শেষ হলো ট্রোজান যুদ্ধ। গ্রীকদের অধীনে এখন ট্রয়। স্বদেশে ফিরে যাবার পালা গ্রীকদের। হোমার তাঁর দ্বিতীয় কাব্য “অডেসি”তে (Odyssey) বর্ণনা করেন ট্রোজান যুদ্ধের পর গ্রীকদের সুদীর্ঘ স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের গল্প। এই ফিরে যাওয়া খুব একটা সহজ ছিল না। দশ বছর ঘুরে হেলেনকে (Helen of Troy) নিয়ে নিজ দেশে ফেরেন মেনালাউস (Menelaus)। গ্রীক রাজা অ্যাগামেমনন (Agamemnon) নিজ দেশে ফিরে প্রথম রাতেই নিহত হন তার স্ত্রীর প্রেমিকার হাতে। মেনালাউসের মতোই দশ বছর সাগরে ঘুরে দেশে ফেরেন ওডিসিউস (Odysseus)।
অডিসিকেও হোমার বিভক্ত করেছেন গ্রীক ২৪টি বর্ণ মালার আদলে ২৪টি পৃথক খন্ডে। এখানে হোমার বর্ণনা করছেন ওডিসিউসের ট্রয় থেকে গ্রীসে ফিরে যাবার আখ্যান। কাব্যর মাঝামাঝিতে দেখা যায়, খোলা সাগরে ওডিসিউস সম্মুখীন হয় ভয়ঙ্কর দৈত্য-দানবের, তাকে যেতে হয় মৃত্যু-পরবর্তী জীবনের স্বাদ নিতে, তার মানুষ খেকো মানুষের (ক্যানিবালস) সংস্পর্শে এসে অল্পের জন্য বেঁচে যাওয়া, নেশার ঔষধের প্রতিক্রিয়ায় অচেতন হয়ে যাওয়া, এবং দেবতা পসেইডনের (Poseidon) শত্রুতায় মৃত্যুর কাছে চলে যাওয়া। ওডিসিউসের পূর্বসূরী হারকিউলিসও এরকমের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখী হয়েছিল একসময়। একিলিস (Achilles) কিন্তু ট্রোজান যুদ্ধে এ ধরণের কোনো বাধার সম্মুখীন হয় নি। ওডিসিউসের চ্যালেঞ্জগুলো ছিল একেবারেই অন্যরকম। হোমার এখানে হয়তো ইচ্ছে করেই দেখাতে চেয়েছেন যে, ভিন্নতর বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে ওডিসিউস হয়েছিল এক অন্য রকমের হিরো।
অনেক বাধা পেরিয়ে দীর্ঘ দশ বছর পর নিজ দ্বীপে ফিরে ওডিসিউস মুখোমুখি হয় ভিন্ন ধরণের এক বিপদের। যখন সে বাড়ী ফিরে এলো, তখন তার সব সৈন্য মৃত, একজনও জীবিত ফিরে আসতে পারেনি তার সাথে। সে একা। ওডিসিউস বেঁচে যায় শুধুমাত্র তার চতুরতায় এবং বুদ্ধির কারণে। বাড়ী ফিরে সে দেখলো, এলাকার ১০৮ জন বখাটে যুবক তার বাড়ীতে স্ত্রী পেনেলোপকে (Penelope) তাদের একজনের সাথে বিয়ে করতে বাধ্য করছে। আরম্ভ হলো লড়াই। ওডিসিউস এবং তার ছেলে টেলিমাকুস ১০৮ জনকেই হত্যা করে এই লড়াইয়ে। লড়াই শেষ হলে, পেনেলোপ ওডিউসকে প্রমান করতে বললো তার পরিচয়। উদয় হলো ওডিসিউসের আরেক সমস্যা। অবশ্য খুব তাড়াতাড়িই দেবী এথিনার সহায়তায় মিটে গেলো এই সমস্যা। ঐ এলাকায় ফিরে আসে স্বস্তি। ওডিসিউসের বাড়ীতে আসে শান্তি। হোমার এখানে দেখিয়েছেন ভালোবাসার জয় এবং ঘৃণার পরাজয়।
লক্ষ্য করার মতো, হোমারের বর্ণনার এসব কাল্পনিক হলেও এই সমস্যাগুলো এখনও আছে আমাদের সমাজে। দেখা মিলে এসবের প্রায় প্রতিদিন। একটি কাব্য চিরঞ্জীব হয় তখনই, যখন এর প্রাসঙ্গিগতা থাকে অনাদিকাল, Timeless। হোমারের কাব্য দু’টির আলেখ্য এমনই যে, এগুলোর প্রতিফলন আজো আছে সমাজে সমাজে। সভ্যতার বিবর্তন হয়েছে, কিন্তু সমস্যার চারিত্রিক বৈশিষ্ট বদলায় নি একটুও।
হোমার এখনও অনেকের কাছে এক রহস্য। কারো কারো মতে, হোমার কোনো একটি বিশেষ ব্যক্তি নয়, বরং কয়েকজন ব্যক্তি। যারা লিখেছে “দ্য ইলিয়াদ” (Iliad) এবং “দ্য অডেসি” (Odyssey) ,তাদেরকেই বলা হয় হোমার। অনেকের বিশ্বাস, “দ্য ইলিয়াদ” এবং “দ্য অডেসি” লিখেছিলেন বিভিন্ন লেখক বিভিন্ন সময়ে। এ দুটো রচনার মধ্যে সময়ের ব্যবধান সম্ভবত এক শতাব্দী। কাব্য দুটোর রচনা শৈলী স্পষ্টভাবে আলাদা। যেমন, ইলিয়াদের ভাষা অনেক বেশি আনুষ্ঠানিক, ফর্মাল; লেখা হয়েছে নাট্যশৈলীর আদলে। অন্যদিকে, অডিসিতে ব্যবহৃত হয়েছে উপন্যাসের জন্য সহজ অর্থবোধক কথ্য ভাষা, যা’ সাধারণ মানুষ দৈনন্দিনে কাজে ব্যবহার করতো। কাব্য দুটিতে বর্ণিত ঘটনা উপস্থাপনা করা হয়েছে অনেক বিশেষ কাব্যিক ছন্দ ও শব্দমালা দিয়ে, যেগুলো পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে অনেকবার, ঠিক যেমনটি করা হয় গানের কথায়।
হোমার তাঁর রচনায় প্রতিফলিত করেছেন তখনকার ধর্মীয় এবং অতি প্রাকৃতিক বিশ্বাসের পর্যাপ্ত উপাদান। গ্রীক এবং ট্রোজান যোদ্ধারা অত্যন্ত ধার্মিক ছিল। শুধু তাই নয়, তারা ঐশ্বরিক এবং অলৌকিক শক্তির উপর রেখেছিলো অগাদ বিশ্বাস। এই বিশ্বাসের প্রধান কারণ ছিল, দেবতাদের কাছ থেকে শত্রুর বিরুদ্ধে তাদের অনুকূলে শক্তি অর্জন করা। অলৌকিক শক্তিকে নিজেদের পক্ষে রাখার জন্য তারা তাদের দেব-দেবীর উদ্দেশ্যে নিয়মিত বলিদানও করতো।