মিউজিয়াম একটি কালের ইতিহাসকে বহন করে নিয়ে যায় প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম। আর এই ইতিহাসের সংগ্রহশালা মিউজিয়াম তাই মানবজাতির কাছে এক অন্যতম আকর্ষণ। বিশ্বে এমন সব বিখ্যাত জাদুঘর রয়েছে যা সভ্যতার ইতিহাস জানানোর পাশাপাশি এদের দৃষ্টিনন্দন নির্মাণশৈলীতেও মুগ্ধ করে দর্শনার্থীদের। তেমনি পৃথিবীর প্রাচীন ও বড় জাদুঘরগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি জাদুঘর যুক্তরাজ্যের লন্ডনে অবস্থিত ‘ব্রিটিশ মিউজিয়াম’। মানব সভ্যতা ও ইতিহাসের অনন্য এক ধারক এই ব্রিটিশ মিউজিয়াম। পৃথিবীর নানান প্রান্ত থেকে সংগ্রহ করা মহামূল্যবান সম্পদ রয়েছে এই মিউজিয়ামে। বিশ্বের সব অঞ্চলের মানুষের সংস্কৃতির শুরু থেকে র্বতমান পর্যন্ত, প্রায় ১৩শ মিলিয়ন নির্দশন এ জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।

১৮শ শতাব্দীতে নির্মান করা এই জাদুঘরের মূল্যবান সম্পদের মধ্যে অনেকগুলো তাদের অর্জন করা, আবার অনেক সম্পদ তারা নিজ দেশের বাইরে যেসব দেশে রাজত্ব করেছে সেখান থেকে লুট করা। ভারতীয় উপমহাদেশে- দু”শ বছরের শাসনে তারা অনেক মূল্যবান সম্পদ নিয়ে যায়, যা আজও ব্রিটিশ মিউজিয়াম এবং বৃটেনের নানা স্থানে সংরক্ষিত আছে। ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে এমন ৫ টি মূল্যবান জিনিসের কথা আজ আমরা আলোচনা করবোঃ

#কোহিনূরঃ কোহিনূর শব্দটি মূলত একটি ফার্সি শব্দ,যার অর্থ –পর্বতের আলো। পৃথিবীর বৃহত্তম হীরা বলা হয় কোহিনূরকে। মুঘল সাম্রাজ্যের ঐতিহ্য হিসেবে এটা এ উপমহাদেশের মানুষের কাছে পরিচিত। ভারতের অন্ধ প্রদেশের খনি থেকে এই কোহিনূর হীরাটি উদ্ধার করা হয় বলে জানা যায়। হীরাটি প্রাথমিক অবস্থায়-৭৯০ ক্যারেটের মতো থাকলেও কাটার পর তা কমে ২১.৬ গ্রামের মতো হয়। এই হীরক খন্ডটি অনেক দিন মালওয়া বংশের কছে ছিলো, পরে আলাউদ্দিন খিলজি তাদের কাছ থেকে এটা কেড়ে নেয়। এক সময় এটা ইব্রাহিম লোদির কাছে পৌঁছে। ইব্রাহিম লোদিকে পানি পথের যুদ্ধে সম্রাট বাবর পরাজিত করলে লোদির মা বাবর পুত্র হুমায়ুনকে হীরাটি দেন। ১৭৩৯ সালের আগে কোহিনূর পাথরটিকে বলা হতো~বাবরের হীরা। পরবর্তীতে সম্রাট হুমায়ুনের কাছ থেকে হীরাটি পারস্যে চলে যায়, আবার সেখান থেকে এটা সম্রাট শাহজাহানের কাছে আসে। সম্রাট শাহজাহান প্রথম তার ময়ূর সিংহাসনকে সুসজ্জিত করতে হীরাটি ব্যবহার করেন, তার আগে সবসময় এটি তোষাখানায় পড়ে থাকতো। এরপর এই হীরা সম্রাট মোহাম্মদ শাহের কাছে যায়, তখন পারস্য সম্রাট নাদির শাহ ভারত আক্রমন করেন। পরবর্তীতে হীরাটি পারস্য নিয়ে যান এবং নাদির শাহ হীরাটি দেখে বলেন~কোহ-ই-নূর। কালের পরিক্রমায় যা এখন-কোহিনূর হিসেবে পরিচিত। নাদির শাহের মৃত্যুর পর হীরাটি পাঞ্জাবের মহারাজা রঞ্জিত সিং এর কাছে চলে যায়। তিনি হীরাটি জগ্ননাথ মন্দিরের সম্পত্তি হিসেবে দিয়ে যান। ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পাঞ্জাব বিজয় করে লাহোর চুক্তি অনুসারে কোহিনূর হীরাটি ব্রিটেনের রানী ভিক্টোরিয়ার কাছে নিয়ে যায়। এটি ১৯১১ সালে রানী-মেরী তার মুকুটে পড়েন,পরবর্তীতে বর্তমান রানী এলিজাবেথের মুকুটে স্থানান্তর করা হয়।

