ভারতীয় উপমহাদেশের বিকাশের ক্ষেত্রে নারীর অবদান অস্বীকার করার কোন উপায় নাই। মহা লাকা চন্দা বাঈ সেই সমস্ত অনুপ্রেরণাদানকারী নারীদের মধ্যে ছিলেন একজন। তার চরিত্রের মধ্যে বিকশিত হয়েছিল একাধিক গুণাবলী। তিনি একাধারে ছিলেন গায়িকা, নর্তকী, যোদ্ধা, রাজনৈতিক পরামর্শদাতা। এমনকি মেয়েদের শিক্ষার সুযোগ প্রসস্থ করার ক্ষেত্রেও তার অবদান ছিল। সে সময়ে সমাজ সংস্কারে ও উন্নয়নে নারীরা ভূমিকা রাখলেও তাদের সংখ্যা ছিলঅত্যন্ত কম। তাই মহালাকা বাঈয়ের বিশাল এই অবদান তাঁকে এক আইকনিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত হতে সাহায্য করেছে। চন্দাবিবি নামে ছোট্ট একটি শিশুর জন্ম হয়, আর মাত্র ১৫ বছর বয়সে তার খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পরে। আমরা উমরাও জান আড়া নামে যেই ভারতীয় উর্দু উপন্যাসের গল্প পড়েছি মনে করা হয় এর প্রাথমিক অনুপ্রেরণা মহালাকা বাঈই ছিলেন।

মাহ লাকা বাইয়ের প্রতিকৃতি © wikipedia
মহালাকা বাঈয়ের মায়ের নাম ছিল রাজ কন্বর বাঈ। তারা আহমেদাবাদ থেকে আওরঙ্গাবাদে এসে তাদের নতুন জীবন শুরু করার চেষ্টা করেন। আওরঙ্গবাদ তখন ছিল নিজামের রাজধানী। সেখানে তার সাথে পরিচয় ঘটে নবাব বাসলত খান বাহাদুরের সঙ্গে। নবাব বাসলত খান বাহাদুর আবার কাজ করতেন মুঘলদের সাথে। এই দুজনের পারস্পরিক সম্পর্কের ফলশ্রুতিতে তাদের ঘর আলো করে চন্দা বিবি জন্মগ্রহণ করে। কন্বর বাই এর বোন মেহতাব বিবির কোন সন্তান ছিলনা বলে চন্দাবিবিকে তারা লালন পালন করবার দায়িত্ব নেন। মেহতাব বিবির স্বামী আবার নিজামের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। সেখানেই তিনি ধীরে ধীরে বড় হতে থাকেন। ব্যক্তিগত যোগ্যতা, দক্ষতা এবং ক্ষমতার কাছে যাবার আগ্রহ তাকে পরবর্তীতে মহালাকা বাঈ বা চাঁদের কন্যা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করে।

পালকি-তে মাহ লাকা- (নিজাম দ্বিতীয়ের কাফেলার শিকারের দৃশ্য থেকে একটি কাটআউট) © wikipedia
লেখাপড়ারলয় ভীষণভাবে আগ্রহী এই নারীর উর্দু কবিতার প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা জন্মে। রাজপ্রাসাদেই তার শিক্ষা শুরু হয়। সঙ্গীত এবং কবিতার প্রতি তার আগ্রহ থেকে তিনি বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ তানসেনের নাতি কুশাল খান কালাওয়ান্টের কাছে দিক্ষা নিতে শুরু করেন। তানসেন ছিলেন আকবরের রাজপ্রাসাদের নবরত্নের একজন। এই নারীর ভেতরকার আধ্যাত্মিক প্রেরণা থেকে একটু একটু করে তার কবিতায় সুফি প্রভাব স্পষ্ট দেখা যেতে শুরু করে। তার কবিতার বিষয় বস্তুর মধ্যে ছিল চিরন্তন ভালোবাসা, বিশ্বাস, বিচ্ছেদের ব্যথার সুর। এর সাথে সাথে তার কবিতায় রাজনীতিরও প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়। সুফি সন্ন্যাসী হযরত আলীর প্রতিও তার ভক্তি স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে তার কবিতায়। একজন নারীর মনের অনুভূতিগুলো সহজ ভাষায় নিখুঁতভাবে তিনি তুলে ধরতেন বলে সে সময়ে ভীষণভাবে জনপ্রিয় হয়ে গিয়েছিলেন তিনি এবং ক্রমান্বয় তিনি একমাত্র নারী কবি হিসাবে বিভিন্ন কবিতার সভায় অংশগ্রহণ করতেও অনুমতি পেয়েছিলেন। ১৭৯৮ সালে তার কবিতার সংকলন দিভান প্রকাশিত হয়। মীর আল্লম বাহাদুরের বাড়িতে অনুষ্ঠিত এক পার্টিতে জন মালকমের হাতে তার এই বইটি উপহার হিসেবে দেওয়ার জন্য তিনি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন। সেখানে তার কথাবার্তা, তার বুদ্ধি সমস্ত কিছু পর্যবেক্ষণের পরে মহালাকা বাঈকে এক জন ওমরাহ হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়। অত্যন্ত যোগ্যভাবে তিনি নিজামের দরবারকে শক্তিশালী করেছিলেন।

