রাজশাহী শহরের পদ্মা তীরের একসময়কার নীলকুঠিটি পরিচিত এখন ‘কুঠিবাড়ি বলে । নীলকরদের নির্মম অত্যাচার নির্যাতনের মূর্তিমান সাক্ষী এধরণের নীলকুঠি। রবীন্দ্র স্মৃতি বিজড়িত শিলাইদহ কুঠিবাড়িও ছিল এক নীলকুঠি। তবে তা ১৮৩৩ সালে কিনে নেন দ্বারকানাথ ঠাকুর। পদ্মার গতি পরিবর্তনে শংকিত হয়ে নীল কুঠির মালমসলা দিয়েই বর্তমান কুঠিবাড়ি তৈরী করা হয় ১৮৯২ সালে। এই কুঠিবাড়ির নীলকর শেলী সাহেবের নামেই নাম হয় শিলাইদহ। একসময় মূল কুঠিবাড়ির ধ্বংসস্তুপ ও বাগান বাড়ি, পরে শেলী সাহেব ও তার স্ত্রীর কবরও বিলীন হয় পদ্মা গর্ভে।

ভারতবর্ষেই আদি নিবাস নীলের। তাই India থেকে গ্রীসে ও রোমে এর নাম ইন্ডিগো, ইংরেজী indigo। বস্ত্র রঞ্জনে ছিল এর ব্যবহার । ইউরোপে উৎপাদিত অনুরূপ পণ্য ভোড (Woad) এর তুলনায় ভারতীয় নীল ছিল গাঢ় ও উৎকৃষ্ট। তাই এর দাম ও চাহিদা ছিল বেশি। আইন – ই – আকবরি তে এর দাম উল্লেখ আছে প্রতি মন দশ থেকে বারো টাকা। ষোড়শ শতকে বস্ত্র শিল্পের প্রসারে দ্রুত এর চাহিদা বাড়ে। নীল রঙ করার কায়দা জানতো ডাচরা, তাই রঙ জন্য সব বস্ত্র যেতো হল্যান্ডে। ভারতীয় নীল আমদানীর ফলে ইউরোপীয় ভোড (Woad) চাষী ও রঙ ফ্যাক্টরি বেকার হতে থাকলে নীল ঠেকাতে দেশে দেশে প্রবর্তন হয় বিশেষ আইন । ১৫৯৮-তে এর ব্যবহার নিষিদ্ধ হয় ফ্রান্সে। ইংল্যান্ডে নীল বিরোধী আন্দোলনের জেরে নীলকে বিষাক্ত মর্মে রায় দেয়া হয়। ১৬০৯ তে নীল ব্যবহারে মৃত্যুদন্ডের বিধান করেন রাজা চতুর্থ হেনরী।

রাজা চতুর্থ হেনরী

তারপরও অপ্রতিরোধ্য গতিতে বাড়তে থাকে নীলের ব্যবহার। চাহিদার চাপেই নিষেধাজ্ঞা উঠে যায় একে একে। নীলের বিকল্প উদ্ভাবনের চেষ্টাও ব্যর্থ হয়। Woad এর চাষ এবং কারখানা বন্ধ হয়ে যায় ক্রমে। অন্য কোথাও নীলের ব্যবহার জানতো না। বস্ত্র শিল্প তাই হল্যান্ড ও বেলজিয়ামের একচেটিয়া। বেলজিয়াম থেকে নীল রঞ্জক এনে দেশের তন্তুবায়দের নীল রঞ্জনের পদ্ধতি শেখানোর ব্যবস্থা করেন ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় চার্লস। সেই থেকে শুরু বৃটিশ ঈষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নীলের চালান। নীল তখন সংগ্রহ হতো আগ্রা, আহমেদাবাদ আর লাহোর থেকে। বাংলায় তখনো শুরু হয়নি।

