Vasco-da-Gama

ভাস্কো-ডা-গামা ছিলেন একজন পর্তুগিজ সমুদ্রগামী অভিযাত্রী যিনি ইউরোপ থেকে ভারতবর্ষে যাবার সমুদ্রপথ আবিষ্কার করেন। তিনিই প্ৰথম ইউরোপীয় ব্যক্তি যিনি সম্পূৰ্ণ সাগর পথ পাড়ি দিয়ে ভারতে আসেন। তার ভ্ৰমণে এশিয়া এবং ইউরোপকে সংযোগ করার সাথে সাথে আটলান্টিক মহাসাগর এবং ভারত মহাসাগরকে সংযোগ করেছিলেন এবং পশ্চিমা সংস্কৃতির সাথে পাশ্চাত্য দুনিয়ার সেতুবন্ধন গড়ে তোলেন।

ভাস্কো ডা গামার এই আবিষ্কার বিশ্বের সাম্ৰাজ্যবাদের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ন হয়ে উঠে। এরপরেই ভাস্কো দা গামা ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী উচ্চাকাঙ্ক্ষার এক নতুন যুগের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন, যার ভিত্তি শুধুই বাণিজ্য ছিলনা ধর্ম ও ছিলো। তার এই আবিষ্কার বিশ্বের সাম্ৰাজ্যবাদের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ছিল কারণ এই ভ্ৰমণের মধ্য দিয়েই পর্তুগীজদের এশিয়া মহাদেশে দীৰ্ঘকসময় উপনিবেশ তৈরির পথ সুগম হয়েছিল৷ তার আবিষ্কার করা পথটি ভূমধ্যসাগর এবং বিপদজনক আরব উপদ্বীপ পার হতে লাগতোনা, কারণ সম্পূর্ন পথটিই ছিল সাগর পথে৷।

ভাস্কো ডা গামার জন্মের সাল নিয়ে বিতর্ক আছে । তিনি জন্মেছিলেন পর্তুগালের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে সিনেস নামে একটি জায়গায় ১৪৬০ কিংবা ১৪৬৯ সালে। সিনেস, আলেনতেজো উপকূলের হাতে গোনা কয়েকটি সমুদ্র বন্দরের একটিতে অবস্থিত। কাছেই একটি গির্জা ছিলো যেখানে থেকে অনবরত ঘন্টাধ্বনি ভেসে আসতো।

তার বাবার নাম ছিলো এস্তেভাঁও ডা গামা।তার বাবা ১৪৬০ সালে নাইট(Knight) হিসাবে কাজ করতেন, তারপর তিনি অৰ্ডার অব সান্টিয়াগোর সামরিক পদমৰ্যাদা পান৷ ১৪৬০ সাল থেকে ১৪৭৮ সাল পর্যন্ত তিনি সিনেসের গভর্নর ছিলেন, এবং খাজনা গ্রহন করতেন। মা ইসাবেল চড্ৰে যিনি ইংরেজ বংশের অভিজাত পরিবারের মেয়ে ছিলেন, বাবার নাম ছিল জোয়াও চড্রে । এস্তেভাঁও ডা গামা এবং ইসাবেল চড্ৰের পাঁচ পুত্র কন্যার মধ্যে ভাস্কো ডা গামা ছিলেন তৃতীয়।

ভাস্কো ডা গামার প্রাথমিক জীবন নিয়ে খুব বেশি কিছু জানা যায়নি। পতুৰ্গীজ ইতিহাসবিদ টেক্সেইরা দে আরাগাও’র মতে ভাস্কো ডা গামা ইভোরা শহরে পড়ালেখা করতেন এবং ওখানেই গণিত আর জাহাজ চালানোর দিকনির্দেশনার উপর লেখাপড়া করেন। অনেকেই মনে করে তিনি জ্যোতিৰ্বিদ আব্ৰাহাম জাকুটোর কাছে লেখাপড়া করতেন।

তিনিই প্ৰথম ইউরোপীয় ব্যক্তি যিনি সম্পূৰ্ণ সাগর পথ পাড়ি দিয়ে ভারতে আসেন। তার ভ্ৰমণে এশিয়া এবং ইউরোপকে মিলিত করার সাথে সাথে আটলান্টিক মহাসাগর এবং ভারত মহাসাগরকে সংযোগ করেছিলেন এবং পশ্চিমা সংস্কৃতির সাথে পাশ্চাত্য দুনিয়ার সেতুবন্ধন গড়ে তোলেন।

