প্রাচীন সময়ের সর্ববৃহৎ বাণিজ্য রুটগুলোর একটি ছিল সিল্ক রোড। এই পথ ধরে দুই হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে এশিয়া থেকে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে পণ্য, জ্ঞান ও সংস্কৃতি আদান–প্রদান চলত। যদিও “সিল্ক রোড” নামটি উনিশ শতকে জার্মান ভূগোলবিদ ফার্দিনান্দ ফন রিখটহফেন প্রবর্তন করেন, তবে তার বহু আগে থেকেই এ পথ চীন, ভারত ও মধ্য এশিয়ার সঙ্গে রোমাভিত্তিক পশ্চিমা জগতকে যুক্ত করেছিল। চীনের সূক্ষ্ম রেশম, ভারতীয় উপমহাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার মশলা, সুগন্ধি ও মূল্যবান ধাতু পৌঁছে যেত ভূমধ্যসাগরীয় বন্দরে। অপরদিকে, ইউরোপীয়দের কাছ থেকে স্থাপত্যরীতি, অলংকরণের ধরণ ও প্রযুক্তি ছড়িয়ে পড়ত উত্তর-পূর্ব এশিয়া পর্যন্ত।
সপ্তম ও অষ্টম শতকে আরব বাহিনীর হাতে এশিয়ার বিশাল এলাকা দখল হওয়ার পর এই বাণিজ্যপথে বড় ধরনের অচলাবস্থা তৈরি হয়। নিয়ন্ত্রিত এলাকায় চলাচলের নিয়মকানুন কড়াকড়ি হওয়ার কারণে পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ অনেকটা কমে যায়। বিভিন্ন শহর ও বাণিজ্য কেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, ফলে সিল্ক রোড ধীরে ধীরে গুরুত্ব হারাতে শুরু করে। এই দীর্ঘ অচলাবস্থার অবসান ঘটায় মঙ্গোলদের উত্থান।

সিল্ক রোডের ম্যাপ © Britannica
চীনের উত্তরাঞ্চলের বিস্তৃত তৃণভূমিতে বসবাসকারী মঙ্গোল উপজাতিরা যাযাবর জীবনে অভ্যস্ত ছিল। তারা ছিল দুর্ধর্ষ যোদ্ধা, যাঁরা তীর-ধনুক নিয়ে ঘোড়ার পিঠে যুদ্ধ করত এবং শত্রুকে চমকে দেওয়া গতি ও কৌশল ব্যবহার করত। ১২০৬ সালে এই বিচ্ছিন্ন উপজাতিগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করেন চেঙ্গিস খান এবং প্রতিষ্ঠা করেন বৈশ্বিক শক্তিধর মঙ্গোল সাম্রাজ্য। কয়েক দশকের মধ্যেই এই সাম্রাজ্য পূর্ব এশিয়া থেকে শুরু করে মধ্য এশিয়া ও ইউরোপের দোরগোড়ায় পৌঁছে যায়। প্রথমদিকে জয় করা অঞ্চল ধ্বংস করাই ছিল তাদের মূল নীতি, কিন্তু পরে চেঙ্গিস খানের সেনাবাহিনীর একজন চীনা জেনারেলের পরামর্শে তারা বুঝতে পারে যে ধ্বংসের চেয়ে শাসন আর করব্যবস্থা বেশি লাভজনক। ফলে লবণ, লোহা, জমি ইত্যাদি থেকে রাজস্ব আদায় শুরু হয় এবং একপর্যায়ে বছরে লাখ লাখ বস্তা শস্য, হাজার হাজার কিলোগ্রাম রূপা ও রেশম কর হিসেবে আদায় করতে সক্ষম হয়।
এই শাসনব্যবস্থার ফলেই পুরো সাম্রাজ্যে স্থিতিশীলতা বেড়েছিল — যাকে ঐতিহাসিকরা বলেন Pax Mongolica বা মঙ্গোলীয় শান্তি। এই শাসনব্যবস্থা ব্যবসায়ী ও পর্যটকদের নিরাপদ চলাচলের নিশ্চয়তা দিয়েছিল। মঙ্গোলরা তৈরি করে ইয়াম নামের উন্নত ডাকব্যবস্থা, যার মাধ্যমে দ্রুত বার্তা ও সরকারি নির্দেশ এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পৌঁছানো যেত। এই সুব্যবস্থার ফলে সিল্ক রোড আবারও কর্মচঞ্চল হয়ে ওঠে। বণিকরা নিরাপদে ব্যবসা করতে শুরু করে, দূর দেশ থেকে কবি, পর্যটক, ধর্ম প্রচারক ও বিজ্ঞানীরা মঙ্গোল সাম্রাজ্যে ভ্রমণ শুরু করেন।

সম্রাট কুবলাই খান; Image source: BBC
চেঙ্গিস খানের নাতি কুবলাই খান ১২৬০ সালে সম্রাট হন। তিনি রাজধানী স্থাপন করেন বেইজিংয়ে এবং দক্ষিণ চীন জয়ের পর প্রতিষ্ঠা করেন ইউয়ান রাজবংশ। তিনি ছিলেন জ্ঞানপিপাসু ও সংস্কৃতিমনস্ক শাসক এবং নিজের সাম্রাজ্যে সাহিত্য, চিত্রকলা ও বিজ্ঞানচর্চায় পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির মানুষকে স্বাগত জানানোর মধ্য দিয়ে পশ্চিমা বণিক ও পর্যটকদের তিনি সিল্ক রোড ধরে চীনে আসার আমন্ত্রণ জানান। তার এই উদ্যোগের ফলে ইউরোপ থেকে আবার নতুনভাবে পণ্য, প্রযুক্তি ও জ্ঞান এশিয়ায় প্রবাহিত হতে শুরু করে। এই সময়ই ইউরোপে কাগজ, ছাপার কৌশল, কম্পাস ও বারুদ সম্পর্কে ধারণা পৌঁছাতে শুরু করে। তৎকালীন সময়ের সবচেয়ে বিখ্যাত ইউরোপীয় পর্যটক মার্কো পোলো ভেনিস থেকে এসে কুবলাই খানের দরবারে পৌঁছান এবং দীর্ঘ সময় ধরে মঙ্গোল সাম্রাজ্য ভ্রমণ করেন। পরবর্তীতে তাঁর লেখা ভ্রমণকাহিনী ইউরোপীয়দের মনে পূর্বে অদেখা এক পৃথিবীর সম্পর্কে কৌতূহল ও বিস্ময় ছড়িয়ে দেয়।

মার্কো পোলো; Image source: National Geographic
ফলে বলা যায়, মঙ্গোল সাম্রাজ্যের উত্থান ও শাসনব্যবস্থা কেবল যুদ্ধজয়ের ইতিহাস নয়, বরং স্থিতিশীল শাসনব্যবস্থা গড়ে তুলে সিল্ক রোডকে আবারও কার্যকর করার একটি সফল দৃষ্টান্ত। তাদের নিরাপত্তা, যোগাযোগ ও করনীতির ফলে পূর্ব ও পশ্চিমের সভ্যতা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির মধ্যে যে প্রবাহ তৈরি হয়েছিল তা পরবর্তীকালে রেনেসাঁ পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে। মঙ্গোলরা যদি এই যোগাযোগ পুনরুদ্ধার না করত, তাহলে হয়তো সিল্ক রোড নামেই এত খ্যাতি লাভ করত না, আর ইতিহাসের মানচিত্রে চীন ও ইউরোপের মিলনরেখা এত শক্তিশালীভাবে আঁকা হত না।