১৯৫০ খৃষ্টাব্দের শেষের দিকে, অক্টোবরের এক বিকেল, একজন সুন্দরী মহিলা সেক্রেটারি তার পুরুষ বন্ধুর সঙ্গে লন্ডনের এক ডিস্কো নাচের আসরে নাচ্ছিলেন। হঠাৎ একি হল ? তার সর্বাঙ্গে এভাবে আগুল জ্বলে উঠলো কেন? আগুনের লেলিহান শিখা তার সর্বাঙ্গে যে লেহন করে চলেছে।
নৃত্যের তালে তালে হয়তোবা তার দেহের অভ্যন্তরে কোন এক ঝরের সৃষ্টি হয়েছিল। সেই ঝর যেন তার দেহ ভেদ করে –ভয়ঙ্কর রূপ নিয়ে তার বক্ষ ভেদ করে বেরিয়ে এলো। আর নিমিষের মধ্যেই সেই আগুনের শিখা তার পেছনের দিকে ,মাথা ও চুলে দাউ দাউ করে ছড়িয়ে পড়লো। সেকেন্ডের মধ্যে তিনি যেন একটি মানুষ মশালে পরিণত হলেন। তার ভীতবিহবল সঙ্গী ও উপস্থিত লোকেরা সেই আগুল নেভানোর আগেই তিনি মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়লেন। মৃত্যুর কারণ হল ফার্ষ্ট ডিগ্রী বার্ন।
মহিলাটির পুরুষ বন্ধুর কাছে যখন এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হল তিনি পুড়ে যাওয়া ব্যান্ডেজ বাঁধা হাত নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতে থাকেন। তিনি জানালেন নাচের আসরে তিনি কাউকে সিগারেট খেতে দেখেননি। আশে পাশে টেবিলে কোন জ্বলন্ত মোমবাতিও ছিল না। তার বান্ধবীর পোষাকে কোন কিছু থেকে আগুন লাগলেও তিনি দেখেননি। একথাও তিনি বলেন যে, যদিও অবিশ্বাস্য তবুও তার মনে হল এ আগুন যেন তার ভেতর থেকে হঠাৎ দপ করে জ্বলে উঠলো। তার দেহের অভ্যন্তর থেকেই যেন আগুনটির উৎপত্তি। অন্যান্য সাক্ষীরা ও তার সঙ্গে একমত হলেন। অবশেষে আকস্মিক ও অপঘাত মৃত্যু সম্বন্ধে অনুসরণকারী কর্মচারীরা রায় দিলেন ‘ডেথ বাই মিস্ এডভেঞ্চার’-অজানা উৎসের আগুনে পুড়ে মৃত্যু।
বিরল ঘটনা-কিন্তু সত্যঃ
মানুষের অভ্যন্তরে , এই ধরণের ভীতিজনক , স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে সৃষ্ট আগুনের ঘটনা বিরল। কিন্তু ইতিহাসে এ ধরণের ঘটনার উল্লেখ আছে । ইংল্যান্ডের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে সপ্তদশ শতাব্দীতে একজন মহিলাকে আগুনে দগ্ধীভূত অবস্থায় তার ছোট্র কুটিরে মৃত পাওয়া যায়। আগুনের তাপ নিশ্চয়ই অত্যন্ত তীব্র ছিল। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় তার দেহ ছাড়া ঘরের অন্য কোন জিনিসই পোড়ে নাই। এমনকি যে বিছানায় তিনি শুয়ে ছিলেন সেই বিছানাতেও আগুনের কোন চিহ্ন দেখতে পাওয়া যায়নি। বিছানার চাদরটিতে কোন ঝলসানোর দাগ পর্যন্ত দেখা যায়নি।
