কবির তিন মেয়ের মধ্যে রেনুকা বা রানি ছিলো মেজো। কৈশোরেই সে মারা যায়, পুরোপুরি ফুল হয়েও ফুটে উঠতেও পারেনি।

সব ব্যাপারেই ছিলো তার সুগভীর ঔদাসীন্য। রানী ছোটবেলা থেকে ছিল অত্যন্ত দুরন্ত, জেদি অথচ তার মন ছিল অদ্ভুত সংবেদনশীল। তার সম্বন্ধে বলা হতো, সে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের আবহাওয়ার সঙ্গে ঠিক মানানসই নয়।

 মীরার ‘স্মৃতিকথা’ পড়লে জানা যায়, সে ছিলো খুব একরোখা আর জেদি।

সাজগোজ, পোশাকের ব্যাপারেও রানীর কোনও আগ্রহ ছিল না। খুব ছিমছাম, সাদাসিধে থাকতে পছন্দ করত। মাছ-মাংস ভালবাসত না। চুল বাঁধতেও ভীষণ আপত্তি ছিল।

দিদি মাধুরীলতা লিখেছেন, ‘রাণীকে পড়াতে আমার খুবই ইচ্ছে করে, কিন্তু আমরা দু’জনেই অধৈর্য্য, একটুতে বিরক্ত হয়ে পড়ি। অনেক চেষ্টা করে ওকে আমি ৬/৭ দিন পড়িয়েছি কিন্তু আর পেরে উঠলাম না’।

 

এই রেনুকার বিয়ে হয়েছিলো মাত্র এগারো বছর বয়সে, বড়-দিদি বেলার বিয়ের একমাস পরে।

কবি স্ত্রীকে বললেন, ‘ রানীর বিয়ে ঠিক করে এলুম, ছেলেটিকে আমার বড় ভালো লেগেছে ছোট বউ, যেমন মিষ্টি দেখতে তেমনি তার অমায়িক স্বভাব।রানী যেরকম জেদি মেয়ে, ওর বর ভালোমানুষ গোছের না হলে চলবে কেন?

 খুবই অবাক হয়েছিলেন কবিপত্নী… কবিকে বলেছিলেন, ‘তুমি বল কি গো? এরই মধ্যে মেয়ের বিয়ে দেবে?’ মীরা দেবীও পরে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘সব মেয়ে ঘরসংসার করবার মন নিয়ে জন্মায় না। রানীদি হলেন সেই ধরনের মেয়ে’।

আকস্মিক বিয়ের প্রস্তুতি রানীর হৃদয় থেকে যেন প্রাণবায়ু শুষে নিয়েছিল। দুরন্ত ছোট্ট মেয়েটা একেবারে কুঁকড়ে নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছিল। প্রতিবাদী স্বভাব ছিল তার, তবু এই বিষয়ে একটি শব্দও কখনও উচ্চারণ করেনি। বাবার প্রতি অবাধ্যতা প্রকাশ করেনি কখনও।

বিয়ে হয়ে গেল, রানী কিন্তু এই বিয়েটা খুশি মনে নিতে পারলোনা, ভ্রু কুঁচকেই রইলো।

বিয়ের পর স্বামী বিদেশ যাবে শুনে নিশ্চিন্ত হলো।বিয়ের সব অনুষ্ঠান লক্ষী মেয়ের মতো মেনে নিলো।

বিয়ের মতো এই আকস্মিক আঘাত সামলে নেওয়ার আগেই আর একটি কষ্ট রানীকে তোলপাড় করে দেয়। তার একমাত্র আশ্রয়স্থল, মায়ের অকস্মাৎ মৃত্যু। উপর্যুপরি দু’টো চরম আঘাত সামলানোর মতো প্রাণশক্তি রানীর ছিল না।

মায়ের মৃত্যু এবং স্বামীর লেখাপড়ায় অকৃতকার্য হয়ে ফিরে আসায় সে দুঃখিত হয়েছিলো।

মনের ব্যাথা থেকে বুকের ব্যাথা, যক্ষ্মারোগ তাকে গ্রাস করে। কবি হাওয়া বদলের জন্য তাকে নিয়ে গিয়েছিলেন হিমালয়ে। আলমোড়ায় পাইনের হাওয়া, শান্ত নিবিড় ছায়া যক্ষ্মারোগীর জন্য উপকারী বলে তাকে সারাদিন সেখানে রাখা হতো। সেখানেই তিনি লিখে ফেলেন ‘শিশু’ কাব্যগ্রন্থের বেশ কিছু কবিতা। রানীকে সেই কবিতা পড়ে শোনাতেন, চেষ্টা করতেন যাতে রানী অল্প সময়ের জন্য হলেও রোগযন্ত্রণা ভুলে থাকে। বাবার এ রকম সান্নিধ্যে রানী আনন্দ পেত। একটু সুস্থ বোধ করত।

শেষদিকে রেনুকা বার বার বলতো, ‘বাবা বাড়ি নিয়ে চলো’।

রানীর মন ছিল খুব কোমল ও গভীর অনুভূতিপূর্ণ। কবি যখন আলমোড়া থেকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে আসছেন তখন জীবনের এই অন্তিম লগ্নেও সে লখনউ স্টেশনে এক জন খেলনাওয়ালাকে দেখে হঠাৎ রানীর ছোট বোনের কথা মনে পড়ে যায়। তৎক্ষণাৎ ছোট বোন মীরার জন্য সেই বিক্রেতার কাছ থেকে এক বাক্স খেলনা কিনে জোড়াসাঁকোয় নিয়ে আসে। তার পর বোনের হাতে সেই খেলনা তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়। মীরা দেবী স্মৃতিচারণ করেছেন, ‘রানীদি কলকাতায় এসেছেন শুনে দেখতে গিয়েছিলুম। সে কী জীর্ণ শীর্ণ চেহারা ও ম্লান হাসি, আজও তা ভুলতে পারিনি। তাঁর ঠান্ডা হাতখানি বাড়িয়ে আমাকে কাছে ডেকে এক বাক্স খেলনা দিলেন— কলকাতায় আসবার সময় লক্ষনৌ স্টেশনে কিনেছিলেন আমার কথা মনে করে।’

কবি তার মেয়েকে জোড়াসাঁকোয় ফিরিয়ে আনলেন। যখন কিছুতেই কিছু হলোনা তখন কবি তাকে প্রতিদিন উপনিষদের মন্ত্রের অর্থ বুঝাতেন, যাতে তার ছেড়ে যেতে কষ্ট কম হয়। মৃত্যুর মুখে দাঁড়ানো এই অসহায় মেয়েটির আর্তনাদ কবির পিতৃহৃদয়কে প্রতিনিয়ত ক্ষতবিক্ষত করছিলো।

রেনুকার জীবনে তার বাবাই ছিলো সব, তাই মৃত্যুর আগে সে বাবার হাতটা ধরে সেই দরজাটা পার হতে চেয়েছিলো।

তথ্য—-  ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল

লেখক— চিত্রাদেব