কৃষকরা নীল চাষ করেছে

নীল কুঠির মতোই আরেক কুঠি মুর্শিদাবাদস্থ কাশিমবাজার কুঠি। এই কুঠিতে বুনা ষড়যন্ত্রে ১৭৫৭ তে পতন হয় নবাব সিরাজউদ্দৌলাহর, উন্মুক্ত হয় বাংলা লুন্ঠনের ‘স্বর্ণদ্বার। এই লুন্ঠনে স্ফীত ইংল্যান্ডে আসে শিল্প বিপ্লব, কার্পাস শিল্পে হয় বিশ্ব শীর্ষ। বাড়তি চাহিদার যোগান দিতে ইংল্যান্ড থেকে আসা লুটেরা শ্রেণীর ভাগ্যান্বেষীরা ঝাঁপিয়ে পড়ে রাতারাতি বড় হতে। নীল চাষের নামে শতাব্দীব্যাপী লুন্ঠনের এই শুরু। বাংলাদেশে সর্বপ্রথম নীলকুঠি স্থাপন হয় চন্দন নগরের নিকট। ১৭৭১ এ তা স্থাপন করেন লুই বন্নো (Lous Bonnaud) নামে এক ফরাসী বণিক। অভাবনীয় মুনাফা হতে তিনি স্থাপন করেন আরো অনেকগুলো নীল কুঠি। ইংরেজদের মধ্যে ১৭৭৮ এ প্রথম স্থাপন করেন জনৈক ক্যারল ব্লুম। পাদ্রী উইলিয়াম কেরি এদেশে এসে চাকুরী নেন মদনাবতি নীলকুঠির ম্যানেজার হিসাবে।

এর আগে নীল সংগ্রহ করা হতো স্বাধীন রাজ্যগুলো (অযোধ্যা, আগ্রা আর পাঞ্জাব) থেকে । স্বাধীন হলেও নীল ব্যবসার জন্য হস্তক্ষেপ করতো কোম্পানি। অযোধ্যায় নীল ব্যবসার মুনাফা থেকে গড়া দুর্ধর্ষ বাহিনী দ্বারাই কোম্পানি পরাজিত করে পাঞ্জাবকে। বাংলা ও বিহারে নীল চাষ যখন শুরু হয়, ১৭৫৭’র পট পরিবর্তনের পর।  বণিকের থেকে কোম্পানি তখন অবতীর্ণ শাসকের ভূমিকায়। “ বণিকের মানদণ্ড পোহালে শর্বরী, দেখা দিল রাজদণ্ড রূপে।”

উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলায় মঙ্গলগঞ্জ নীলকুঠি

তাই, বাংলায় শুরু থেকেই নীল ব্যবসা ছিলো নিছক শোষণ। ১৮১০ সালে কোলকাতা থেকে পাউন্ড প্রতি ১ টাকা ৪ আনায় কেনা নীল লন্ডনের বাজারে বিক্রি হতো ৫ থেকে ৭ টাকা (১০ থেকে ১৩ শিলিং)।  এই বিপুল মুনাফার কারণেই নীল চাষ উৎসাহিত করতে ব্যবস্থা নেয় কোম্পানি। নীলকর দের দিতো স্বল্প সুদে ঋণ।  এই অর্থই টিপসই নিয়ে দাদন আকারে দেয়া হতো কৃষকদেরকে। এই দাদনই ছিল কৃষকদের গলার ফাঁস।  নীলের দর, জমির পরিমান সবই নীলকররা ঠিক করতো ইচ্ছা মাফিক। ‘চুক্তি’ নামক কাগজে বসিয়ে টিপসই নিয়ে নেয়া।

