চিকেন বা বীফের পুরে ভর্তি সমুচা কার না পছন্দের।বর্তমান সময়ের লোভনীয় এই মুচমুচে খাবার টি নাস্তা হিসেবে খেতে চায় না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। জানেন কি এই নাস্তার আদি জন্মস্থান কোথায়? কেউ কেউ হয়ত বলতেও পারবেন। আজকের দিনের কিরগিজিস্তানের রাজধানী বিশকেক -এ প্রথম তৈরি হয়েছিল এই খাবারটি।ভেড়ার মাংসের কিমা ও চর্বির পুরু স্তর দেওয়া নাস্তাটি ত্রিকোণাকারে তৈরি করা হতো তখন। সুফি পন্ডিত কবি ও গায়ক আমির খসরু তখনকার দিনের অভিজাত মুসলিম শ্রেণীর ভোজের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন– মাংস ও পেঁয়াজকে ময়দায় পুরে গাওয়া ঘিয়ে ডুবিয়ে সমুচা ভাজা হতো। ১৩ শতকে নাস্তা হিসেবে সমুচার উদ্ভব হয়। পরবর্তীতে নানান দেশ ও অঞ্চলে এই ত্রিকোণাকার নাস্তাটির প্রচলন হয়। এলাকা ভেদে বিভিন্ন নামেও ডাকা হতো একে। কোথায়ও সামবুসাক,কোথাও সামুসাক, কোথাও সামোসা আবার কোথাও সমুচা ইত্যাদি। সন্ধ্যা হতে না হতেই রাজধানী বিশকেের রেস্টুরেন্ট চত্বরে মানুষের ভিড় লেগে যেত। আগতদের প্রত্যেকের হাতে থাকতো কাগজের তৈরি মোড়ক, আর মোড়কে থাকতো মুখরোচক এই সমুচা।
বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতার ভ্রমণকাহিনিতেও এই খাবারটির উল্লেখ আছে। তিনি লিখেছেন, ‘চীনে মাটির থালায় ঘি, পেঁয়াজ, কাঁচা আদা দিয়ে ভাজা মাংস পরিবেশন করা হতো… একে বলা হতো সামুসাক; এতে কিমা মাংসের পুরের সাথে আরো দেওয়া হতো কাঠবাদাম, কাজু, পেস্তা ও অন্যান্য মশলা। তারপর পাতলা রুটিতে মুড়ে ঘিয়ে ভাজা হতো। প্রত্যেকের পাতে সাধারণত চার থেকে পাঁচটি সামুসাক পরিবেশন করা হতো।’
বর্তমান সময়ে যে কোন রান্নার রেসিপি পাওয়া কোন বিষয়ই নয়। একদম আনকোরা যে কেউ ইচ্ছা করলে যে কোন রান্না খুব অনায়াসে রেঁধে ফেলতে পারেন। তা সেটা হোক কোন মেক্সিকান বা সাউথ ইন্ডিয়ান কিম্বা মোঘলাই বা কোরিয়ান রান্না। কিন্তু সেই সময়ে কিন্তু অবস্থা এমন ছিল না। সামসার সবচেয়ে প্রাচীন প্রস্তুতপ্রণালীর বর্ণনা থাকা বইটি সংক্ষেপে নিমাতনামা নামেই পরিচিত। এটির একটি কপি খুব সযত্নে রক্ষিত আছে লন্ডনের ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে। ‘কিতাব নিমাতনামা-ই – নাসিরশাহী’ নামের এ বইটির বাংলা তর্জমা দাঁড়ায়- ‘নাসির শাহের সুখাদ্যের বই’। মধ্যযুগের এই গ্রন্থে রয়েছে খাদ্য প্রস্তুত ও পরিবেশনের মিনিয়েচার ছবি, আর তার সাথে হাতে লেখা পাদটীকা।
ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে শেক্সপিয়ারের নাটক সংকলন ‘ফার্স্ট ফোলিও’র পাশেই রাখা আছে বইটির একটি কপি। যার প্রতিটি পাতা আজো মুগ্ধ করে খাদ্য ঐতিহাসিকদের। এমনই একটি পাতায় রয়েছে মাংসের কিমা, শুকনো আদা, রসুন ও বেগুন দিয়ে সামসা তৈরির ছবিসহ বর্ণনা। তবে এতে মুখরোচক খাবারের পাশাপাশি তাদের ইতিহাস, উপকরণ ও ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের উল্লেখ রয়েছে, ঐতিহাসিক তথ্যের বিচারে যা বলতে গেলে অমূল্য এক সম্পদ। তবে সবচেয়ে বিস্ময়কর হলো, ভবিষ্যতে মানুষের খাদ্যরুচি কেমন হবে, তা নিয়েও আন্দাজের চেষ্টা করা হয়েছে এতে।
মালওয়ার সুলতান গিয়াস আল দ্বীন শাহ খিলজি ফার্সি ভাষায় লেখা এই বইটির পৃষ্ঠপোষকতা করেন পরে তার ছেলে নাসির শাহ সে কাজটি শেষ করেন এবং নিজের নামে বইটির নামও রাখেন। ১৪৬৯ থেকে ১৫০০ সাল পর্যন্ত সময়কালের মধ্যে লেখা হয় বইটি। এতে বিভিন্ন খাবারের রেসিপি এর পাশাপাশি ছবি ও আঁকা হতো। কালের পরিক্রমায় এর ৫০ টি ছবি আজও টিকে আছে। রেসিপি ছাড়াও এ ছবিগুলো মুগ্ধ করবে পাঠককে। নিমত নামার অনুবাদকারী নোরাহ টিটলে এই বই সম্পর্কে বেশ কিছু মূল্যবান তথ্য দিয়েছেন এই বইয়ের ছবিগুলো আঁকার সময় শিল্পীকে দিকনির্দেশনা দেয়া হতো। খাদ্যটির রান্না বা পরিবেশনের কোন দৃশ্য আঁকতে হবে তা বলে দেয়া হতো। তিনি আরো বলেন বইটির রেসিপিগুলো পড়ে পাঠকের হয়ত মনে হতে পারে লেখাটি অস্পষ্ট রহস্যময় ও সংক্ষিপ্ত। কারণ হিসেবে আমরা ধরে নিতে পারি যে,সেই সময়ের রান্নাবান্নার অনেক বিষয়ই আজকের যুগের রাঁধুনীদের কাছে অজানা। খাবার কে আরো মুখরোচক করার চেষ্টাও করা হয়েছে এই নিমত নামায়। আর এই চেষ্টা করতে গিয়েই, রান্নায় যোগ হয়েছে নানান রকম নিয়ম, অনুপাত। এভাবে ধীরে ধীরে রান্নাবান্নাকে সূক্ষ্ম অথচ জটিল এক শিল্পের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
নিমত নামার অনুপ্রেরণায় পরবর্তীতে মোঘল যুগেও রান্নার কিছু বই লেখা হয়। আলওয়ান -ই- নিমত, নুশখা -ই -শাহজাহানি এবং আইনি -ই -আকবরি এ রকমই লেখা কিছু গ্রন্থ। এসব গ্রন্থেও নানা রকম খাদ্যের বর্ণনা পাই। নিমত নামার মতো এসব বইও দক্ষিণ এশীয় রান্নাবান্নায় একটি সমৃদ্ধ ঐতিহ্য তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে।
লেখক:
মুনিবা খানম
রাবাব আহমেদ