শিশু ফতেপুর সিক্রির কবুতরখানা আঁকতে গেলে চোখে ভেসে ওঠে—কাবুলের মাঠে ছোট্ট শাহজাদা বন্ধুদের নিয়ে দৌড়চ্ছে, সামনে যেই প্রাণী পাচ্ছে, তার পেছনেই ছুটছে। সে সময় থেকেই প্রাণীর প্রতি তার এক অদম্য টান তৈরি হয়েছিল। তাদের চলাফেরা, শক্তি-দুর্বলতা, অভ্যাস—সবকিছু গভীর মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করতেন। এভাবেই প্রাণীরা হয়ে উঠেছিল তার আজীবন শিক্ষক।
চলুন তার প্রিয় প্রাণীগুলোর সাথে আমরাও পরিচিত হই—
উট: ধীরগতির সঙ্গী
ছোট্ট আকবর তখন কাবুলে। রাজপুত্র হয়েও সারা দিন দৌড়ঝাঁপ, খেলাধুলা, আর প্রাণীর পেছনে ছোটা ছিল তার পছন্দের কাজ। একদিন দূরে এক বিশাল আকৃতির প্রাণীকে দেখে চোখ বড় হয়ে গেল তার, সেটি ছিল একটি উট!
উটের ধীর হাটা, লম্বা গলা আর পিঠে করে জিনিস বহন করার কৌশল আকবরকে মুগ্ধ করেছিল। সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাত উটের সঙ্গে—কখনও উটটিকে নিয়ে দৌড় করাত, কখনও প্রাণীটি কীভাবে খায় দেখার জন্য তার মুখে কাঁটা গাছ দিত। পরে আকবর যখন বড় হয়ে গুজরাটের বিদ্রোহ দমনে যেতেন, তখন রাতের অন্ধকারেও তিনি উট চড়ে সেনাদের সঙ্গে অভিযানে বের হতেন। তার প্রিয় উটটির নাম ছিল জুম্মুজা—যার ধৈর্য আর সাহস ঠিক আকবরের মতোই ছিল।
হাতি: আকবরের প্রাণের সাথী
বারো বছর বয়সে যখন আকবর ভারতে এলেন, তখন তার জীবনে এল আরও এক নতুন প্রাণী—হাতি। এ যেন এক আত্মার আত্মীয় পেয়ে গেলেন তিনি। তখন থেকেই হাতির প্রতি তার ভালোবাসা এক কিংবদন্তি হয়ে গেল। আকবর ইচ্ছে করে সবচেয়ে বুনো আর রাগী হাতিকে পছন্দ করতেন। সব হাতি ও তাদের মাহুতদের নামও তিনি জানতেন। সাহসিকতা ছিল তার রক্তে। তিনি নিজেই হাতির পিঠে উঠে বুনো হাতিকে বশ করতেন।

আকবর ও তাঁর প্রিয় হাতি বালসু
তাঁর সবচেয়ে প্রিয় হাতির নাম ছিল বালসুন্দর—নামের মতোই শান্ত ও শক্তিশালী। বিজাপুরের সুলতান উপহার হিসেবে দিলেন এক চঞ্চল হাতি, যার নাম রাখা হয়েছিল চঞ্চল। সে নাকি প্রতিদিন দুই মণ পর্তুগিজ মদ খেত! এই দুরন্ত হাতিটিকে আকবর নিজের মতো করে শান্ত করে তুললেন।
চিতা: বন্যতার মোহ
চিতা—হিন্দুস্তানের বন্য, ভয়ংকর, অথচ দৃষ্টিনন্দন প্রাণী। এই প্রাণী আকবরকে অন্যরকমভাবে আকর্ষণ করত। যেখানেই খবর আসত, চিতা ধরা পড়েছে, আকবর ছুটে যেতেন। নিজে দেখতেন, শিখতেন কীভাবে চিতাকে শান্ত রাখতে হয়।

