বিশাল এক স্টেজ। সামনের আসনে বসা অগুনিত দর্শক শ্রোতা। সকলে উদগ্রীব। কে হবে শ্রেষ্ঠ সুরকার। ঠিক তখনি মাইকে ঘোষণা দেওয়া হলো এবারের শ্রেষ্ঠ সুরকার কমল দাস গুপ্ত। হ্যা, ঠিকই শুনেছেন। শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালকের ট্রফিটি তারই হাতে আজ। এই নিয়ে পর পর তিনবার এই ট্রফি তার হাতে আসলো। সুরসৃষ্টির কাজটি মোহগ্রস্ত করে তোলে তাকে। যে কোন গানের প্রতিটি শব্দকে আত্যস্থ করে সবার অন্তরের ভিতরে প্রবেশ করার অসামান্য ক্ষমতা ছিল তার। তার সফলতার পিছনের সবচাইতে বড় গুন কোন গান কোন শিল্পীর গলায় বেশি মানাবে এটা পরিষ্কারভাবে ধারণা করতে পারতেন তিনি। এ যেন বিধাতা প্রদত্ত এক সৃজনশীল ক্ষমতা। সংগীত জগতে সুখের সাগরে ভাসছিলেন কমল দাস। মনে হয় লক্ষ্মী তাকে নিজে দুহাত ভরে অর্থ দিয়েছেন। অর্থ কষ্ট কি কোন ধারণাই ছিল না তার। কোলকাতা, ঢাকা, এমনকি পুরো ভারতবর্ষের সব মানুষের মধ্যেই তার সংগীত দিয়ে কম্পন তুলেছিলেন তিনি। বিশাল বাড়ি-গাড়ি সবই বিধাতা তাকে দিয়েছিল। ১৯৪৬ সালে সরকারকে আয়করই দিয়েছিলেন ৩৭ হাজার টাকা। ঐ সময় যুথিকা রায়, জগন্নাথ মিত্র, কানন দেবী, ফিরোজা বেগম, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মত শিল্পীরা তার সৃষ্ট সুরে কন্ঠ দিতে পেরে ধন্য হয়েছিল। ট্রফিটি হাতে নিয়ে স্মৃতির অতলে হারিয়ে গেলেন। মা বাবা দাদা সবার কথা মনে পড়ছে হঠাৎ করে। বাংলাদেশে নড়াইল জেলার কালিয়া থানার বেন্দা গ্রামে ১৯২২ সালের ১৮ই জুলাই মা প্রমোদিনী দাস গুপ্তের কোল জুরে জন্ম নিয়েছিলেন তিনি। বাবা তারাপ্রসন্ন দাস গুপ্ত ধ্রুপদী সংগীত আর কাকা কিরণ দাস গুপ্ত ছিল তবলা বিশারদ।

সঙ্গীত পরিবেশন করছেন কমল দাশগুপ্ত। ছবি: সংগৃহীত
জন্মের পর থেকেই বেশ একটা সংগীত মুখর পরিবেশে বড় হতে থাকলেন তিনি। বড় দাদা বিমল দাস গুপ্ত গ্রামোফোন কোম্পানিতে সংগীত শিক্ষক। জমিরউদ্দীন খাঁয়ের ঘনিষ্ঠ এবং প্রিয়জন। দাদার সাথে গ্রামোফোন কোম্পানি ইনিস্টিউটিউতে গিয়ে স্ব শরীরে এবং চাক্ষুষ ভাবে সুর তৈরির মন্ত্র গুলোকে আয়ত্ত করলেন তিনি। আর বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করতে লাগলেন। শিল্পীর কন্ঠে গানের সুর তুলে দিতেন তিনি। এভাবেই নিজের অজান্তেই তিনি সুর সৃষ্টির জগতে প্রবেশ করে ফেললেন। ১৯৩২ সালে নিজের লেখা এবং গানের সুরে রেকর্ড ও বের হয় তার। পরিচয় হলো কবি নজরুলের সাথে। কবি নজরুল নিজের এবং কমলের সৃষ্টি ও যোগ্যতার মধ্যে তফাৎ পাননি বলে নিজের লেখা গানের খাতা সুর করবার জন্য তুলে দিলেন কমলের হাতে। আর কমলও সৃষ্টি করলো অবিস্মরণীয় সুর। শ্রুতিমধুর গান গুলো মানুষের মনকে আন্দোলিত করে তুললো। ভাবতে অবাক লাগে এই কমল দাস গুপ্তই শেষ জীবনে কতটা দুঃখ কষ্টের সাথে জীবন অতিবাহিত করলেন।

