Claude Debussy বলেন ‘সংগীত প্রকৃতির সৃষ্টি’। Antonio Vivaldi মতে, ‘সকল গানের একটাই উৎস প্রকৃতি’। ‘আমার সংগীত আমার স্বদেশের প্রতিধ্বনি বহন করে’ হচ্ছে Johannes Brahms বক্তব্য । আর আমাদের শচীন কর্ত্তা বলেছেন,- বাংলাদেশের প্রকৃতি তার গানের শিক্ষক। আজ আমরা বলতে চাই প্রকৃতির সংগীত সাধক শচীন দেব বর্মণের কথা। একটা মানুষ যে প্রকৃতিতে বড় হয়ে ওঠে; সে সেই প্রকৃতিকেই ধারণ করে। যে কোনো ব্যক্তির জীবনে তার ভৌগলিক পরিমন্ডল অনেক বড় ভূমিকা রাখে- অর্থাৎ মানুষ তৈরিতে প্রকৃতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কুমিল্লার শচীন কর্ত্তা তার ছোটবেলায় ক্ষেতের কৃষক, গরুর রাখাল, নদীর মাঝির কাছ থেকে সুর ধারন করেছে। তাইতো একদিন প্রমথেশ বড়ুয়াকে তিনি বলেন, “বহতা নদীর জলের নরম গতির থেকে তিনি সুর ধার করেন; খরস্রোতা পানির খলখল আওয়াজ থেকে না।” কবি উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ এর মত তিনিও বিশ্বাস করতেন, ‘প্রকৃতিতেই সব সুর লুকিয়ে রয়েছে। আমাদের শুধু কান পেতে থাকতে হবে তা শোনার জন্য।’ তিনি আরো বলেন, সবদেশের লোকসঙ্গীতের উৎস ও প্রাণ এক এবং তাদের মিলিয়েই নতুন নতুন হাজারো সুর তৈরি করা সম্ভব।
এই কিংবদন্তি শিল্পী তার সঙ্গীত জীবন শুরুর সময় অল ইন্ডিয়া রেডিওতে একজন বৃটিশ ডাইরেক্টরের কাছে গিয়েছিলেন, সেই ডাইরেক্টর তাকে পিয়ানো শেখার জন্য পরামর্শ দেন। তার মতে, এতে করে পাশ্চাত্য ও ভারতের উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের বিভিন্ন দিক তিনি সহজে আয়ত্বে আনতে পারবেন। শুরু হলো, পার্ক স্ট্রিটের এলভিন সেনের কাছে পিয়ানো শিক্ষার জীবন। ওখানে একজন লম্বা করে সুদর্শণ যুবক ঠোঁঠে সিগারেট নিয়ে পিয়ানো শিখতে আসতো; তাকে দেখে সে বিমোহিত হতো এবং তিনিই ছিলেন ভবিষ্যতের সত্যজিৎ রায়।
চট্টগ্রামের মেঠো পথের নারীদের কন্ঠ গাওয়া গান শচীনকে আন্দোলিত করেছিল এবং ঐ চট্টগ্রামের মেয়েদের কাছ থেকেও তিনি সুর শিখেছিলেন। তাঁর মধ্যে ছিল ভীষন অধ্যাবসায়। একটি গান তিনি বহুবার তৈরি করতেন। বিঠোভেনের মত তিনি কম্পোজ, ডিকম্পোজ এবং আবার রিকম্পোজ করতেন। তাঁর গান তার নিজের কাছে যতক্ষন পর্যন্ত না পারফেক্ট মনে হত, ততক্ষন তিনি পুনরায় রেকর্ড করতেন। এমনকি একটা গানকে তিনি ১০/১১ বারও রেকর্ড করতেন। চলুন তাহলে, আমরা ঘুরে আসি আমাদের কুমিল্লার শচীনদেব কিভাবে ভারতীয় উপমহাদেশের কিংবদন্তী সঙ্গীতজ্ঞ হলেন l
