মুঘল ও ডেকান কলমের শিল্পীদের আঁকা বিভিন্ন ছবি থেকে ডাচ শিল্পী রেমব্রান্ট হার্মেন্সজ (১৬০৬-৬৯) মুঘল ও দক্ষিণভারতের মুসলিম শাসক ছাড়াও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের পঁচিশটি ছবি এঁকেছিলেন। যা ছিল মূল ছবির প্রোটোটাইপ, আবার অন্যমতে তা ছিল শিল্পীর সৃজনশীল প্রতিলিপি। বর্তমানে তাঁর আঁকা ওইসব ছবির মধ্যে মাত্র তেইশটি ছবির খোঁজ পাওয়া যায়, যা বিশ্বের চিত্রকলার জগতে রেমব্রান্টের ‘ভারতীয় অনুপ্রেরণা’র অ্যালবাম বলে পরিচিত। আমস্টারডাম শহরে রেমব্রান্টের আঁকার ষ্টুডিও বা চিত্রশালার নাম ছিল কুনস্টকাম্মের (অর্থ, কৃত্রিম ঝুঁটি), ১৬৫৬ সাল থেকে ১৬৬১ সালের মধ্যে তিনি এশিয়ান কাগজে ওই পঁচিশটি ছবি এঁকেছিলেন। আরেন্ট ডি গেল্ডার (১৬৪৫-১৭২৭) ছিলেন রেমব্রান্টের শিষ্য, ১৬৬০ সালে রেমব্রান্টের স্টুডিওতে যোগ দিয়েছিলেন। তাই রেমব্রান্টের ভারতীয় অনুপ্রেরণা’র অ্যালবামে তাঁরও ভূমিকা ছিল।
রেমব্রান্টের আঁকা ‘ভারতীয় অনুপ্রেরণা’ অ্যালবামের কথা বিশ্বের মানুষ প্রথম জানতে পারে ১৭৪৭ সালে, রেমব্রান্টের মৃত্যুর পর তাঁর একমাত্র নাতি ছোট জোনাথান রিচার্ডসন (১৬৯৪-১৭৭১) তাঁর সমস্ত শিল্পকর্মের উত্তরাধিকারী হয়েছিলেন। রেমব্রান্টের ছেলের নাম ছিল জোনাথান রিচার্ডসন (১৬৬৫-১৭৪৫), তিনি বড় জোনাথান রিচার্ডসন নামে পরিচিত। রেমব্রান্টের মৃত্যুর পর তাঁর নাতি ছোট জোনাথান রিচার্ডসন, শিল্পীর আঁকা পাঁচ হাজার ছবির উত্তরাধিকারী হয়েছিলেন। ১৭৪৭ সালের বাইশে জানুয়ারি থেকে এগারোই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত লন্ডনের কনভেন্ট গার্ডেনে ক্রিস্টোফার ককের নিলাম কক্ষে রেমব্রান্টের আঁকা ওই পাঁচহাজার ছবি নিলাম করা হয়। নিলামের জন্য যে তালিকা প্রকাশিত হয়েছিল, সেই ক্যাটালগে রেমব্রান্টের আঁকা ‘ভারতীয় অনুপ্রেরণা’ অ্যালবামের উল্লেখ ছিল এবং সূচির নাম ছিল ‘A Book of Indian Drawings, by Rembrandt, 25 in number’। যদিও ছোট জোনাথান রিচার্ডসনের তালিকায় একুশটি ছবি স্থান পেয়েছিল। রেমব্রান্টের আঁকা ভারতীয় তীরন্দাজ ও আওরঙ্গজেবের প্রতিকৃতি ওই বিক্রির তালিকায় ছিল না। পরবর্তী সময়ে ওই দুটি ছবি বিভিন্ন হাত ঘুরে আমস্টারডাম শহরে রিজক্স মিউজিয়াম এবং কেমব্রিজের হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে ফগ শিল্প সংগ্রহশালায় স্থান পায়। রেমব্রান্টের আঁকা ‘ভারতীয় অনুপ্রেরণা’ অ্যালবামের তেইশটি ছবির খোঁজ পাওয়া গেলেও আরও দুটি ছবির খোঁজ আজও পাওয়া যায়-না।
সম্ভবত রেমব্রান্ট তাঁর অ্যালবামের মাধ্যমে ভারতীয় চিত্রকলার প্রচারক হিসাবে পরিচিত হতে চেয়েছিলেন। অথবা, এক ওলন্দাজ শিল্পী ভারতীয় উপমহাদেশের স্বর্ণযুগের শিল্পীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানবার জন্যই ওইসব ছবি এঁকেছিলেন। শাকিল বাদাউনির লেখা আখতারী বাঈয়ের একটা গজল বড় দাগ কেটে যায়-
‘মেরে হমনা ফস মেরে হমনাওয়া
মুঝে দোস্ত বন-কে দাগা না দে
মেঁ হুঁ দরদে ঈশক-সে জাঁবলব্
মুঝে জিন্দেগী কি দোঁয়া না-দে’।।
রেমব্রান্টের আঁকা ভারতীয় উপমহাদেশের ওইসব ছবি যেন আমাদের কাছে হৃদয়ের আখতারি বাঈ। পৃথিবীর মাটিতে সেই হৃদয়ের আসন ছিল-না। হয়ত সরোবরে চাঁদের ছায়া দেখতে দেখতে রেমব্রান্ট নিজেই চাঁদ হতে চেয়েছিলেন। যেন বহ্নিমান পর্বতের চূড়া-যেখানে মেঘ শুধু গর্জন করে-না, বর্ষণও করে। হয়ত তাই, রেমব্রান্টের ‘ভারতীয় অনুপ্রেরণা’ অ্যালবামের নারী চরিত্রেরা গেয়ে ওঠেন-
‘আজ্ যা-নে কি জিদ না করো
ইহুঁ-ই পহেলু-মে বৈঠে র-হো-‘