এদেশে জমি কেনার অধিকার ছিলনা তখন ইউরোপীয়দের। লাইসেন্স নিতে হতো কোম্পানি – সরকারের নিকট থেকে। বেনামীতে জমিদারদের নিকট থেকে অল্পস্বল্প জমি নিয়ে রায়তদের সহায়তায় শুরু করে নীল ব্যবসা। লবণ রেশম আর আফিং এর মতো এর মতো নীল ছিল কোম্পানির একচেটিয়া ব্যবসা। অন্যান্য বাগিচা শিল্প চা, কফি, রাবার নীল আর রেশম চাষ করাতো সাহেবরা নিজেরাই নিজেদের জমিতে। কিন্তু নীল চাষ করতো কৃষকেরা। বিঘা পঞ্চাশেক জমি, কয়েকটি গামলা, কিছু যন্ত্রপাতি নিয়ে নীল প্রস্তুতের ফ্যাক্টরি, – নীলকরদের আবাস, অফিস এবং গোমস্তা, কর্মচারীদের থাকার ব্যবস্থা। সাথে থাকতো নির্যাতনের জন্য নিজস্ব গারদ; এই নিয়েই ছিল নীলকুঠি।

রাজশাহীর এই নীলকুঠির অক্ষত অংশ টুকু নীলকর সাহেবদের আবাস, অফিস। পেছনের অন্যান্য স্থাপনা ধ্বংসস্তুপে পরিণত। কৃত্রিম নীল আবিষ্কারের পর হতে নীল গাছ, নীল পাতা হতে নীল উৎপাদন এখন হৃত ঐতিহ্য। ধঞ্চে গাছের মতো নীল গাছ হয় চার থেকে ছ’ ফুট দীর্ঘ। ফুল ফুটতে শুরু করলে ডগা, পাতা নিয়ে রাখা হতো গামলার জলে। গাঁজান শুরু হলে ধারণ করতো হলুদ রঙ । এ নির্যাস সেদ্ধ করতে তে নাড়তে থাকলে প্রথমে সবুজ হয়ে আস্তে আস্তে জমতো নীল দানা ।

বাংলার নীলকর ও চাষীরা

নীল চাষ হতো দু’ভাবে, বেনামিতে নেয়া জমিতে সস্তায় সাঁওতাল মজুর লাগিয়ে (নদীয়া, যশোর, মুর্শিদাবাদ, রাজশাহী) নিজেরা নয়তো রায়তের জমিতে রায়তকে দিয়ে জোর করে রায়তকে দাদন ধরিয়ে। রায়তি চাষের পরিমান ছিল অনেক বেশি।

১৮১৯ সালে হয় পত্তনি তালুক বন্দোবস্ত দেয়ার আইন। নীলকর এবং দেশীয় সম্পদশালীরা পত্তনি তালুক নিয়ে অপরের জমিদারীর মধ্যে শুরু করেন নীল ব্যবসা। নড়াইলের জমিদার ছিলেন এতে অগ্রনী। নীল ব্যবসায় তিনি সাহেব ম্যানেজার রাখেন একজন। এমনিতেই আইনে না থাকলেও দাদন প্রথায় জোর করে করানো হচ্ছিলো নীল চাষ। ১৮২৩ সালে আইন হয় দাদনের দ্বারা জমির উপর নীলকরদের দেয়া হয় বিশেষ স্বত্ব।

ইজারা পাওয়া মাত্র নীলকরদের কাজ ছিল গ্রামের গ্রামের কর্মকারকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে আসা।তাঁর কাছ হতে খোঁজ নেওয়া গ্রামে কার কটি লাঙ্গল আছে। লাঙ্গল প্রতি দুই থেকে ছয় বিঘা জমি চাষ করতে বলে রায়তদেরকে বিঘা প্রতি দু টাকা দাদন ধরিয়ে দেওয়া। দেশীয় গোমস্তা, কর্মচারী, দেওয়ান আর ছোট ছোট জমিদারেরা ছিল নীলকরদের দুষ্কর্মের সহযোগী। নীলকরদের নাম ভাঙ্গিয়ে কৃষক ও রায়তদের নির্যাতন করে নিজেদের আখের গুছিয়ে নিচ্ছিল এদেশীয় এই দুর্বৃত্তরা।