এটা খুব একটা পুরনো ইতিহাস নয়। ব্রিটিশদের সময়। সেই সময় ভারতে রাজা-জমিদাররা শাসন করছে। ভারতের রাজবংশের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন ত্রিপুরা রাজবংশ। যার মধ্যে অন্যতম দেববর্মন রাজপরিবার। তারা ১৫০০ বছর ধরে শাসন করছিল। এই রাজবংশে ১৮৪ জন রাজা হয়েছিল। যাদের উদাহরণ দ্বিতীয়টি আর নেই। এর সীমানা ছিল আসাম থেকে বাংলাদেশের কুমিল্লা পর্যন্ত বিস্তৃত। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পর ১৮০ তম রাজা ঈষাণ চন্দ্র মারা যাওয়ার আগে নিজের ছেলে নবদ্বীপকে বঞ্চিত করে তার ভাই বীরচন্দ্রকে উত্তরাধিকার দিয়ে যান। এতে প্রজারাও খুব আশ্চর্য্য হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে চাচা বীরচন্দ্র তার নিজের সন্তানের সময় আর ভুল করেন নি। তিনি তার ছেলেকেই উত্তরাধিকারি রাজা হিসেবে মনোনিত করেন। কী আর করা! তার ভাতিজা নবদ্বীপ উপয়ান্তর না দেখে আদালতে মামলা করেন এবং মামলায় তিনি হেরে যান। এক্ষেত্রে মামলাই তিনি শুধু পরাজিতই হননি; নিজ রাজ্য থেকে বিতাড়িত হলেন মুচলেকা দিয়ে। তিনি জীবনে আর রাজা কিশোর চন্দ্রের রাজ্যে প্রবেশ করতে পারবেন না; এই শর্তে মাসিক মাত্র ৫২৫ টাকা বেতনে কুমিল্লায় চলে আসতে বাধ্য হন এবং কুমিল্লা শহরে চর্থা এলাকার গোলপুকুর পাড়ে বসবাস শুরু করেন।
শুরু হলো কুমিল্লার জীবন। সেখানে তিনি গড়ে তোলেন কুমিল্লা প্রাসাদ। যাত্রিপুরা রাজবাড়ী নামে তা পরিচিত। সেই রাজবংশেরই ছেলে শচীনদেব বর্মণ। বাবা নবদ্বীপচন্দ্র দেববর্মণ ছিলেন নিপুন সেতার বাদক ও মার্গ সঙ্গীতের গায়ক এবং মা মণিপুরি রাজবংশের মেয়ে নিরুপমা দেবীও ছিলেন সঙ্গীতের প্রতি অনুরক্ত; তাদের ঘরেই মহারাজ শচীনদেব জন্ম নেয় ১৯০৬ সালের ১ অক্টোবর। মা ও বাবার কাছেই সঙ্গীত শিক্ষা শুরু করেন। তার গলার স্বর ছিল আলাদা। কিছুটা নাকে গলার কণ্ঠস্বরের জন্য তিনি তার শ্রোতাদের কাছে বিশেষভাবে পরিচিত। তার এই সুরের মূর্ছণা ছিল অসাধারণ ও ব্যতিক্রম।
শচীনের প্রথম স্কুল ত্রিপুরার আগরতলায় কুমার বোর্ডিংয়। এটি ছিল রাজকন্যার ছেলে এবং অত্যন্ত ধনী ব্যক্তিদের জন্য। পিতা নবদ্বীপচন্দ্র দেববর্মণ লক্ষ্য করেন যে, শিক্ষকরা শিক্ষা দেয়ার চেয়ে অভিজাত ছেলেমেয়েদের নিয়ে ব্যস্ত থাকত। তাই তিনি তাকে বোর্ডিং থেকে নিয়ে গিয়ে কুমিল্লার ইউসুফ স্কুলে ভর্তি করেন। এরপর কুমিল্লা জিলা স্কুল থেকে ১৯২০ সালে ম্যাট্রিক পাস করার পর শচীন কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজে ভর্তি হন, সেখান থেকে ১৯২২ সালে আইএ এবং ১৯২৪ সালে বিএ পাস করেন। তারপর এসডি বর্মণ চলে যান কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ পড়তে, কিন্তু তিনি পড়া শেষ করেননি, কারণ সংগীত তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে।
