এটা প্রায় রোজই ঘটছিল। রোজ রাতে কে যেন দুর্গের দেয়ালে ছবি এঁকে যাচ্ছিল। আকবরের কাছেও খবরটা পৌঁছাল। একদিন স্বয়ং আকবর নিজেই দেখতে এলেন। কি আশ্চর্য ! এতো অদ্ভুত আঁকার হাত! কে এইভাবে এঁকে যাচ্ছে রোজ রোজ?

আকবর খোঁজ নিতে বললেন। একদিন একটি বাচ্চা ছেলেকে হাজির করা হলো।
‘কি নাম তোমার ?’- আকবর জিজ্ঞেস করলেন।
– দশবন্ত।
পিতা কি করেন ?

-পাল্কিবাহক।

আকবর ডাক পাঠালেন আব্দুস সামাদকে। এই আব্দুস সামাদ আকবরের চিত্রশালার প্রধান দায়িত্বে। হিন্দুস্তানের বাঘা বাঘা শিল্পী সামাদের নজরে আসবার জন্যে মরিয়া। ওঁনার নজরে আসা মানেই যে সব কিছু -খ্যাতি ,অর্থ , পরিচিতি। আকবরের চিত্রশালাতে প্রায় একশো জন ভারত শ্রেষ্ঠ শিল্পী ছবি আঁকেন। বেশিরভাগই হিন্দু। কেউ গুজরাত ,কেউ বা রাজস্থান , কেউ বা কাশ্মীর থেকে এসেছেন। সারা ভারত কেন সারা বিশ্বজোড়া খ্যাতি পাওয়া সম্ভব।

সামাদ কিন্তু ইরানের বাসিন্দা। হুমায়ুন যখন শের শাহের কাছে পরাজিত হয়ে পারস্যের সাফাভি রাজ বংশের অধিপতি শাহ তাহমাস্প এর দরবারে গিয়েছিলেন তাব্রিজে তখন তিনি মুগ্ধ হয়ে দেখেছিলেন ইরানের চিত্র কলা।

আমন্ত্রণ জানিয়ে এসেছিলেন মীর সৈয়দ আলী ও এই আব্দুস সামাদকে। ইরান থেকে ওঁরা কাবুল অবধি আসেন। তারপর সসম্মানে ওদের আনা হয় এই মুঘল দরবারে। মীর সৈয়দ আলী ছিলেন তাব্রিজেরই বাসিন্দা। উনি ছিলেন ইরানের বিখ্যাত শিল্পী বেহজাদের শিষ্য। আর সামাদ এসেছিলেন সিরাজ থেকে। দুজনে পারস্য চারুকলার দুই বিশিষ্ট ঘরানা নিয়ে আসেন ভারতে। তুর্কি ঔপন্যাসিক ওরহান পামুক ‘ My name is Red’ উপন্যাসে তাব্রিজ খ্যাত এই অনুচিত্রের কাহিনী তার উপন্যাসের ‘স্ট্রাকচারাল ফ্রেমওয়ার্ক’ রূপে ব্যবহার করেন।

আব্দুস সামাদকে ‘শিরীন কালাম’ উপাধি দেওয়া হয়েছিল অর্থাৎ যার ছবি দেখলে শান্তি পাওয়া যায়। এই সেই সামাদ যার সম্পর্কে উচ্ছাসিত ছিল স্বয়ং হুমায়ুন। হবে নাই বা কেন ? একটি চালের দানার মধ্যে একটি পোলো খেলার মাঠ খেলোয়াড় সমেত কি নিপুণতার সঙ্গে এঁকে ছিলেন সামাদ। আকবর নিজেও যে ওঁর কাছে ছবি আঁকা শিখেছিলেন। জহুরির নজর ছিল আকবরের। পড়তে পারতেন না ঠিকই তবে জাত শিল্পী চিনে নিতেন হাতের টান দেখেই । কিছু একটা ছিল ছেলেটার মধ্যে। তবে বড় চুপচাপ -যেন সব সময় একটা বিষাদে ভুগছে। চোখের ভাষা কেমন যেন উদাস।