দাদন চক্র ছিল দুর্ভেদ্য। একবার দাদন নিলে সম্ভব ছিল না নীলকরদের দাদনের নাগপাষ থেকে মুক্ত হওয়া। অনাহারে অর্ধাহারে থেকে হলেও ধান বাদ দিয়ে করতে হতো নীল চাষ। নইলে নানা ছল ছুতোয় ধরে নিয়ে আটকে রেখে চলতো অত্যাচার, নির্যাতন। ধরে বেঁধে এনে দাদন ধরিয়ে কাগজে টিপ সই নেয়া ছিল নীলকরের লোকেদের কাজ। নীলকরদের ভয়ে কৃষকেরাতো বটেই, তাদের গবাদিপশুও তারা দূরে রাখতো নীল চাষের এলাকা থেকে। কিন্তু অবাধ্য কৃষককে দাদনে জড়াতে ‘গরুতে নীল গাছ খেয়েছে’ নানা ছুতোয় তার মাঠে চড়া গরু ধরে চালান দিতো কুঠিতে।

রাতারাতি বড়লোক হতে এটাই ছিল ইংরেজদের জন্য সবচাইতে সহজ ব্যবসা। তাই দেখে কোম্পানির লোকেরাও চাকুরী ছেড়ে ব্যবসায়ীদের নিকট থেকে টাকা ঋণ নিয়ে নিজেরাই খুলতে শুরু করে নীলকুঠি। নীলকরদের সংখ্যা বাড়ায় তারাই তদ্বির করে ১৮৩১ এ পাশ করায় কুখ্যাত পঞ্চম আইন – দাদন নিয়ে নীলচাষ না করলে কৃষকদেরকে কারাদন্ডের বিধান। আগে থেকেই বেপরোয়া নীলকরেরা এবার পরিণত হয় এক একটি হিংস্র বাঘে।

নীল ফ্যাক্টরি

জোড় করে ধরে বেঁধে এনে দাদন দিয়ে টিপসই নিয়ে ক্রীতদাসের মতো ইচ্ছামতো যাকে খুশি ব্যবহারই পাকাপোক্ত রীতি হয়ে দাড়ালো। আইন শৃংখলার বালাই ছিল না নীলকরদের এলাকায়। ‘অবাধ্য’ রায়ত, কৃষকদের বাড়িঘরে অগ্নি সংযোগ, গবাদি পশু সহ রায়তদেরকে কুঠির গারদে আটকে রাখা, এমনকি মেরে নদীতে লাশ ভাসিয়ে দেয়ার মতো ঘটনা ঘটতে থাকে অহরহ। বিহার এবং বাংলার পুরো পশ্চিমাঞ্চলে বিস্তৃত তখন নীল চাষ। দুষ্কর হয়ে পড়ে কোম্পানির দৈনন্দিন প্রশাসন সুষ্ঠু পরিচালন।

ইংরেজ ম্যাজিষ্ট্রেট ওয়েষ্টার্ন সাহেবের রিপোর্টে দেখা যায় নীলকুঠি ছিল দাগী দুর্বৃত্ত, ফেরারী আসামী, সদ্য কারামুক্ত অপরাধী দের নিরাপদ আশ্রয়স্থল। একটি নীল কারখানাতেই আমিন, খালাশি গোমস্তা নামে নিয়োগ দেয়া ছিল এমন ২৪০ জন অপরাধী দুর্বৃত্ত। সাথে ছিল ভাড়াটিয়া লাঠিয়াল। ইংরেজ ম্যাজিষ্ট্রেটরাও সাহসী হতেননা নীলকরদের ঘাঁটাতে।

উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকেই মাত্র ২০ বৎসরেই সবাইকে হঠিয়ে নীল ব্যবসা সম্পূর্ণ এসে পড়ে ইংরেজদের কব্জায়। এই আধিপত্য এবং নীল চাষের নামে এই বাংলার নিরবিচ্ছিন্ন লুন্ঠন বজায় থাকে টানা একশ’ বৎসর।

 

Contributed By: তপন রায়

তথ্যসূত্র – নীল বিদ্রোহ ও বাঙালী সমাজ – প্রমোদ সেনগুপ্ত