১৪৮০ সালের দিকে ভাস্কো ডা গামা তার বাবার মতোই অর্ডার অফ সান্তিয়াগো-তে যোগ দেন, অর্থাৎ তারা ছিলেন সান্তিয়াগোদের সেনা। সান্তিয়াগোর মাস্টার ছিলেন প্রিন্স জন, তিনি ১৪৮১ সালেই পর্তুগালের রাজা হন। ১৪৯২ সালে রাজা ভাস্কো ডা গামাকে পাঠালেন একটি ফ্রেঞ্চ জাহাজ দখল করার জন্য। কাজটা তিনি এত দক্ষ ভাবে করলেন যে , ভাস্কো ডা গামার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে।

তখনকার দিনে তাদের আফ্রিকার সাথে মসলার ব্যবসা চলতো কিন্তু ভারতবর্ষের সাথে না। তখনো কেউ ওখান থেকে পাড়ি দেয়নি ভারতবর্ষে । ভাস্কো ডা গামাই প্রথম যিনি ভারতবর্ষে ভ্রমনে যান। সেখানকার মরিচ, লবঙ্গ, দারুচিনি, জায়ফল, আদা এবং অন্যান্য মশলা তখন পাশ্চাত্যের  মানুষের কাছে খুবই লোভনীয় ছিল, এইসব মশলা খাবারকে স্বাদে গন্ধে সুস্বাদু করে তুলে সেটা তারা জানতো। কিছু কিছু মশলা ওষুধ হিসাবেও ব্যাবহার করা হতো। ভাস্কো ডা গামা ভ্রমণ শেষে দেশে ফিরে সেই সব মশলা চড়াদামে বিক্রি করেন।

১৪৯৭ সালের ৮ জুলাই ভাস্কো দা গামা পর্তুগালের লিজবন থেকে চারটা জাহাজ নিয়ে রওয়ানা দেন। তারা আফ্রিকার উপকূল ঘেঁসে ভারতবর্ষের দিকে আগাতে থাকেন। জাহাজে ছিল সব দক্ষ চালক, মাত্র ৫৫ জন সেখান থেকে ফিরে আসতে পারে, দুটো জাহাজ নষ্ট হয়। এই চার জাহাজের নাম ছিল সাও গাব্রিয়েল, সাও রাফায়েল, বেরিও,আরেকটার নাম জানা যায়নি, ওটা ছিল গুদাম জাহাজ।

১৪৯৮ খ্রিষ্টাব্দের ১১ই জানুয়ারি তাঁরা পাঁচদিনের জন্য নোঙর করেন নাটালিয়া ও মোজাম্বিকের মাঝামাঝি একটা ছোট্ট নদীর মোহনায়। ভাস্কো দা গামা এই নদীর নাম দেন ‘রিও দি কোবরে’ বা তাম্র নদী।

২রা মার্চ নৌবহর পৌঁছায় মোজাম্বিক দ্বীপে। এখানকার বাসিন্দারা ছিল মুসলমান। সেখানে তারা নিজেদের মুসলমান হিসেবে পরিচয় দেন। এই সময় মোজাম্বিকের সুলতানের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে ভাস্কো দা গামা সাক্ষাৎ করেন। কিন্তু সুলতানকে খুশি করার মতো তাঁর কাছে মূল্যবান কোনো উপঢৌকন ছিল না। অচিরেই ভাস্কো দা গামা ও তার সঙ্গীদের সম্পর্কে লোকজন সন্দেহ করতে শুরু করে এবং এক সময় বিক্ষুব্ধ লোকজন তাদের তাড়া করলে তাঁরা বন্দর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন। এই সময় নিজেদের জাহাজ থেকে কামানের গোলা নিক্ষেপ করে নিজেদের নিরাপদ দূরত্বে নিয়ে যান। বলা হয়ে থাকে ভারত মহাসাগরে সেই প্রথম ইউরোপীয় কামানের গোলা নিক্ষিপ্ত হয়েছিল।