চিতার সঙ্গে সম্রাট আকবর
আকবর এমন কৌশল বের করেছিলেন যাতে চিতাগুলো নিজেদের আহত বা ক্ষতিগ্রস্ত না করে শিকার করতে শেখে। একসময় তার কাছে প্রায় হাজার চিতা ছিল! তাদের মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় ছিল সমন্দ মালিক। এটি একটি লাল রঙের পোশাকে সজ্জিত চিতা, যার গায়ে রত্নখচিত পোশাক পরানো হতো। রাজকীয় সাজে এই চিতা চলত পালকিতে করে। চিতার নিজের দাস-দাসী ছিল। এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চলার সময় এমনভাবে ঢাক বাজানো হত যেন এক রাজা চলেছে! এমন ভালোবাসা এক সম্রাটের পক্ষেই সম্ভব।
কবুতর: আকাশের খেলা
ছোটবেলা থেকেই কবুতর ওড়ানোর প্রতি আকবরের ছিল গভীর আগ্রহ। তাঁর শিক্ষক কবুতর ওড়াতেন, আর সেই খেলাই আকবরের মন জিতে নেয়। বড় হয়ে তিনি এই খেলাকে নাম দিলেন ইশ্ক-বাজি। ফতেপুর সিক্রির প্রাসাদে তিনি রাখতেন প্রায় ২০,০০০ কবুতর! বাঁশির সংকেতে কবুতরের দল একসঙ্গে আকাশে উড়ত, ঘুরে ঘুরে চলত, মাঝে মাঝে নিচু হয়ে ডুব দিত—পুরো আকাশ যেন এক জীবন্ত ছবিতে পরিণত হত। খোজা আর দাসীরা তাদের পরিচর্যা করত।তাঁর সবচেয়ে প্রিয় কবুতরের নাম ছিল মোহন। সে ছিল সবচেয়ে বুদ্ধিমান, সবচেয়ে শৃঙ্খলাবদ্ধ। আকাশে একসঙ্গে ১০১টি কবুতর উড়াতেন তিনি—এ যেন সম্রাটের আকাশ জয় করার গল্প।

ফতেপুর সিক্রির কবুতরখানা
কুকুর: নিষিদ্ধ, তবুও প্রিয়
তৎকালীন সময়ের মুসলিম সমাজে কুকুরকে ‘অশুচি’ মনে করা হতো। কিন্তু আকবর ছিলেন ভিন্নধারার চিন্তাবিদ। তিনি কুকুরকে শুধু পোষ্য হিসেবেই নয়, বন্ধু ও সঙ্গী হিসেবেও রাখতেন।
শিকারে তিনি নিজের প্রিয় কুকুরকে নিয়ে যেতেন। কাবুল থেকে আনা হতো সর্বোত্তম জাতের কুকুর। সবচেয়ে প্রিয় কুকুরটির নাম ছিল মহুয়া—নামেই যেন একধরনের মায়া। মহুয়া থাকত আকবরের ব্যক্তিগত কক্ষে, যেন এক আপনজন।
এক বিস্ময়কর দৃষ্টি: ছোট প্রাণীদের প্রতিও ভালোবাসা
আকবর শুধু বড় প্রাণীদের ভালোবাসতেন না। একদিন মাটিতে বসে তিনি দেখছিলেন একটি মাকড়সা কত নিখুঁতভাবে কারুকাজ করা জাল বুনছে। কখনো কখনো মাছির সংগ্রাম দেখতেন—একটা ছোট্ট প্রাণী কেমন করে জীবন নিয়ে লড়ে মুক্তি পাওয়ার জন্য। এই গভীর পর্যবেক্ষণ আর ভালোবাসা থেকেই আকবর শিখতেন জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাঠ—ধৈর্য, শক্তি, সহনশীলতা আর মমতা।
আকবর ছিলেন এমন এক সম্রাট, যিনি প্রাণীদের কাছ থেকেও শিখতেন রাজনীতি। সম্রাট আকবর শুধু যুদ্ধ জিততেন না, প্রাণীদের সঙ্গেও তৈরি করেছিলেন বন্ধুত্ব। রাজত্ব করার ধারা শিখেছিলেন মানুষের থেকেও, আবার শিখেছিলেন হাতি, উট, চিতা, কবুতর, কুকুর, এমনকি মাছি-মাকড়সার থেকেও। এই ভালোবাসাই তাঁকে অন্যদের থেকে আলাদা করেছে। তিনি এমন এক সম্রাট, যিনি শুধু ইতিহাসের নয়, প্রাণীকুলেরও আপনজন হয়ে আছেন। প্রাণীদের থেকে শিখতেন শক্তি আর সহনশীলতার পাঠ।

