মেক্সিকো শহরের বুকে চারশ বছরের বেশী সময় ধরে রাতের অন্ধকারে একটা কান্নার শব্দ ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে শোনা যেত ।কে যেন তার সন্তানদের নাম ধরে ডেকে ডেকে ক্রমাগত বিলাপ করে চলেছে।
শোকাহত এক মহিলার আর্তক্রন্দন ইথারে ভেসে ভেসে বাতাসকে ভারী করে তুলতো।–‘ ওরে আমার বাছারা, আমার দুখী হতভাগা সন্তানেরা ‘- বলে বলে, গুমরে গুমরে কেঁদে বেড়াতেন একজন মহিলা।পরনে তার শতছিন্ন পোশাক, তাতে আবার রক্তের ছাপ।
জনশ্রুতি হল এই যে-১৫৫০ খিৃষ্টাব্দে মাক্সিকো শহরে ডোনা লুইসা অল্ভারস নামে একজন রেডিন্ডিয়ান সুন্দরি মহিলা বাস করতেন।তিনি স্পেন দেশীয় কোন এক গণ্যমান্য ব্যক্তিকে পতিত্বে বরণ করেন।স্পেনীয় ভদ্রলোকটির নাম ছিল ডন নুনো মণ্টিস্ ক্ল্যারস।মহিলাটির গর্ভে ভদ্রলোকের দুটি সন্তান জন্মগ্রহন করেন।স্বামীর প্রতি তার ভালোবাসা ছিল অত্যন্ত গভীর।তার আজন্ম লালিত স্বপ্ন –কবে সে ভদ্রলোকের সত্যিকারের স্ত্রীর মর্যাদা পাবে-কবে এ স্বপ্ন সফল হবে!! ঈশ্বরের কাছে তার এই আকুল প্রার্থনা পৌছেছিল কি?
ভদ্রমহিলার এই আন্তরিকতার মূল্য নুনা মোটেই দেননি ।মহিলার ভালবাসার গভিরতা অনুভব করেও তিনি তার প্রতি এতটুকু করুণা বোধ করেন নি। যৌবন লুটেপুটে খাবার পর তার মোহ কেটে গেল।তারপর তিনি ছেঁড়া কাগজের মতই অবহেলায় তাকে ত্যাগ করে চলে যান।
হতবুদ্ধি লুইসা একেবারে একা হয়ে পড়লেন। তিনি স্থির করলেন পায়ে হেঁটে একাই তিনি ধনী এবং প্রভাবশালী মন্টেস ক্ল্যারসদের প্রাসাদে গিয়ে উপস্থিত হবেন।তার মনে আশা তিনি তার দয়িতকে নতজানু হয়ে ফিরিয়ে আনবেন।তাঁর আনুনয় বিনয়ে নিশ্চয় তাঁর পাষাণ স্বামীর মন গলবেই।
প্রাসাদে গিয়ে তিনি তাঁর প্রাণপ্রিয় ব্যক্তিটির দেখা পেলেন ঠিকই কিন্তু হতভাগিনী কি দেখলেন? দেখলেন জাকজমকপূর্ণ এক বিবাহ বাসরে তিনি এসে উপস্থিত হয়েছেন। এই বিরাট উজ্জ্বল সভাকক্ষে তার দয়িত,তার প্রিয়তম-অন্য একজন স্পেন দেশীয় মহিলার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছেন।
চোখের পানিতে ভেসে লুইসা ছুটে গেলেন নুনার কাছে।কিন্তু নুনা তাকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করলেন।তিনি বললেন যেহেতু লুইসা রেডইন্ডিয়ান বংশোদভূত, তাদের সমাজ তাকে তার স্ত্রী হিসাবে মর্যাদা দেবে না।তিনি কোনদিনই তার ঘরণী হতে পারবেন না।
এ কথায় লুইসা বিকার গ্রস্থ হয়ে পাগলের মত ছুটে ঘরে ফিরে এলেন।তার প্রিয়তমের উপহার দেয়া ছুরিটি তিনি বের করে মুঠোই চেপে ধরলেন ।তারপর কিছু মাত্র দ্বিধা না করে সেই ছুরিটি প্রাণপ্রিয় শিশু দুটির বুকে আমূল বিদ্ধ করে হাহাকার করে কান্নায় ভেঙে পরলেন।সারা শরীরে তার বাছাদের রক্ত ছিটকে এসে পরল।আর সেই রক্ত চিহৃ অঙ্গে ধারণ করে বাড়ী ছেড়ে রাস্তায় নামলেন।পাগলের মত কেঁদে কেঁদে তার কাহিনী ডেকে ডেকে সবাইকে শোনাতে লাগলেন। শেষ পর্যন্ত এই উন্মাদিনীকে বন্দী করে কারাগারে নিক্ষেপ করা হল।বিচার সভা বসলো বিচারের পর ইন্দ্রজাল বিস্তারের কারণে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হল।বিচারকগণ সকলে একমত হয়ে তাঁর ফাঁসীর আদেশ দিলেন।
ডোনা লুইসা আল্ভারস্ নির্দিষ্ট দিনে প্রকাশ্যে ফাঁসী দেওয়া হয়।তারপর তাকে চরম অপমান ও হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য তার মৃত দেহ প্রকাশ্য রাস্তায় গাছের সঙ্গে ছয় ঘণ্টা যাবত ঝুলিয়ে রাখা হল ।জনসাধারণ যাতে ডোনা লুইসার প্রতি তাদের ঘৃনা প্রকাশ করতে পারে, তাকে অবজ্ঞা করে-তাই এই ব্যবস্থা।আর-তারপর থেকেই প্রতি রাতে শুরু হয় এই ভূতুরে কান্না।গুমরে গুমরে এ কান্না একটানা ধবনিত প্রতিধবনিত হয়ে চলেছে।জনশ্রুতি বলে তা বিরামহীন ভাবে চলছে,চলবে-অনন্ত কাল ধরে।পৃথিবীর সৃষ্টি যতদিন আছে সন্তানহীনা জননীর আহাজারী ও অপমানিত দয়িতার এ ক্রন্দন নাকি থামবে না।