আব্দুস সামাদ আসতেই আকবর ছেলেটাকে তাঁর হাতে তুলে দিলেন। ফার্সি ভাষায় বুঝিয়ে দিলেন যে আজ থেকে এ তোমার ছাত্র। কাজ ও শেখা একসঙ্গে চলতে লাগল। তবে এই ছবি আঁকা কিন্তু সহজ নয়। যারা আজকাল দোকান থেকে রঙ তুলি কিনে এনেই ছবি আঁকতে শুরু করে দেন তারা ঠিক ব্যাপারটি বুঝবে না। Miniature Painting বা অনুচিত্রে যে তুলি ব্যবহার করা হয় তা অতি সূক্ষ। শিল্পীদেরই তৈরী করে নিতে হয়। যেমন ধরুন , শিশু কাঠবিড়ালির ল্যাজের একটি চুল দিয়ে তুলি। চামরী গরুর ল্যাজের চুল থেকেও হতো -ওরা বলতো ‘ইয়াক বাল কালাম’ I অনেক ধরণের তুলি লাগে। কাগজও তৈরী করতে হয়। রঙ সব প্রাকৃতিক। সেই রঙ তৈরী করাও কম ব্যাপার নয়। তারপর নাস্তালিক রীতিতে ফার্সি ভাষায় লেখা- যাকে বলা হতো ক্যালিগ্রাফি । সবকিছুই অনেক সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। অসম্ভব ধৈর্য ও সাধনা দরকার। আর উস্তাদ হওয়া মানে তো বিশাল ব্যাপার। নাস্তালিকে এক একটা ছোট লাইন লিখতেই প্রায় ৪০-৪৫ দিন সময় লেগে যেত। ভেবে দেখুন তা হলে একটা ছবি আঁকতে কতদিন লাগতে পারে?

Umar Defeats a Dragon, from the epic Hamzanama manuscript

যাইহোক , ছেলেটি খুব উন্নতি করছিল। সামাদের রীতি একেবারে রপ্ত করে ফেলেছিল ছেলেটি। একেবারে স্বয়ং জাঁহাপনার প্রিয় শিল্পী হয়ে ওঠাও কম কথা নয়। সেই সময় দুজন শিল্পীর নামই বেশি শোনা যেত। আরেকজন অবশ্যই বাসওয়ান। ছবিতে অনেক চরিত্র হ্যান্ডেল করতে পারতো দশবন্ত। কিন্তু ছবির মধ্যে কোথাও যেন একটা বিষাদ ভাব ছিল । একটা অদ্ভুত বৈকল্য। যেন অনেক ভাবায় , কোথাও যেন একটা স্বপ্নের মায়াজাল। তন্ত্রের একটা প্রভাব ছিল আঁকাতে। না এসব সামাদ তাকে শেখায়নি। ওটা ওর নিজস্বতা। বাসওয়ান কিন্তু বেশ বোল্ড স্ট্রোকের শিল্পী।

দশবন্ত প্রতিভাধর শিল্পী হলেও একটু খামখেয়ালি গোছের। কারও সঙ্গে বেশি কথা বলতো না , একটু একা একা থাকতো। মাঝে মাঝে অদ্ভুত আচরণও করতো। আকবর সবই জানতেন। মর্যাদাও দিয়েছিলেন। উস্তাদ করা হয়েছিল তাকে। মুদ্রার নকশা করারও দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। বিশাল সম্মানের ব্যাপার। একজন শিল্পী তার জীবনে আর কিই বা চাইতে পারে ? তবে আবুল ফজল কিন্তু এই অদ্ভুত খামখেয়ালি শিল্পীর থেকে বাসওয়ানকেই বেশি পছন্দ করতেন।

আসতে আসতে দশবন্ত যেন কেমন হয়ে যেতে আরম্ভ করলেন। কখনও সারা রাত জেগে ছবি আঁকেন। কখনও আবার তার দেখা পাওয়া যায়না। একদিন হটাৎ জাঁহাপনার কাছে খবর এলো দশবন্ত আত্মহত্যা করেছেন। বোধহয় খুব বেশি প্রতিভাধর লোকেরা বেশিদিন বাঁচে না যেমন শেলি বলেছেন -“Whom the gods love, die young.”I