তার আত্নজীবনী ‘সরগমে নিখাদ’ থেকে জানা যায়, গ্রামবাংলার লোকসঙ্গীতের প্রতি তাকে প্রথম আকৃষ্ট করেন, তাদের বাড়ীর দুই গৃহকর্মী মাধব ও আনোয়ার। মাধব সহজ সুর করে রামায়ন পড়ে ও র্কীর্তন গেয়ে শোনাত; যা তাকে মোহিত করত। অপরদিকে আনোয়ার দোঁতারা বাজিয়ে ও ভাটিয়ালি গান শুনিয়ে তাকে গ্রামবাংলায় নিয়ে যেত। ধীরে ধীরে ছোট শচীন বড় হয়। ১৯২৩ সালে আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রে তিনি প্রথম গান করেন। কিন্তু বাবার ইচ্ছা তিনি আইন বিষয়ে পড়াশোনা শেষ করুক। রাজপরিবারও তার গানের বিরোধিতা করে। কিন্তু হায় ,১৯৩১ সালে পিতা নবদ্বীপ চন্দ্র কলকাতায় দেহত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তিনি ছিলেন ত্রিপুরার প্রধানমন্ত্রী। শচীনদেব তখন থাকতেন কলকাতার ত্রিপুরা প্যালেসে। নিজের লেখা আত্মজীবনীতে শচীন লিখেছেনঃ “পিতার মৃত্যুর পর আমি যেন অগাধ জলে পড়ে গেলাম। এই অবস্থায় আমি আগরতলা বা কুমিল্লা গিয়ে থাকলে রাজকীয় আরামে ও নিশ্চিন্তে নিজেদের বাড়িতে বাস করতে পারতাম এবং রাজ্য সরকারের কোন উচ্চপদে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারতাম। আমার বড় ভাইয়েরা আমাকে তাই করতে বলেন। আমার কিন্তু তা মনঃপূত হয়না। নিজে একলা সংগ্রাম করে, নিজে উপার্জন করে সঙ্গীত সাধনায় জীবন কাটিয়ে দেব। মনের মধ্যে এই একমাত্র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে কলকাতার ত্রিপুরা প্রাসাদ ছেড়ে ভাড়া করা সামান্য একখানা ঘরে আমার আস্তানা বাঁধলাম।”
তিনি অবশ্য মুষড়ে পড়েননি। রাজপরিবারের সদস্য হয়েও ছোটবেলা থেকে নানা প্রতিকূলতাকে জয় করেই তাকে আসতে হয়েছে। রণে ভঙ্গ দেয়ার মানসিকতা তার ছিলনা। ১৯৩২ সালে ভারতের বিখ্যাত রেকর্ড প্রকাশনী প্রতিষ্ঠান এইচএমভিতে অডিশন দিলেন শচীন, কিন্তু তার গলার স্বর ‘নাকী নাকী’ বলে এস মুখার্জি তাকে বাদ দিয়ে দেন। মজার বিষয় হলো, একই দোষে ১৯৩০ সালে শিল্পী সায়গলও বাদ পড়েছিলেন। শচীনের অনেক স্বপ্ন ছিল এইচএমভি থেকে তার গান প্রকাশ করতে। কারণ সেই সময় এইচএমভি ছিল সবচেয়ে নামকরা প্রতিষ্ঠান। তিনি হালছাড়ার পাত্র নন। তিনি একের পর এক অডিশন দিতে থাকেন। ঠিক তখুনি ঐ বছরই চন্ডীচরণ সাহা জার্মানী থেকে নতুন মেশিন এনে ‘হিন্দুস্তান মিউজিক প্রোডাক্টস’ নামে নতুন প্রতিষ্ঠান খুলে নতুন গায়কের জন্য বিজ্ঞাপন দেন। শচীন সেইখানে অডিশন দিয়ে চান্স পান এবং সেই বছরই শচীনের প্রথম রেকর্ড হিন্দুস্তান মিউজিক থেকে বের হয়। এ সময় তিনি পল্লীগীতি গেয়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। তিনি নজরুলের কথা ও সুরে ৪ টি গান রেকর্ড করেন।
সময় এগিয়ে যায়। এরপর, এলাহাবাদে ১৯৩৪ সালে অল ইন্ডিয়ান মিউজিক কনফারেন্সে তিনি গান গেয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। শিল্পী সাইগলও ঐ মঞ্চে গান করেন। সাইগলের গান ছিল প্রথমে। গান গেয়ে মঞ্চ ছেড়ে যখন তিনি চলে যেতে থাকেন তখন শচীন গান শুরু করলেন, সাইগল সাহেব ওখানেই দাড়িয়ে যান এবং নিশ্চুপ ও তন্ময় হয়ে শোনেন নতুন এই প্রতিভার কন্ঠ। সেই থেকে সাইগলের