জনৈক পর্যবেক্ষক মন্তব্য করেন ,এই ঘটনার সুচনা যে কিভাবে-কোন মানুষের পক্ষে তার হদিস-দেয়া সম্ভব নয়। তিনি আরও ইঙ্গিত করেন যে এটা নিশ্চয় ঈশ্বরের তরফ থেকে কোন শাস্তি! কিসের শাস্তি-তার উল্লেখ অবশ্য তিনি করতে পারেননি।
সাম্প্রতিক কালে একজন দালান কোঠা নির্মাণকারী ইংরেজ ঠিকাদার গাড়ী চালিয়ে তার কর্মস্থলে যাচ্ছিলেন। গাড়ীর জানালা দিয়ে তিনি হাত নাড়ছিলেন এবং আকস্মিক ভাবে মুহূর্ত মধ্যে তিনি আগুনের লেলিহান শিখায় ঝলসে উঠলেন। আর একজন ইংরেজও ঠিক একই ভাবে তার ট্রাকের ভেতরে সম্পূর্ণ ভাবে আগুনে পুড়ে ভস্মীভূত হন। তার দেহ পুড়ে একেবারে ছাই হয়ে যায়।
লন্ডনের ডেইলী টেলিগ্রাফ পত্রিকায় প্রতিবেদন বের হয়-পুলিশের চাক্ষুষ প্রমান রয়েছে যে এই আগুনে ট্রাকটির বা ট্রাক বোঝায় পেট্রলের বিন্দু মাত্র ক্ষতি হয়নি । পেট্রোল যেমনকার তেমনি রয়েছে । গাড়ীর দরজা খুলতে কোন রকম বেগ পেতে হয়নি। দরজাটি অতি সহজেই খুলতে পারা যায়। কিন্তু গাড়ীর ভেতরটা আগুনের চুল্লির মত উত্তপ্ত ছিল। আকস্মিক মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধান কারী পর্মচারীরা স্বীকার করেন যে, এই মৃত্যুর সঠিক কারণ নির্ণয় করা তাদের কক্ষে অসম্ভব।
কয়েক বৎসর পর ‘রেনল্ড নিউজ ‘ প্ত্রিকা লন্ডনের এক ব্যক্তির হৃদয় বিদারক মৃত্যুর ঘটনার উল্লেখ করে।এই প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয় যে ঐ ব্যক্তি যখন রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছিলেন , তখন মনে হল আকস্মিক ভাবে তিনি যেন বিস্ফোরিত হলেন। তার কাপড় চোপর ভয়ঙ্কর ভাবে দগ্ধীভূত হল। তার চুলগুলো পুড়ে একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। আর তার রাবার সোল বিশিষ্ট জুতো জোড়ায় রাবারগুলো তার পায়ে গলে একাকার হয়ে গেল !
অপূরণীয় ক্ষতিঃ
মানুষের এই অভ্যন্তরীণ আগুন সব সময় যে সেই ব্যক্তিকেই পুরিয়ে মারে তা নয়। এরা আশে পাশের অন্যান্য স্থানেও অঘটন ঘটায়।
নিউয়ারর্কের ব্রকলিন পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক রবিন বীচ ,যিনি ইলেক্ট্রিক্যাল কনসালটেন্ট এজেন্সি রবিন বীচ ইঞ্জিনিয়ার্সের প্রতিষ্ঠাতা,- বিশ্বাস করেন যে ,এই সব হতভাগ্য লোক অসতর্ক ভাবে নিজেদের অজান্তে কোটি কোটি ডলার লোকসান ঘটানোর কারণ। এই সব দুর্বিপাকের জন্য দায়ী সেই সব লোক।
অধ্যাপক সাহেবের একজন মক্কেল ছিলেন। মক্কেলটি ছিলেন ওহায়ো ফ্যাক্টরির মালিক। তার এই কারখানায় ভৌতিক ভাবে একদিনে কমপক্ষে আটটি আকস্মিক অগ্নিকান্ড ঘটে !