Arjun hits the fish by Artist Daswanth and kesho

আবুল ফজলের লেখা আইন -ই -আকবরী তে কেবল মাত্র একটি লাইনই লেখা হয়েছে দশবন্ত সম্বন্ধে :
” Then there was Daswant, the son of a palanquin-bearer (kahar), who was in the service of his workshop and urged by a natural desire, used to draw images and designs on the walls. One day the far reaching glance of His Majesty fell on those things and in its penetrating manner, discerned the spirit of a master working in them. Consequently, His majesty entrusted him to the Khwaja (Abd-ul Samad). In just a short time he became matchless in his time and most excellent (sar-amad- i ruzgar), but the darkness of insanity enshrouded the brilliance of his mind and he died, a suicide. He has left several masterpieces.”

এক ব্যক্তি কাশ্মীরের একটি দোকানে একটি ছবি পায়। ছবিটি পরীক্ষা করে দেখা যায় ওটা ১৫৬৪ সালে আকবর ‘হামজানামা ‘ নামক একটি সচিত্র পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করতে নির্দেশ দেন তারই একটি ছবি। এই সচিত্র পাণ্ডুলিপি তৈরী করতে সময় লেগেছিল ১৫ বছর। ইরান ,মধ্য এশিয়া ও ভারতের বহু শিল্পী এই প্রকল্পে যোগ দেয়। বইটি দাস্তান এ হামজা নামক কাল্পনিক এক গল্পমালা। প্রায় ১৪০০ ছবি সহ এই বইটি চিত্রশিল্পের এক অনন্য দিশারী। ছবিটি পৌঁছায় ক্রিস্টির নিলামে। বিশে অক্টোবর দুহাজার ষোলো সালে ছবিটি বিক্রী হয়। বেস প্রাইস ছিল ২,০০,০০০-৩,০০,০০০ ব্রিটিশ পাউন্ড। শেষ অবধি ছবিটির দর ওঠে ৮,২১,০০০ ব্রিটিশ পাউন্ড যা প্রায় সাড়ে সাত কোটি টাকার কাছাকাছি। ছবিটি দশবন্তের আঁকা। আর আমাদের দেশে আকবরের নির্দেশে আঁকা মহাভারত রয়েছে জয়পুর সিটি প্যালেসে। বহু অনুরোধ সত্ত্বেও আমি তা দেখতে অবধি পাইনি। খুব আফসোস হয়েছিল আমার। তবে পরে শুনলাম বিশ্বের তাবড় তাবড় মুঘল কলা শিল্প বিশারদও দেখতে পায়নি।

The wounded monkey bites prince from Tutinama by Daswanth

সাহিত্যের পরিমণ্ডলেও এসেছেন দশবন্ত। সালমান রুশদি তার বিখ্যাত উপন্যাস The Enchantress of Florence এ বেশ কয়েক পৃষ্ঠায় এই শিল্পীর কথা তুলে ধরেছেন। তবে সেটা Magic realism I অতএব সেখানে দশবন্তের আত্মহত্যা একেবারে অন্য ভাবেই তুলে ধরা হয়েছে। ওই উপন্যাসের একটি লাইন মনকে বড় আবিষ্ট করে – ” A dreamer could become his dream” I

স্বপ্নের মায়াজাল বুনতে বুনতে কখন যে সে স্বপ্নের ভিতরই প্রবেশ করেছিল আর ফেরা হয়নি I

কলমে লেখা শুভদীপ সান্যাল , পেশায় শিক্ষক , হেরিটেজ কর্মী।

(To recreate the story of Daswanth, I had to take recourse to numerous books on Mughal paintings and also had to take the help of many experts in this field both in our country and abroad. I thank them all. I also used some imagination in this rendering based on the very scanty material available in this regard. )
* Picture Courtesy : Christies.com
* Picture description : The rukh carries Amir Hamza to his home. Attributed here to Daswant (Dasavanta) in collaboration with Shravan (Shravana), Mughal India, circa 1564. Painting 25⅛ x 21 in (63.5 x 53.1 cm), folio 27¾ x 20⅞ in (70.7 x 53 cm). This lot was offered in Art of the Islamic and Indian Worlds on 20 October 2016 at Christie’s in London, King Street and sold for £821,000.