পুথিচিত্রে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ

মহাভারত হলো সংস্কৃত ভাষায় রচিত প্রাচীন ভারতের এক অন্যতম মহাকাব্য। মূলগ্রন্থ সংস্কৃত ভাষায় রচিত হলেও এর অনুবাদগ্রন্থ গুলো মূল পাণ্ডুলিপি থেকেও কম জনপ্রিয়তা পায়নি। ‘মহাভারত’ অর্থ ভরত বংশের মহান কাহিনী। এটি একটি সনাতন ধর্মগ্রন্থ। তবে মহাভারতের রচনাকাল নিয়ে বেশ মতবিরোধ রয়েছে। কতো বছর আগে এই গ্রন্থ রচিত হয়েছিল, সঠিকভাবে কেউই বলতে পারে না। প্রাচীন পণ্ডিতদের মতে, মোটামুটি পাঁচ হাজার বছর আগে রচিত হয়েছিল এটি। তবে আধুনিক বিশেষজ্ঞরা বলেন অন্য কথা….তাদের মতানুসারে- খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকে খ্রিস্টিয় দ্বিতীয় শতকের মধ্যে মহাভারত রচিত হয়েছিল। প্রথম দিকে মহাভারত ‘জয়’ নামে পরিচিত ছিল, যার শ্লোকসংখ্যা ছিল ৮-১০ হাজার। যুগে যুগে শ্লোকসংখ্যা বেড়ে ….বর্তমানে প্রচলিত মহাভারতের শ্লোকসংখ্যা প্রায় এক লাখ এবং শ্লোকগুলো ষোলো মাত্রিক চরণে রচিত। ভারতের প্রায় সকল প্রাদেশিক ভাষায় মহাভারতের অনুবাদ হয়েছে। বাংলা ভাষায়ও হয়েছে, তবে বাংলা মহাভারত রচয়িতার নিজস্ব জীবনবোধ , সমাজচেতনা এবং রচনাশৈলীর কারণে তা মৌলিক কাব্যের মর্যাদা লাভ করেছে। জানা যায়, বাংলায় প্রথম মহাভারত অনুবাদ করা হয়েছিলো এক মুসলমান শাসকের আদেশে l

কুরুক্ষেত্রে কৃষ্ণ ও অর্জুন, অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতাব্দীর চিত্রকলা

মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যের এক সমৃদ্ধ ধারা ছিল অনুবাদ সাহিত্য। আমাদের সংস্কৃতি যে সেকেলে ছিল না, অনুবাদ সাহিত্যই তার প্রমাণ। মূলত সংস্কৃত, আরবি, ফার্সি ও হিন্দি ভাষার সাহিত্য থেকে তখন বাঙালি কবিরা মণিরত্ন তুলে এনে আমাদের উপহার দিয়েছেন। তবে, সেই অনুবাদ ছিল ভাবানুবাদ, কখনই আক্ষরিক অনুবাদ নয়। মূল কাহিনিকে ভিত্তি করে বাংলার কবিরা নিজেদের মনের মাধুরী মিশিয়ে তা পরিবেশন করেছেন।

অর্জুনের প্রতি শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ

বাংলার সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহের লস্কর বা সেনাপতি ছিলেন পরাগল খান। হুসেন শাহ চট্টগ্রাম জয় করে পরাগলকে সেখানকার শাসনকর্তা নিয়োগ করেন। পরাগলের সভাকবি ছিলেন কবীন্দ্র পরমেশ্বর। একবার পরাগল খান মহাভারতের যুদ্ধের কাহিনী শুনে মুগ্ধ হন। সভাকবি পরমেশ্বরকে তিনি নির্দেশ দেন, একদিনে শোনার উপযোগী করে সংক্ষিপ্ত আকারে মহাভারত অনুবাদ করতে হবে। কবীন্দ্র পরমেশ্বর মহাভারতের তত্ত্বকথাগুলি বাদ দিয়ে মূল কাহিনিগুলোই অনুবাদ করেছিলেন …..তাঁর এই গ্রন্থের নাম ‘পাণ্ডববিজয়’ বা ‘বিজয়পাণ্ডব’। পরাগল খানের নাম অনুসারে এটি ‘পরাগলি মহাভারত’ হিসেবেও পরিচিত। সুকুমার সেনের মতে এই কাব্য রচনার সময়কাল ১৬ শতক বা দ্বিতীয়–তৃতীয় দশকের। কবীন্দ্র পরমেশ্বর তাঁর কাব্যে সুলতান হুসেন শাহ এবং পরাগল খানের প্রশংসা করেছেন…. কিন্তু নিজের সম্পর্কে বিশেষ কিছুই বলেননি। কোনো কোনো গবেষক মনে করেন, তাঁর আসল নাম পরমেশ্বর, তাঁকে ‘কবীন্দ্র’ উপাধি দিয়েছিলেন পরাগল খান। ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, ডঃ সুশীলকুমার দে, বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতো পণ্ডিতেরা মনে করেন, মহাভারতের আরেক অনুবাদক কবি শ্রীকর নন্দীরও উপাধি ছিল ‘কবীন্দ্র পরমেশ্বর’। পরাগলের ছেলে ছুটি খানের নির্দেশে শ্রীকর নন্দী ‘অশ্বমেধ পর্ব’-র অংশ নিয়ে বাংলায় মহাভারত রচনা করেন, যা ‘ছুটি খানি মহাভারত’ নামে পরিচিত। সুকুমার সেন জানিয়েছেন, কবীন্দ্র পরমেশ্বর এবং শ্রীকর নন্দী দু’জন ভিন্ন ব্যক্তি। গৌরীনাথ শাস্ত্রীর মতে, কবীন্দ্র ছিলেন কোচবিহারের রাজা নরনারায়ণের মন্ত্রী। তাঁর আসল নাম বাণীনাথ….. ‘কবীন্দ্র’ তাঁর উপাধি। মন্ত্রী ছিলেন বলে তিনি ‘কবীন্দ্রপাত্র’ নামেও পরিচিত হন। সুকুমার সেনের মতে, কবীন্দ্র পরমেশ্বর উত্তরবঙ্গেরই লোক।

