন্ন ধাঁচের। মিশরীয় রথ ছিল হালকা ও দ্রুতগামী, সেখানে দু’জন মানুষ বসত—একজন চালক ও একজন ধনুকধারী। কিন্তু হিট্টাইট রথ ছিল বেশ ভারী; অক্ষটি মাঝখানে লাগানো থাকায় এতে তিনজন উঠতে পারত—চালক, ঢালবাহক ও বর্শা নিক্ষেপকারী। ফলে এরা ধীরগতির হলেও একসাথে তীব্র আঘাত হানতে পারত।
তাদের পদাতিক বাহিনীও কম শক্তিশালী ছিল না। যুদ্ধক্ষেত্রে ব্রোঞ্জের অস্ত্র ও বর্ম ছিল প্রধান, তবে তারা লোহার ব্যবহারে প্রাথমিক দিকেই এগিয়ে ছিল। যদিও তাদের মধ্যে লোহার অস্ত্র ব্যাপকভাবে ব্যবহারের প্রমাণ মেলে না, তবুও স্থানীয়ভাবে তা কাজে লাগানো হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। পদাতিক সৈন্যরা সাধারণত লম্বা বর্শা নিয়ে ফ্যালানক্স ফর্মেশনে যুদ্ধ করত, আর কাছাকাছি এলে তলোয়ার বা ছুরি ব্যবহার করত। ধনুকধারীও ছিল, তবে তাদের ধনুক ছিল সাধারণ কাঠের—যৌগিক ধনুক নয়।
তাদের যুদ্ধ কৌশলের সবচেয়ে বিখ্যাত উদাহরণ হলো কাদেশের যুদ্ধ। খ্রিস্টপূর্ব ১২৭৪ সালে লেভান্টের কাদেশ নগরের কাছে এই যুদ্ধ হয়েছিল মিশরীয় ফারাও রামেসিস দ্বিতীয় ও হিট্টাইট রাজা মুয়াতাল্লি দ্বিতীয়ের মধ্যে। উভয়েই চেয়েছিল লেভান্টের নিয়ন্ত্রণ নিতে। যুদ্ধ এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে মিশরীয়রা তাদের মন্দিরের দেয়ালে ছয়টি সংস্করণে এই যুদ্ধ উৎকীর্ণ করে রেখেছিল। এমনকি রামেসিস ও হিট্টাইট রাজা হাট্টুসিলির মধ্যে পাওয়া চিঠিপত্রেও যুদ্ধের উল্লেখ আছে। এটি ম্যারাথনের যুদ্ধের আগ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি নথিভুক্ত প্রাচীন যুদ্ধ।

কাদেশের যুদ্ধ
ইতিহাসবিদরা বলেন, মিশরীয় সেনার সংখ্যা ছিল প্রায় ৩০,০০০ থেকে ৪০,০০০, আর হিট্টাইটদের সৈন্য ছিল ২০,০০০-এরও বেশি। তাদের সাথে যুক্ত ছিল বহু ভাসাল বা করদ রাষ্ট্রের সৈন্য—উগারিত, কাদেশ, দারদানিয়া প্রভৃতি। হিট্টাইটরা যুদ্ধ শুরু করেছিল বিশাল রথবাহিনী দিয়ে—মিশরীয় সূত্র মতে একসাথে ২,৫০০টি রথ আক্রমণ চালায়, অর্থাৎ প্রায় ৭,৫০০ সৈন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে।
যুদ্ধ শেষে মিশরীয়রা দাবি করে তারা জয়ী হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে কৌশলগত সুবিধা পেয়েছিল হিট্টাইটরা। মিশরীয়রা অঞ্চল দখল করতে পারেনি। আর শেষে উভয় পক্ষ মিলে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করে। এটি ইতিহাসের প্রাচীনতম পরিচিত শান্তিচুক্তিগুলির একটি।
তবে খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ সালের দিকে ভয়ংকর “সি পিপলের” আক্রমণে হিট্টাইট সাম্রাজ্য ধ্বংস হয়ে যায়। তারা হারিয়ে গেলেও রেখে যায় এক অনন্য উত্তরাধিকার—যেখানে দেবতার ভক্তি তাদের যুদ্ধের প্রেরণা জুগিয়েছে, আর প্রযুক্তি ও কৌশল এনে দিয়েছে সামরিক সাফল্য।
হিট্টাইটদের গল্প আজও ইতিহাসে বেঁচে আছে—ধর্ম, ভয়, শক্তি আর কৌশলের মিশেলে তারা দেখিয়েছিল, কীভাবে এক যোদ্ধাজাতি ব্রোঞ্জ যুগে সাম্রাজ্য গড়ে তোলে।

