বাংলাদেশে রয়েছে বহু ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি বা উপজাতির বসবাস,মুরং তাদের মধ্যে একটি। ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠি মুরংরা ম্রো নামেও পরিচিত। এদের আদি নিবাস মায়ানমারের আরাকান রাজ্যে। ৫৯২ বছর আগে ম্রোরা পার্বত্য চট্টগ্রাম, বান্দরবান জেলা ও রাঙ্গামাটি জেলায় বসবাস শুরু করে। ম্রোরা প্রকৃতির উপাদান ও প্রাকৃতিক শক্তিকে পূজা করে। তারা বিশ্বাস করে বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা তুরাই,পাহাড়ের দেবতা সাংতুক এবং নদীর দেবতা ওরেং তাদের সর্বক্ষণ আগলে রাখছে । মন প্রাণ দিয়ে তারা এদের উপাসনা করে l
বান্দরবান জেলার চিম্বুক পাহাড়ের পাদদেশে রয়েছে মায়াভরা একটি গ্রাম l গ্রামটির নাম হলো-পোড়া পাড়া।এই পাড়ার একটি ছেলে-মেনলে ম্রো। মেনলের মনে অনেক দুঃখ,সারাদিন সে একা একা ঘুরে বেড়ায় পাহাড়ে-পাহাড়ে। তার মনে নেই শান্তি,সে ঝর্ণায় ছোট ছোট মাছ ধরে,ঘুরে বেড়ায় বনের ভেতরে। কিসের এত দুঃখ মেনলের মনে ? কেন এত কষ্ট? মেনলের গ্রামে কোন স্কুল নেই, নেই তাদের নিজস্ব ভাষা প্রকাশের কোন বর্ণমালা। মেনলে তাদের ধর্মের বিভিন্ন দেবতাদের কথা জানে কিন্তু পৃথিবীর অন্য মানুষেরা যে ভাবে ধর্ম পালন করে, সেভাবে তাদের ধর্মের কোন নাম নেই। বিদ্যার্জনের ক্ষুধা তার অপরিসীম l
মেনলের পড়ালেখা শেখার অদম্য ইচ্ছা পূরণের পথ সৃষ্টি হয় যখন ১৯৮১ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড বান্দরবানে ম্রো আবাসিক বিদ্যালয় চালু করে। মেনলে ছুটে যায় বিদ্যালয়ে পড়ালেখার জন্য l কিন্তু তখন মেনলের প্রাথমিক স্তরে পড়ার আর বয়স ছিলো না। মেনলের জেদের কাছে শেষ পর্যন্ত হার মানেন প্রধান শিক্ষক, পড়তে তাকে দিতেই হবে এবং এটা আদায় করার জন্যে মেনলেকে বিদ্যালয়ের সামনে অনশন পর্যন্ত করতে হয়েছিলো l বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পেরে মেনলে কিন্তু খুব খুশী , আনন্দের সাথে সে পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছিলো। অত্যন্ত মেধাবী হওয়ায় ভর্তির কয়েক মাসের মধ্যেই মেনলে ডাবল প্রমোশন পেয়ে যায়। কিন্তু হায়! পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর বিদ্যালয় ছাড়তে হয় মেনলেকে l কারণ মাধ্যমিক বিদ্যালয়টি ছিলো তার বাড়ি থেকে অনেক দূরে। পড়ালেখার অনেক ইচ্ছে সত্ত্বেও মেনলে বুঝতে পেরেছিলো যে ১৮ বছর বয়সে তাকে ৬ষ্ট শ্রেণীতে পড়ার সুযোগ আর দেয়া হবে না।
মেনলে যখন বিদ্যালয়ে ভর্তি হয় তখন তাকে বাংলা বর্ণমালা পড়তে হয়, সে ভাষা তার মাতৃভাষা নয়। আদিম এক জাতির সদস্য মেনলে যাদের রয়েছে লক্ষ লক্ষ জনসংখ্যা তবুও তাদের নেই নিজস্ব ভাষার বর্ণমালা, তাই তাদের পড়তে হয়েছে অন্য ভাষায়। নিজস্ব বর্ণমালা না থাকার দুঃখ মেনেলের সব সময়ই ছিলো। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা শেষে বাড়ি ফিরে আসার পর মেনলে সারা দিন গুহায়,বনে-বাঁদাড়ে ঘুরে বেড়াত। পাহাড়ি লতা,গুল্মের রস দিয়ে রঙ বানিয়ে তা দিয়ে যেখানে সেখানে ছবি আঁকত। এ ভাবে ম্রো ভাষার প্রথম লিপি তৈরির কাজ করে যাচ্ছিলো যুবক মেনলে। তার একক চেষ্টায় ১৯৮৫ সালে আবিষ্কার হয় বর্ণমালা। ১৯৮৬ সালের ৫ই এপ্রিল প্রায় ৫ হাজার গ্রামবাসির উপস্থিতিতে মেনলে প্রকাশ করে তার আবিষ্কৃত ক্রামা বা ম্রো বর্ণমালা। মেনলের মনে আরো দুঃখ ছিলো যে , মুরং অনেক আদি জাতি হলেও তাদের নিজস্ব কোন ধর্ম এবং ধর্মীয় উপাসনালয় নেই, নেই কোন ধর্ম গ্রন্থ। পৃথিবীর অন্যান্যদের থেকে ম্রো উপজাতি অনেক পিছিয়ে,কিন্তু তার গোত্রের লোকদের ভেতর এসব নিয়ে কোন চিন্তা বা চেষ্টা ছিলো না। বর্ণমালা প্রকাশের একই দিনে মেনলে তার জাতি কে এক নতুন ধর্মের কথা বলেন। যে ধর্মের নাম “ক্রামা” ।
এক বৃষ্টি ভেজা দিনে গ্রামবাসী মেনলের কাছ থেকে তাদের ম্রো ভাষার বর্ণমালার কথা ও নতুন এক ধর্মের কথা জেনে মুগ্ধ হয়ে যায়। তারা মেনলেকে ঈশ্বরের পুত্র বা স্বর্গের দেবতা বলে আখ্যা দেয়। ১৯৮৬র ৫ই এপ্রিল থেকে ১৪ই আগষ্ট পর্যন্ত মেনলে প্রচার করে তার প্রবর্তিত ক্রামা ধর্মের অনুশাসন ও নীতি বাক্য বান্দরবানের পাড়ায় পাড়ায়। মুরং উপজাতির বহু মানুষ তার ধর্মের দীক্ষা গ্রহণ করে।
ম্রো জাতির নিজস্ব বর্ণমালার উদ্ভাবক এবং নতুন ক্রামা ধর্মের প্রচারক মেনলে কে আকস্মিক ভাবে ১৯৮৬র ১৫ই আগষ্ট ভোর থেকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। কেউ বলে তাকে দেবতা নিয়ে গেছে, কেউ বলে তিনি হিমালয়ে ধ্যানে গিয়েছেন। শোনা যায় যে, তার সাথে শেষবার দেখা হবার সময় তিনি নাকি বলে গেছেন, ”আমি তপস্যায় গেলাম, আবার ফিরে আসব”। অনেক চেষ্টা করেও চিম্বুক পাহাড়ের পাদদেশের বন,পাহাড়,ঝর্ণায় ঘুরে বেড়ানো মিষ্টি ছেলেটিকে আর খুঁজে পাওয়া যায় নি। ভাবুক ছেলেটি কি বেঁচে আছে নাকি বেঁচে নেই কেউ তা জানে না। মুরং উপজাতি আজও তার পথ চেয়ে বসে আছে, তারা মনে করে যে, সাদা ঘোড়ায় চড়ে পূর্ব দিক দিয়ে একদিন ফিরে আসবে তাদের ঈশ্বর ক্রামাদি।
মেনলের খোঁজ পাওয়া না গেলেও তিনি যা করে গেছেন তা অবিস্মরণীয় । বিশ্বের ১ভাগ মানুষ হয়তো জানে না মেনলের নাম কিন্তু মেনলে আবিষ্কৃত-বর্ণমালা এবং তার প্রবর্তিত ধর্মমত স্বীকৃতি পেয়েছে। ক্রামা ধর্মের নীতিমালা লিখিত আছে একটি পুস্তকে,২০০ পৃষ্ঠার সেই পুস্তকের বাংলা ও ইংরেজি সংস্করণও রয়েছে।
মেনলে আবিষ্কৃত ক্রামা বা ম্রো বর্ণমালার কম্পিউটার ফ্রন্ট তৈরি হয়েছে। তার আবিষ্কৃত বর্ণমালায় তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পুস্তকও ছাপা হচ্ছে। মেনলের ম্রো বর্ণমালায় স্বাক্ষরতার হার-৭০% এই সব কাজের তত্ত্বাবধানে আছে এন.জি.ও। মুরং জাতি গোষ্ঠির এক সদস্য হয়েও একটু আলাদা ছিলো মেনলে। পৃথিবীর অন্য সবার থেকে তাদের জাতি পিছিয়ে থাকার ব্যাপারে সর্বদা তার ভেতরে দুঃখ ছিলো। মেনলে একক ভাবে তার নিরলস চেষ্টার মাধ্যমে মুরং ভাষার নিজস্ব বর্ণমালা আবিষ্কার করে এবং তাদেরকে নতুন এক ধর্ম আর তার নীতিমালার গ্রন্থ উপহার দেন। মেনলের অবদান ভোলেনি তার জাতির লোকজন। বিদ্যালয়ের হাজার হাজার শিক্ষার্থীরা ভোলেনি তাকে। অনগ্রসর জাতি কে এগিয়ে নেবার তীব্র ইচ্ছা আর চেষ্টা ছিলো মেনলের ভিতরে। প্রকৃতির ভিতরে ঘুরে বেড়ানো ছেলেটি চেয়েছিলো বর্তমান পৃথিবীর অন্য সব জাতি আর ধর্মের মানুষের মত তাদের জনগোষ্ঠীকেও এগিয়ে নিয়ে যেতে, কিন্তু কি কারণে এই মহৎ প্রাণ ২২ বছরের ছেলেটি হারিয়ে গেলো তা আজও সবার মনে প্রশ্ন হয়ে আছে।