স্ত্রী ফিরোজা বেগমের সঙ্গে কমল দাশগুপ্ত। ছবি: সংগৃহীত
মানুষের জীবনে উথানপতন থাকেই। কিন্তু কমল দাসের জীবনে যা ঘটে গিয়েছে তা যেন একেবারেই মেনে নেওয়ার মতো না। জীবনের শেষ সময়টাতে যে চরম দুঃখ, কষ্ট, লাঞ্চনায় দিন পার করতে হয়েছিল সেটি খুবই দুঃখজনক। এমন একজন সৃষ্টিশীল মানুষ এত দুঃখ নিয়ে কিভাবে বেঁচে ছিল তা সত্যি আমাদেরকে অবাক করে। ৪০ দশকে দেশে বিদেশে ছিল টালমাটাল পরিস্থিতি। আর ঠিক ঐ সময়টাতেই কমল দাসের জীবনেও নেমে আসে এক অসনীল সংকেত। সারাজীবন দুহাতে অর্জন করেছিলেন বিশাল অংকের টাকা। আর তার সবটুকুই রাখা ছিল নাথ ব্যাংকে। সেই ব্যাংকটি হঠাৎ করেই দেউলিয়া হয়ে যায়। আজীবনের সঞ্চিত অর্থ হারিয়ে একেবারে দিশেহারা হয়ে পরেন তিনি। একই সময়ে আবার তার মা এবং ছোট ভাই ইহলোক ত্যাগ করে পরপারে চলে যান। প্রিয়জন হারানোর শোক ও সেই সাথে সাথে অর্থ খুইয়ে যাওয়ার দুঃখ এই দুটির সংমিশ্রণে কমল দাস মানসিকভাবে হতাশা গ্রস্ত হয়ে পরেন। এখানেই শেষ না, ঠিক সেই সময়টাতেই এইচ এম ভি কোম্পানিও তার সাথে ব্যবসায়িক লেনদেন বন্ধ করলেন। এই পৃথিবীর সব কিছুই যেন তার থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। এমনি এক দুঃসময়ে সঙ্গীনি হিসেবে পাশে পেলেন ফিরোজা বেগমকে। তারা ১৯৫৫ সালে পরস্পর পরস্পরের সাথে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হলেন। এভাবেই চলছিল তাদের জীবন। তারপর বিবাহিত জীবনের কয়েক বছর পর কমল দাস গুপ্ত ধর্মান্তরিত হয়ে কাজী কামাল উদ্দিন নাম গ্রহণ করে মুসলমান হলেন। তখন তারা কলকাতায় বসবাস করছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য নতুন কিছু সৃষ্টি করার সুযোগ তিনি কলকাতা থেকে পাচ্ছিলেন না। শুরু হলো অর্থনৈতিক টানাপোড়ন। জীবনের এই চরম আর্থিক দৈন্য এবং অপমান ভোলার জন্য তিনি তার স্ত্রীকে নিয়ে জন্মভূমি বাংলাদেশের ঢাকায় চলে আসলেন।

পত্রিকার প্রতিবেদনে উঠে এসেছিল কমল দাশগুপ্তের দুরবস্থার চিত্র। ছবি: সংগৃহীত
কিন্তু দুঃখের বিষয় এখানে এসেও তেমন কোন লাভ হলো না। ইতিমধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে সেই সময় নতুন কিছু সুরকার, কিছু গায়ক পূর্বপাকিস্তানের সংস্কৃতি অঙ্গনে তাদের শক্ত আসন বা জায়গা তৈরি করে ফেলেছিলেন। তাদের সাথে সংগ্রাম করে নিজের সেই আগের সন্মান অর্জন কঠিন হয়ে পরেছিল। হতাশার সাথে বলতে হয় ভারত এবং পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ও সাংস্কৃতিক অংগন তার সেই দুর্দিনে তার পাশে এসে দাড়ালো না। বলা যায় ভারত ও তাকে স্থান দিল না আর পূর্ব পাকিস্তানও তাকে সূযোগ দিল না। তার এই চরম অর্থ কষ্ট আর দুর হলো না। আমাদের সবচাইতে দুঃখের জায়গাটি হচ্ছে এতো বড় মাপের একজন সংগীত শিল্পী সারা পৃথিবীর বাংলা ভাষাভাষীদের জন্য যে যুগান্তকারী সংগীত তিনি উপহার দিয়েছিলেন তাকে সাহায্য করবার জন্য কেউ এগিয়ে আসলো না। কি নিদারুণ কষ্টে শেষ বয়সে এসে একটি দোকান খুলে তার জীবিকা নির্বাহের চেষ্টা করতে হয়েছিল তার।