৭ই এপ্রিল তারা মোম্বাসা বন্দরে পৌঁছান, এই বন্দরে তারা অনকুল আচরন না পাওয়ায় সেখান থেকে সামনে এগিয়ে যেতে থাকেন। ১৪ এপ্রিল ভাস্কো দা গামার নৌবহর নোঙর করে বন্ধুভাবাপন্ন বন্দর মালিন্দিতে। এখানে তারা দশদিনের জন্য যাত্রাবিরতি করেন। এখানেই তার সঙ্গে পরিচয় ঘটে আহমেদ বিন মজিদ নামে একজন আরব নাবিকের। কারও কারও মতে, ঐ নাবিক ছিলেন গুজরাতি মুসলমান। মৌসুমি বায়ুর গতিবিধি এবং আকাশের তারা দেখে নৌচালনায় মজিদ ছিলেন অত্যন্ত অভিজ্ঞ ও পারদর্শী, তাই তাকে তিনি সাথে নিলেন।

২৪শে এপ্রিল তারা ভারত মহাসাগরে পাড়ি দেওয়ার জন্য জাহাজ ছাড়েন। ভারত মহাসাগর অতিক্রম করে ২০শে মে তিনি ভারতের কালিকট বন্দরে এসে পৌঁছান। সেখানে তিনি একটা পেদ্রো স্থাপন করলেন। তিনি যে ভারতে পৌঁছে গেছেন সেটা ছিল তার স্বাক্ষর। সেখানকার হিন্দুরাজা ছিলেন সামুথিরি, ঐতিহ্য অনুযায়ী ভাস্কো ডা গামাকে সাদর অভ্যর্থনা জানানো হয়। প্রায় ৩০০০ সশস্ত্র লোক সামিল হয়েছিল অভ্যর্থনা শোভাযাত্রায়। ভাস্কো ডা গামা রাজা সামুথিরির সাথে দেখা করে কিছু উপঢৌকন দেন এগুলি ছিলো —- উজ্জ্বল লাল রঙের কাপড়ের চারটি আলখাল্লা, ছয়টা টুপি, চারটি প্রবাল, পেতলের সাতটি জলপাত্র, একটা সিন্দুক, এক বাক্স চিনি, দুই ব্যারেল তেল, এক পিপে মধু। কিন্তু রাজা সামুথিরির কাছে এ উপঢৌকন খুব তুচ্ছ মনে হলো , তিনি খুব একটা খুশি হলেন না। রাজার সভাসদরা উপহারগুলির মধ্যে সোনা ও রুপা না দেখে খুব অবাক হলেন। অন্যদিকে ভাস্কো ডা গামার আসাকে আরব বণিকরা ভালোভাবে নিলোনা। তারা তাদেরকে ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখলো। তারা রাজাকে বোঝালো যে, ভাস্কো ডা গামা কোনো রাজপ্রতিনিধি নয়, জলদস্যু।

ভাস্কো ডা গামা রাজাকে অনুরোধ করলেন সেখানে একটা বাণিজ্যকুঠি রাখার অনুমতি দেয়ার জন্য, যাতে অবিক্রীত জিনিষপত্র সেখানে রেখে যাওয়া যায়। কিন্তু তখন সেখানে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কর্তৃত্ব ছিল আরব বণিকদের। তাই রাজা সে অনুমতি দিলেন না, উল্টো তিনি ভাস্কো দা গামাকে কর দেওয়ার কথা বললেন এবং জানালেন যে, অন্য ব্যবসায়ীদের মতো তা স্বর্ণমুদ্রায় দিতে হবে। চুক্তি বা সমঝোতা তো হলোই না বরং দুজনের মধ্যে সৃষ্টি হল মনোমালিন্য। কালিকটে থাকার জন্য ভাস্কো দা গামার আর মন বসল না। তিনি ফেরার প্রস্তুতি নিলেন। নানা ধরনের মশলা, অলঙ্কার, হাতির দাঁত ইত্যাদি জিনিস দিয়ে তিনি জাহাজ ভর্তি করলেন। কিন্তু সে সময় উপকূলের আবহাওয়া অনুকুলে ছিল না। তিনি দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যেই যাত্রা শুরু করলেন। এ যাত্রায় প্রচণ্ড ঝড়ে নৌবহরের অনেক ক্ষতি হয়, প্রায় অর্ধেক মাঝিমাল্লা প্রাণ হারায়। অনেকে স্কার্ভি রোগে অসুস্থ হয়ে পড়ে। জাহাজের মাঝিমাল্লা কমে যাওয়ায় ভাস্কো ডা গামা সাঁউ রাফায়েল জাহাজকে পুড়িয়ে ফেললেন এবং সেখানে একটি পেদ্রো স্থাপন করা হয়। সেখান থেকে যাত্রা শুরু করে ২৮শে জানুয়ারি তাঁরা জাঞ্জিবারে পৌঁছান। এরপর এদের দুটি জাহাজ একসাথেই উত্তমাশা অন্তরীপ ঘুরে লিসবনের দিকে রওনা দেয়। কিন্তু পথে প্রচন্ড ঝডে জাহাজ দুটি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।  ঝড়ে সে দুটোর একটি অন্যদিকে চলে যায়। ‘বেররিও’ পর্তুগালে ফিরল সে বছরের ১০ জুলাই। তিনি লিসবনে পৌঁছান ৯ই সেপ্টেম্বরে।