দ্রৌপদী তাঁর পঞ্চস্বামীর সাথে – সিংহাসনে যুধিষ্ঠির উপবিষ্ট, নিচে ভীম ও অর্জুন, দু’পাশে নকুল ও সহদেব দণ্ডায়মান

গৌড়েশ্বরের নির্দেশে বাংলায় প্রথম রামায়ণ অনুবাদ করেছিলেন কৃত্তিবাস ওঝা। ইতিহাসবেত্তাদের একাংশ বলেন, এই গৌড়েশ্বর ছিলেন রুকনউদ্দিন বরবক শাহ। আবার কেউ বলেন, বাংলার সুলতান জালালউদ্দিন মুহম্মদ শাহ ছিলেন কৃত্তিবাসের পৃষ্ঠপোষক। আবার এরকম মতও প্রচলিত আছে যে, এই গৌড়েশ্বর ছিলেন রাজা গণেশ। আর পরাগল খানের উৎসাহে বাংলায় প্রথম মহাভারত অনুবাদ করেছিলেন কবীন্দ্র পরমেশ্বর।

দুঃশাসন কর্তৃক দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ

কেউ যদি বলে, মহাভারত শুধু একটি ধর্মগ্রন্থ- তবে বুঝতে হবে তিনি মহাভারত পড়েননি। মহাভারত শুধু একটি ধর্মগ্রন্থই নয়, বরং এটি সে যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক গ্রন্থ। আজ থেকে প্রায় চার-পাঁচ হাজার বছর আগের ভারত দেখা যায় এই গ্রন্থে। সে যুগের সমাজবিধি ও আচার-অনুষ্ঠানের ব্যাপারেও বলা হয়েছে এখানে। এছাড়াও মহাভারতে বিভিন্ন মত ও পথের অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে! এতে শৈব, শাক্ত ও বৈষ্ণব দর্শনের সমন্বয় প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয়। মহাভারত একটি দার্শনিক গ্রন্থও বটে…এটি একাধারে মহাকাব্য, ইতিহাস, পুরাণ, ধর্মশাস্ত্র, অর্থশাস্ত্র, কামশাস্ত্র, নীতিশাস্ত্র, মোক্ষশাস্ত্র ইত্যাদি। এই মহাকোষগ্রন্থ প্রাচীন ভারতের এক বিশাল জ্ঞানভান্ডার। তখনকার সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি, গার্হস্থ্যবিদ্যা, ভক্তিবাদ, যুদ্ধনীতি, রোম্যান্টিক কল্পগাথা, অসংখ্য মিথ, জ্যোতির্বিদ্যা, সম্মোহনবিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা, নৃত্যবিদ্যা সবকিছুর সমাবেশ ঘটেছে মহাভারতে।

বাংলাদেশের কান্তনগর মন্দিরে খোদিত টেরাকোটায় মহাভারতের দৃশ্য, ১৮ শতকে জমিদার প্রাণনাথ রায় কর্তৃক নির্মিত।

বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতি চিরকালই সম্মিলন এবং সম্প্রীতির ঐতিহ্য বহন করছে। মুসলমান শাসক পরাগল খানের নির্দেশে বাংলায় প্রথম মহাভারত অনূদিত হওয়া তাই কোনোভাবেই আশ্চর্যের বিষয় নয়। তবে, বাংলায় সবচেয়ে জনপ্রিয় মহাভারত অনুবাদক ছিলেন কবি কাশীরাম দাস। কাশীরামের পর আরও অনেকেই মহাভারত রচনা করেন তবে এদের রচনা অধিকাংশই অসম্পূর্ণ ছিল তাই সেগুলো সুধীসমাজে তেমন একটা প্রচার পায়নি ।

কাশীদাসী মহাভারতের প্রথম পৃষ্ঠা

তথ্যসূত্র – ১. বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (আদি থেকে উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম পর্যন্ত), সুকুমার সেন। ২. বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, অধ্যাপক মাহবুবুল আলম।