সাথে শচীনের গভীর বন্ধুত্বের সম্পর্ক হয়ে যায়। প্রায় একশো বছর পরেও বাংলা গানের শ্রোতাদের কাছে তার কালোত্তীর্ণ গানের আবেদন কিছুমাত্র কমেনি। কেবল সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে নয়, গীতিকার হিসেবেও তিনি সার্থক। ‘সুর মন্দির’ নামে একটি সংগীত স্কুল দিয়েছিলেন। সেখানে তার এক ছাত্রী ছিল মীরা। তিনি তার প্রেমে পড়ে যান। ১৯৩৮ সালে কলকাতায় তাঁর সেই ছাত্রী মীরা দাশগুপ্তকে বিয়ে করেন। মীরা ছিলেন ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট রায়বাহাদুর কমলনাথ দাশগুপ্তের নাতনি। তিনি যখন মীরাকে নিয়ে ত্রিপুরার রাজপরিবারে আসেন, তখন কোন রাজ-রমণী এসে তাকে অভ্যর্থনা জানায় নি। এর ফলে, শচীনের মনে অনেক ক্ষোভ ও অপমানবোধ হয়। অনেকের মতে, এই বিয়ে রাজপরিবারের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল এবং পরবর্তীকালে তিনি তার পরিবারের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন। আসলে ত্রিপুরার রাজপরিবার তাঁর বাবা এবং তাঁর ভাইদের সাথে যে অবিচার ও অন্যায় আচরণ করেছিল তাতে তিনি অনেক আগে থেকেই হতাশ ছিলেন। নতুন বিবাহিত জীবন ভীষণ সুখের ছিল। ১৯৩৯ সালে তাদের ঘরে জন্ম নেয় একমাত্র সন্তান রাহুল দেব বর্মণ।
আবার ফিরে যেতে হবে ফ্ল্যাশব্যাকের মাধ্যমে শচীনদেবের কৈশোরের দিনগুলোতে, কুমিল্লাতে, সেখানেই তিনি আবদ্ধ হন সুরের মায়ায়। চেতনায় জাগ্রত হয় বাঁশের বাশি, ভাটিয়ালি সুর, মাঝি মাল্লাদের জীবন ও জীবিকার সুর, গোমতী নদীর অপরূপ ছন্দ, কুমিল্লার গাছ-গাছালি, নদী-নালা আর মাটির গন্ধমাখা সুর। তার আত্মকথায় বলেছেন “কেন জানিনা জ্ঞান হওয়ার সঙ্গেসঙ্গে মাটির টান অনুভব করে মাটির কোলেই থাকতে ভালোবাসতাম। আর বড় ভালো লাগত সেই সহজ সরল মানুষগুলোকে, সবাই যাদেরকে সাধারণ লোক বলে থাকে। অসাধারণের দিকে না ঝুঁকে আমি ওই সাধারণ লোকের মাঝেই নিঃশেষে বিলিয়ে দিয়ে তাদের সঙ্গে একহয়ে গেলাম শৈশব থেকেই”। তিনি মনে-প্রাণে বাঙালি ও বাংলাদেশি। রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুল গীতি ও বাংলার অনেক গানের সুন্দর সুর নিয়ে তিনি হিন্দি ছবির গানকে সমৃদ্ধ করেছেন। শচীনদা অনেক বাংলা গানে সুর দিয়েছেন।
“কে যাসরে ভাটির গাঙ বাইয়া….” – গানে গ্রাম্য সমাজের একজন নারীর জীবনের আকুতি ফুটে উঠেছে। গানটির মধ্যে বাংলার প্রকৃতির কথা, নদীর কথা, মাঝির কথা, এবং জোয়ার-ভাটার নদীতে একজন মাঝির নৌকা বেয়ে যাওয়ার সময় যে ক্লান্তি, দুঃখ, কষ্ট তা তাঁর সুরের মাদকতায় এক অপরূপ ছবি তৈরি হয়েছে। “শোনগো দখিনো হাওয়া প্রেম করেছি আমি”- এই প্রেমের গানটিতে তিনি অত্যন্ত সুন্দরভাবে লোকসুরের ব্যবহার করেছেন। তাঁর গানে বাংলার ঢোল, মৃদঙ্গ, বাঁশি, কাঁসা, মন্দিরা, সানাই ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করে এবং ধ্রুপদ ছন্দকে মিল করে সংগীতের এক নতুন মাত্রা সৃষ্টি করেন। তালের নাম ধ্রুপদ হলেও ছন্দটা বাংলাদেশের; চলনটাও ঠিক সহজ-সরল বাংলার মেঠোপথের মতো। তাই সাধারণ মানুষকে সহজেই তাঁর গান আকৃষ্ট করে। বাংলার লোকসংগীত বাংলাকে বিশ্বদরবারে আলাদা করে পরিচয় করিয়েছে। সেই সবুজ ঘেরা নদীমাতৃক বাংলার মানুষ, জন্মসূত্রেই যিনি বাংলাদেশি, যাঁর গানের মধ্যে ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া ও বাউল গানের সুরই প্রধান; তিনিই শচীন দেব বর্মণ। একজন সেরা পেশাদার সঙ্গীত পরিচালকের মাঝে যেসব গুণ না থাকলে নয় তার সবই ছিল তার মাঝে।
শচীনের গড়ে তোলা শিল্পীদের মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় ছিলেন লতা মঙ্গেশকর। কিন্তু তার সাথে তার মতবিরোধ হলে আশা ভোঁসলে সুবিধা পায়। এছাড়া কিশোর কুমার তারই সৃষ্টি। ১৯৭৫ সালে প্যারালিটিক স্ট্রোক হয়ে শচীনদেব বর্মন কোমায় ছিলেন পাঁচ মাস। অবশেষে ৩১ অক্টোবর এই কিংবদন্তি সুরস্রষ্টা ও শিল্পীর জীবনাবসান ঘটে । সম্প্রতি, সঙ্গীতজ্ঞ শচীনের কুমিল্লার ৬০ একর জমির উপর ধ্বংসপ্রাপ্ত পৈত্রিক বাড়িতে সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ও জাদুঘর গড়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়।
তিনি পড়তে খুব পছন্দ করতেন। তিনি নানান দেশের নানা রকমের গান শুনতে ভালোবাসতেন। তিনি মাঝে মাঝে কিটসকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলতেন, my name write on water. তিনি শেলি, বায়রন ও কিটসের কিছু কবিতা নির্বাচন করে তার সুরও দিয়েছিলেন। কিন্তু সে কাজ তিনি মৃত্যুর আগে শেষ করে যেতে পারেন নি।
এত যার অবদান, এত যে সার্থক, তার মনে সব সময় ভয় ছিল; ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তাকে মনে রাখবে কিনা? একবার একজন সাংবাদিককে তিনি আবেগ ভরা কন্ঠে বলেন যে, ‘মোজার্ট, বিঠোভেনকে যেমনভাবে মানুষ আজো মনে রেখেছে; হয়তো তাকে কেউ মনে রাখবে না।’ আমরা জোড় গলায় বলতে পারি, আমাদের কুমিল্লার সন্তান; কুমিল্লার আলো-বাতাস-নদীর জলে বড় হওয়া শচীন দেবকে কেউ ভুলে নাই। তার স্মৃতি অমর হয়ে আছে। তার সুর জীবন্ত হয়ে আছে। তার গান আমাদের আন্দোলিত করে; আপ্লুত করে। আমাদের সন্তানেরা তারই গান গায়। তিনি আরো হাজারো বছর বেঁচে থাকবেন আমাদের ভবিষ্যৎ সন্তানদের কাছে। তিনি ভারতীয় উপমহাদেশের বাংলা ও হিন্দী গানের কিংবদন্তীতুল্য ও জনপ্রিয় সঙ্গীত শিল্পী। তাকে এসডি বর্মণ হিসেবেই সবাই চেনে। তার জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে রয়েছে- ‘শোনগো দখিন হাওয়া’, ‘তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল’, ‘ডাকিলে কোকিল রোজ বিহানে’ ‘এ পথে আজ এসো প্রিয়’ ইত্যাদি।