#রাজকীয়_সূরাপাত্রঃ সম্রাট শাহজাহানের কারুকার্যের প্রতি তীব্র আর্কষণ ছিলো ,যার নির্দশন পাওয়া যায় তার ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিসের মাধ্যে। সম্রাট শাহজাহানের ব্যবহৃত রাজকীয় একটি মূল্যবান পাত্র হলো সূরাপাত্র, এটি সাদা রঙের নেফ্রাইট জেড দিয়ে তৈরি। মধ্য এশিয়া কিংবা চীন থেকে আনা হয়েছিলো সাদা নেফ্রাইড পাথর এবং বিশেষভাবে নকশা করে তৈরী করা হয়েছিলো পাত্রটি।এই সূরাপাত্রের অস্তিত্ব ছিলো ১৬৫৭ সাল পর্যন্ত। ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের পর এটি চলে যায়-কর্ণেল চার্লস সেটন গুথরির কাছে। যুগোস্লাভিয়ার রাণী-মারিয়া এক সময় এর মালিক হন। অবশেষে ১৯৬২ সালে ভিক্টোরিয়া এন্ড আলবার্টস মিউজিয়ামে জায়গা হয় জেড পাথরের তৈরী এই সূরাপাত্রের।

#নাসাক_ডায়মন্ডঃ নাসাক ডায়মন্ডটি ভারতের তেলেঙ্গা রাজ্যের খণিতে পাওয়া যায়। নীলচে-সাদা এই ডায়মন্ডটি মহারাষ্ট্রের নাসিকের নিকটবর্তী ত্রিম্বাকেশ্বর শিব মন্দিরে শিবের চোখ হিসেবে বসানো ছিলো। অ্যাংলো-মারাঠা যুদ্ধের সময়-ইষ্ট ইন্ডিয়া কেম্পানি এই ডায়মন্ডটি নিয়ে যায় এবং ব্রিটিশ জহুরি রুনডেল ও ব্রিজের কাছে বিক্রি করে দেয়। রুনডেল ও ব্রিজ ডায়মন্ডটিকে পুনরায় কেটে মারকুইস অফ ওয়েস্টমিনিষ্টারের তলোয়ারের হাতলে বসান। নানা হাত ঘুরে ১৯২৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রে আসে এই ডায়মন্ডটি। এরপর ১৯৪০ সালে আমেরিকান জহুরী-হ্যারি ডায়মন্ডটি পান, তিনি এটাকে কেটে বর্তমানের আকৃতি দান করেন এবং ১৯৪২ সালে বিক্রি করে দেন। এরপর ১৯৪৪ সালে মিসেস উইলিয়াম বি .লিডস তার ষষ্ঠ বিবাহ বার্ষিকীর উপহার হিসেবে আংটিতে এই ডায়মন্ডটি পান। সর্বশেষ ১৯৭০ সালে নিউইয়র্কে এডয়ার্ড জে হ্যান্ডের কাছে ডায়মন্ডটি পাঁচ লাখ ইউএস ডলারে নিলামে বিক্রি করা হয়।

#সুলতানগঞ্জের_বুদ্ধমূর্তিঃ ইংল্যান্ডের বাকিংহাম মিউজিয়াম এন্ড আর্ট গ্যালারিতে যে ধাতব পদার্থ দিয়ে তৈরী বৌদ্ধ মূর্তিটি রয়েছে তা ভাগলপুর জেলার সুলতানগঞ্জ শহর থেকে পাওয়া।৫০০-৭০০ খ্রিষ্টাব্দের এই বৌদ্ধ মূর্তিটির ওজন প্রায় ৫০০ কে.জি। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ সুলতানগঞ্জে রেলওয়ে নির্মান কাজ করার সময় বিহারে সম্পূর্ণ ধাতব এই বৌদ্ধ মূর্তিটি পায় এবং তৎক্ষণাৎ রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ার- হ্যারিস মূর্তিটিকে বাকিংহাম পাঠিয়ে দেন।

এছাড়াও টিপু সুলতানের যান্ত্রিক বাঘ, তলোয়ার ও আংটি। টিপু সুলতান ছিলেন মহিশুরের বীর রাজা,তাকে মহিশুরের বাঘও বলা হতো। ব্রিটিশদের প্রতি তার তীব্র ঘৃণার প্রতীক হিসেবে ছিলো ~ যান্ত্রিক বাঘ। ” এটি একটি খেলনা বিশেষ, যেখানে একটি বাঘ একজন ব্রিটিশের উপর আক্রমন করছে”। বীর সম্রাট টিপু সুলতানের মৃত্যুর পর ব্রিটিশ সৈন্যদল তার সম্পদ লুট করে এবং তলোয়ার ও আংটিসহ বহু মূল্যবান সম্পদ সাথে করে নিয়ে যায়। তন্মধ্যে টিপু সুলতানের তৈরি যান্ত্রিক বাঘ অন্যতম। ২০০৪ সাল পর্যন্ত টিপু সুলতানের এ মূল্যবান সম্পদগুলো ব্রিটিশ মিউজিয়ামেই প্রদর্শিত হচ্ছিলো।