পতুৰ্গীজ মহাকাব্য অস লুইসিয়াডাস তার সম্মানার্থে লেখা হয়েছে। ভারতে তার প্ৰথম ভ্ৰমণ কে বিশ্ব ইতিহাসে মাইলফলক বলে বিবেচনা করা হয়।

১৫০২ খ্রিষ্টাব্দে ভাস্কো দা গামা ১৫টি জাহাজ এবং যুদ্ধ সরঞ্জাম নিয়ে দ্বিতীয়বার ভারতবর্ষে আসেন। এই যাত্রায় তিনি আমিরান্তে দ্বীপপুঞ্জে নোঙর করেছিলেন। সে সময়ে ভারতে কালিকট ও কোচিনের রাজার মধ্যে বিবাদ চলছিল। এই বিবাদের সুযোগ নিয়ে ভাস্কো দা গামা ভারতে প্রথম পর্তুগিজ বাণিজ্যকুঠি নির্মাণ করেন।

কোচিন ও কানানোর নামে দুটি জায়গায় বাণিজ্যকুঠি তৈরি করা হয়। কোচিন শহরে পর্তুগিজরা দুর্গ তৈরি করে এবং কাছাকাছি রাজ্যগুলির সঙ্গে বাণিজ্যসম্পর্ক তৈরি করে। ভারতের বিপুল সম্পদের খোঁজ পেয়ে অন্যান্য ইউরোপীয় দেশও ভারতে যাতায়াত শুরু করে। ভারতের পশ্চিম উপকূলে পর্তুগিজ বাণিজ্যকেন্দ্র ও পরে উপনিবেশ গড়ে ওঠে। গোয়া পর্তুগালের প্রধান উপনিবেশে পরিণত হয়। ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে ভারত সরকার তাঁর নিয়ন্ত্রণ না নেওয়া পর্যন্ত তা পর্তুগিজদের অধীনে ছিল। পর্তুগালের ভাস্কো দা গামাকে ইতিহাস মনে রাখে ইউরোপীয়দের ভারতে আসার পথ সুগম করার পথপ্রদর্শক হিসেবে। কিন্তু তার আগমন ভারতবর্ষের জন্য আদৌ সুখকর ছিল না।

১৫২৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি তৃতীয়বার ভারতবর্ষে যান ভারতবর্ষের ভাইসরয় হয়ে, ভারতীয় পর্তুগিজ কলোনিগুলোর শাসনকর্তা হিসাবে। সে বছরই ২৪শে ডিসেম্বর একটি পর্তুগিজ বাণিজ্যকুঠি পরিদর্শন করতে গিয়ে কোচিনে তার মৃত্যু হয়। কোচিনের সেন্ট ফ্রান্সিস নামের একটি গির্জায় তাকে সমাহিত করা হয়। সেন্ট ফ্রান্সিস চার্চে তাকে কবর দেয়ার চৌদ্দ বছর পর তার দেহাবশিষ্ট লিসবনে নিয়ে যাওয়া হয়, কিন্তু এই গির্জার মধ্যে তার কফিন ও সমাধি ফলক এখনও রয়ে গেছে।

২০১৬ সালের মার্চে ওমানের কাছে সাগরের তলা থেকে ভাস্কো ডা গামার ডুবে যাওয়া এক জাহাজ উদ্ধার করা হয়েছিল, নাম ছিল এসমেরালদা। তবে ইতিহাস বইগুলো তার ভারত ‘আবিষ্কার’-কেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখে, যে কারণে ভারতবর্ষে তার করে যাওয়া বর্বরতা খুব কম মানুষই জানে।

#তথ্যসূত্র #উইকিপিডিয়া # ইন্টারনেট