কার মারফত এই অগ্নিকান্ড ঘটছে তা জানার জন্য অধ্যাপক বীচ একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। কারখানার কর্মচারী ও শ্রমিকদের একটি ধাতব প্লেটের ওপর পা ফেলে হেঁটে যাবার ব্যবস্থা করলেন। তারা প্রত্যেকে ঐ ধাতব প্লেটের ওপর দিয়ে হেঁটে যাবার সময় একটি ইলেক্ট্রোড বা বিদ্যৎ মাপন যন্ত্র বহন করবে। সেই সঙ্গে অধ্যাপক অলেক্ট্রোষ্টেটিক ভ্লটিমিটারের মাধ্যমে এর রিডিং নিলেন। এইসব কর্মচারী ও শ্রমিকদের মধ্যে একজন যুবতী মহিলাও ছিলেন। মহিলাটি যখন ঐ প্লেটটির উপর পা রাখলেন, ভ্লটিমিটারের কাঁটা লাফিয়ে অনেক উপরে ওঠে গেল। ভ্লটিমিটারের কাঁটার ভোল্টেজ উঠল ৩০,০০০। ৫০০,০০০ হাজার ভোল্ট পর্যন্ত ছিল তার প্রতিরোধ ক্ষমতা।
অধ্যাপক বীচ বুদ্ধি করে মহিলাটির কারখানার এমন অংশে বদলির নির্দেশ দিলেন যেখানে দাহ্য পদার্থের সংস্পর্শে আসবার তার আর সুযোগ রইলো না।
বিস্ফোরণ ও ষ্টেটিক ইলেক্ট্রিসিটি সম্বন্ধে বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বীচ এর ব্যাখ্যা দিলেন যে কতগুলো বিষয় অনুকুল থাকলে যে কোন লোকই শুষ্ক ও শীতল আবহাওয়ায় কার্পেটের উপর দিয়ে হেঁটে গেলে কয়েক হাজার ভোল্টের ইলেক্ট্রোষ্টেটিক-চার্জ স্থির বিদ্যুৎ উৎপন্ন করতে পারে। এ কারণেই আমরা মাঝে মধ্যে গাড়ীর দরজা বা অন্য কোন ধাতব বস্তুর স্পর্শে ইলেকট্রিক শক খাই। সাধারণ ভাবে নির্দোষ চুলের ডগা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়। অধ্যাপকের মতে এমন অনেক লোক আছেন, হয়ত বা লাখে একজন -, যার অস্বাভাবিক শুষ্কত্বক অধিক মাত্রায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে সহায়তা করে।
অন্যের জন্য বিপদজনকঃ
যে সব লোক স্থির বিদ্যুৎ পরিবাহী তারা অন্যের জন্য অত্যন্ত বিপদ জনক। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় এই স্থির বিদ্যুৎ পরিবাহী কেউ যদি অপারেটিং রুমে থাকেন আর কোন দাহ্য বস্তু যদি তার সংস্পর্শে আসে তবে তার সশব্দে ফেটে অপারেটিং রুমে একটি বিভীষিকার সৃষ্টি করতে পারে। আমরা জানি অপারেটিং রুমে বিভিন্ন ধরণের ওষুধ ও এনেথেটিক বাষ্প ইত্যাদি জাতীয় অত্যন্ত প্রয়োজনীয় জিনিস থাকে। বিস্ফোরণের কারণে পরিবেশের চারদিকে আগুন ছড়িয়ে পড়ে অনেক মৃত্যুর কারণ ঘটাবে । ১৯৬৪ সালের গণনায় জানা গেছে যে এ ধরণের কারণে বৎসরে প্রায় এক হাজার লোকের মৃত্যু হ্যা থাকে।
হাসপাতালের কর্মীদের কাপড় জমে থাকা স্থির বিদ্যুৎ এই ধরণের অগ্নিকান্ডের জন্য দায়ী বলে গণ্য করা হয়।
