ঢাকার দোয়েল চত্বরে যে প্রাণহীন সিমেন্টের দুটি দোয়েল দাঁড়িয়ে রয়েছে, সেখানে এক সময় জীবিত মানুষদেরকে বিক্রির উদ্দেশ্যে দাঁড়া করিয়ে রাখা হতো। তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হতো তাদের মা-বাবা, পরিবার পরিজন থেকে দূরে; সুমাত্রা, আফগানিস্তান, সিরিয়া আরও অনেক দূর-দূরান্তের দেশে। হয়তো ঐ সমস্ত ক্রীতদাসদের বংশধর আজও বেঁচে আছে, তারা জানে না এবং জানা সম্ভবও না তাদের পিতা, পিতামহ, প্রপিতামহের আদি দেশ কোথায়।

 প্রায় সাড়ে ৫০০ বছরের পুরোনো আমাদের এই রাজধানী ঢাকা। সেই মধ্যযুগ থেকে আজ পর্যন্ত কত যে ঐতিহ্য, কত যে ইতিহাস, কত না জানা রহস্য যে আমাদের এই ঢাকাকে ঘিরে আছে তা জানা নেই। একে তো বড় শহর তার উপর মোঘল আমলে রাজধানী শহর হওয়াতে ব্যবসা বাণিজ্যের দ্বার ছিল উন্মুক্ত আর জিনিস পত্রের দামও ছিল কম। সেই সাথে সাথে জনসংখ্যাও বৃদ্ধি পেতে থাকে। আর এই জনসংখ্যার প্রয়োজন মেটাতে দাসের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। আজ এই দাস নিয়েই গল্প করবো।

ইতিহাস থেকে আমরা মধ্যযুগে ঢাকায় দাস বিক্রির কথা জেনেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলা একাডেমিতে বিভিন্ন কাগজপত্র ঘেটে ইংরেজ আমলের কিছু কাগজপত্র থেকেও এর সম্পর্কে সম্বন্ধে প্রমাণ পাওয়া যায়। জানা যায়, এমনি দাস বিক্রির একটি বাজার ছিল এই ঢাকাতেই, যা নাখখাস বা প্রাচীন দাসবাজার নামে পরিচিত ছিল।
ঢাকার মধ্যে যেসব অলি-গলি মধ্যযুগে ছিল, তার বেশিরভাগেরই অস্তিত্ব আজ আর নেই। যেমন এই নাখখাস বাজার। বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দোয়েল চত্বরে ছিল এই বাজার। এর পাশে ছিল ঢাকা গেট, যা এক সময় পুরোনো ঢাকার সীমানা ফলক ছিল। এই জায়গাতে দাস বেচা-কেনা হতো বলে, বাজারের নাম পুরানা নাখখাস রাখা হয়েছিল।
 
নাখখাস শব্দটি একটি ফার্সি শব্দ থেকে এসেছে, যার অর্থ দাস বিক্রির বাজার। সেই যুগে দাস বেচা কেনা ছিল খুবই সাধারণ একটি ব্যাপার। বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা তার ভ্রমণ কাহিনীতে বাংলায় দাস বেচা – কেনার কথা উল্লেখ করেছেন। সেখানে দেশী – বিদেশী অনেকেই এই দাস কেনা ও বেচার সাথে যুক্ত ছিল।
এই বাজার বিলুপ্ত হয়ে গেলেও আমাদের স্মৃতি আজও তা ধারণ করে আছে। দাস বিক্রির সেই জায়গায় বাংলাদেশের জাতীয় পাখি দোয়েল দাঁড়িয়ে আছে স্বাধীন দেশের প্রতীক হয়ে। পুরানা নাখখাস -এর মতো মধ্যযুগের ইতিহাসের সব কালো অধ্যায় আজও আমাদের বিবেককে নাড়া দেয়। আজও আমাদের দেশের শ্রমিক বিদেশে গিয়ে যে অমানবিক পরিশ্রম করে, একজন দাসের মতো জীবন যাপন করে, তাদের এই কষ্টের জীবন থেকে তারা মুক্তি পাক।