আদালতে মাহ লাকা নাচছেন © wikipedia
তিনি ওমরাহ হিসেবে দরবারেতো অংশগ্রহন করতেনই সে সাথে নিজামকে বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক পরামর্শ দিয়েও নানা বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করতেন। তীর চালানো, ঘোড়ায় চড়া, তাবু সাজানো সমস্ত কিছুতেই তার দক্ষতা ছিল। তার এই যোগ্যতার কারণে খুব দ্রুতই তিনি নিজামের বিশ্বাস এবং শ্রদ্ধা অর্জন করে নিয়েছিলেন। এর ফলে কখনো কখনো তিনি শিকার এবং যুদ্ধেও নিজামের সাথে অংশগ্রহণ করতেন। তিনটি যুদ্ধে তিনি পুরুষের পোশাক পরে লড়াইও করেছিলেন। যে কারণে দিকে দিকে তার এই বুদ্ধিমত্তা ও যোগ্যতার গল্প গুলো ছড়িয়ে পরেছিল। পড়তে ভীষণ ভালোবাসতেন বলে তার নিজস্ব একটি গ্রন্থাগার তিনি তৈরি করেছিলেন। যেখানে প্রায় সব ধরনের বইয়েরই সংগ্রহ দেখতে পাওয়া যায়।
যখনই নতুন কোন বই তার হাতে আসতো তিনি তার ক্যালিওগ্রাফার দিয়ে অনুলিপি করিয়ে তার লাইব্রেরিতে রেখে দিতেন। নারীদের প্রতি তার মমতা ছিল অসীম। নারী শিক্ষার জন্যে একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গড়ে তুলেছিলেন। দক্ষ শিক্ষকরা সেখানে মেয়েদের সঙ্গীত এবং কথক নৃত্য শিখাতেন। দিকে দিকে সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য তিনি সাত দিন ব্যাপী সংস্কৃতির উৎসব বা উরসের আয়োজন করতেন। সেই মেলায় সাহিত্যিক, সাধু, শিল্পীদেরকে তিনি আমন্ত্রণ করে নিয়ে এসে তাদের কাছে মতামত এবং ধারণার বিনিময় ঘটাতেন। এই পুরোটা অনুষ্ঠানের আয়োজন তিনিই করতেন। মেয়েদের শিক্ষার জন্য তার নিজস্ব তহবিল থেকে প্রায় ১ কোটি টাকা তিনি দান করেছিলেন। আর মৃত্যুর পর গৃহহীন মেয়েদের জন্য তার জাগিরের কিছু অংশ দিয়ে দেওয়া হয়। এটি বর্তমানে ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অংশ। হায়দরাবাদের বিভিন্ন অংশেই তার দানের ছোঁয়া দেখতে পাওয়া গিয়েছে। ১৭৯২ সালে তার মায়ের জন্য অত্যন্ত সুন্দর একটি সমাধি তিনি তৈরি করেছিলেন। গল্প আছে গর্ভবতী অবস্থায় মওলা আলির মাজারে চাদর চড়াতে গিয়ে তার মায়ের প্রায় গর্ভপাত হয়ে যাচ্ছিল। তাদের বিশ্বাস মাজারে শায়িত পীরের আশীর্বাদে পরবর্তীতে চন্দা সুস্থভাবে জন্ম নেয়। এই জন্য মায়ের মৃত্যুর পর চন্দা সেখানেই তার মায়ের সমাধি তৈরি করেন। এবং তার মৃত্যুর পরে তিনি নিজেও সেই সমাধির পাশে শায়িত হয়েছিলেন।

মাহ লাকা গাইছেন কবিতা © wikipedia
সেখানে আশুরখানা, শিয়া মুসলিমদের শোকস্থান, নাকারখানা, ঢোল বাজানোর প্যাভিলিয়ন, বাউলি সমস্ত কিছু তিনি তৈরি করেন। ২০১১ সালে জায়গাটি অত্যন্ত ভগ্ন অবস্থায় অবহেলিতভাবে পরে থাকলে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সাংস্কৃতিক সংরক্ষণ তহবিল থেকে আবার পুনরুদ্ধার করা হয়। তিনি কোন সোনার চামস নিয়ে জন্মগ্রহণ করেননি। বরং তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যোগ্যতা এবং দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে এই কঠিন পৃথিবীতে এগিয়ে যেতে হবে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে যা কিছু প্রয়োজন তার সমস্ত দক্ষতাই তিনি একে একে শিখেছিলেন। এর ফলে সাধারণ জনগণ থেকে শুরু করে অভিজাত এবং ব্রিটিশ কর্মকর্তা সকলেই তার প্রশংসার পঞ্চমুখ ছিলেন। সেই সাথে সাথে তার অর্জিত ধন সম্পদ তিনি সাধারণ মানুষের কল্যাণে ব্যয় করেছিলেন বলে প্রতি মূহুর্তে সাধারণ মানুষও তার গুনগান করতে দ্বিধাবোধ করেননি।