এ ছাড়া অধ্যাপক স্থির নিশ্চিত যে কামান গোলা তৈরীর ফ্যাক্টরিতে ও পেট্রোলিয়াম শোধনাগারে বিশেষ পরীক্ষার মাধ্যমে লোক নিয়োগ করা প্রয়োজন । শুষ্ক ত্বক বিশিষ্ট বিদ্যুৎ পরিবাহী লোকের দ্বারা সম্ভাব্য বিপদ এড়ানোর এ ছাড়া অন্য কোন পথ নেই।
তিনি একটি ঘটনার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন যে –নিজের কারণেই একটি লোকের জীবন কি রকম সঙ্কটাপন্ন হয়ে পড়েছিল। তিনি বলেন যে কোন একটি ঘটনার অনুসদ্ধানের দায়িত্ব তার উপর ন্যস্ত হয়। একজন ড্রাইভার তার গাড়ীর ইঞ্জিনের ব্যাটারিতে পানির প্রয়োজন আছে কিনা পরীক্ষা করতে গেল। দিনটি ছিল শুষ্ক। সেই সঙ্গে শীত ও পড়েছিল প্রচন্ড। চারদিকে বরফপাত ও শুরু হয়েছে। লোকটি কংক্রিটের রাস্তা দিয়ে কিছুটা হেঁটে গিয়ে গাড়ীর হুড্টি তুললো। তারপর ব্যাটারির মুখটি খুললো।–আর তৎক্ষণাৎ সেখানে একটা প্রচন্ড বিস্ফোরণ ঘটলো। ব্যাটারীর ঢাক্না খোলার সঙ্গে সঙ্গে তার হাত বেরিয়ে আসা হাইড্রোজেন গ্যাসের সংস্পর্শে এসে এই দুর্ঘটনাটি ঘটলো। অল্প ক্ষণ আগে দাঁড় করানো গাড়ীটিতে আচমকা আগুন ধরে যায়। ড্রাইভার ও ভীষণ ভাবে আহত হয়।
প্রফেসর বীচের জ্ঞানগর্ভ কল্পনা বা অনুমান যদিও বহু রহস্যময় অগ্নিকান্ডের ও বিস্ফোরণের কারণ বলে মেনে নেয়া যায়-তথাপি বিস্ফোরণ, গৃহদাহ-এগুলো সত্যিই ঐ ভাবে ঘটে কিনা তা রহস্যময়ই থেকে যাচ্ছে না কি?
প্রাকৃতিক নিয়মের বাইরেঃ
হতভাগ্য মেয়েটি সত্যিই কি নিজের অভ্যন্তরীণ আগুনে পেদীপ্ত হয়ে জ্বলে উঠেছিল? সুন্দরী মেয়েটির পুরুষ বন্ধুর দেয়া সাক্ষ্য কতটুকু নির্ভরযোগ্য ? সে কি সত্য কথা বলেছিল? ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়াররা নির্দেশ করেন যে কোন স্থির বিদ্যুৎ পরিবাহী দ্বারা এ ধরণের ঘটনা ঘটানো সম্ভবপর নয়। নিজের কুঁড়েঘরে মৃতা বৃদ্ধার ও ট্রাক ড্রইভারটি দুঃখজনক মৃত্যু প্রাকৃতিক নিয়ম বহির্ভূত , এতে লেশমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই। আগুনের লেলিহান শিখা উভয় দেহকে পরিপূর্ণ ভাবে গ্রাস করলেও আশে পাশের দাহ্য বস্তুগুলোর বিন্দু মাত্র ক্ষতি হয়নি। এও এক বিস্ময় নয় কি?
তবে কি কোন কোন মানব দেহে এমন কিছু আছে যাদের দেহে কোন জটিল উপাদান বিদ্যমান-থাকে যা বিদ্যুতের মত সচল, গতি সম্পন্ন? তাদের দেহ অন্য কোন বস্তুর সংস্পর্শে এলে তা-কি দাহ্য পদার্থে পরিণত হয়? আর সেই বস্তুর সংস্পর্শে আসা মাত্র সেই দেহগুলো দাহ্য বোমার মতন ফেটে পড়ে?
Images Collected From Google