পীত সমুদ্রের শেষ সীমায় মন্থর গতিতে একটি শত দাঁড় বিশিষ্ট নৌকা ‘শত অনিত্ৰ’ এগিয়ে চলেছে। যাবনিক বর্ষপঞ্জি মতে সময়কাল ৪৮ খ্রিস্টাব্দ। দোতলার সুসজ্জিত রইঘরে ছোট পালঙ্কের ওপর আধশোয়া অবস্থায় ততোধিক ছোট বাতায়নে চোখ রাজকুমারী সুরিরত্নার। একঘেয়ে সমুদ্রযাত্রা। তাম্রলিপ্ত বন্দর পার হবার দু দিনের মধ্যেই মহাসমুদ্রে এসে পড়েছিল নৌবহর। তারপর থেকে অনন্ত যাত্রা। দু মাস হতে চললো প্রায়। মাঝে কয়েকবার মাত্র যাত্রা বিরতি সুবর্ণদ্বীপে, কম্বোজে, চম্পায়। রসদ ও পানীয় জল সংগ্রহের জন্য। ভারতভূমি থেকে বাণিজ্যতরী মাঝেমধ্যে এপথে যাতায়াত করে বটে, তবে তাতে তো কেবল বণিক ও নৌরক্ষীরা থাকে। কিন্তু নারী? তাও একাকী? সমুদ্রযাত্রায়?? অসম্ভব!!
রাজকুমারী সুরিরত্না ভেবে চলে। সম্ভবতঃ সে-ই আর্যাবর্তের প্রথম নারী যে পীত সমুদ্র অতিক্রম করছে। মহাচীনকে পেছনে ফেলে আরও এগিয়ে যেতে হবে তাকে। আরও পূর্বে। পৃথিবীর পূর্বতম প্রান্তে। এ যে দৈব আদেশ!
অযোধ্যা কুমারী সে। ভগবান বুদ্ধের একনিষ্ঠ ভক্ত। পিতার প্রশ্রয়ে, সখীদের সখ্যতায় প্রাসাদে পরম সুখেই দিন কাটছিল। কেবল পিতার মুখেই অজানা আশঙ্কার ছায়া। গান্ধার দেশ হতে কুষান আক্রমণের আশঙ্কায় দিশেহারা তিনি। কিন্তু ভয়, আশঙ্কা শব্দগুলো যেন সুরিরত্নার অভিধানেই নেই। বরং অজানাকে জানবার, অচেনাকে আপন করে নেবার সহজাত ক্ষমতার অধিকারী সে। এরই মধ্যে একদিন রাত্রি শেষে নিদ্রিত পিতা স্বপ্নাদেশ পেলেন। রাজ্যের মঙ্গলের জন্য ষোড়শী রাজকুমারীকে সমুদ্রযাত্রা করতে হবে। যেতে হবে পৃথিবীর পূর্বপ্রান্তে, এক অজানা দেশে। প্রাতঃসূর্যের প্রথম কিরণ বসুমতীর যে অংশকে সর্বপ্রথম স্পর্শ করে সেদেশের রাজাকে বিবাহ করবে রাজকন্যা। প্রতিষ্ঠা হবে নতুন রাজবংশের। এতেই পিতৃবংশের মুখ উজ্জ্বল হবে। এ এক অমোঘ বিধিলিপি!!
হঠাৎ পরিচারিকার ডাকে সম্বিৎ ফেরে রাজকন্যার।
“এভাবে জেগে থাকলে শরীর খারাপ করবে যে। আপনি ঘুমোন কুমারী। আমি বরং আপনার পা টিপে দিই।”
সুদূর কোরিয়ার “জিউম গোয়ান গায়া” রাজ্যের রাজসভা। মহারাজ সুরো সিংহাসনে আসীন। পিতার মৃত্যুর পর সদ্য সিংহাসনে বসেছেন তিনি। নব্য যুবক মহারাজ সুরো এখনো অবিবাহিত, তাই অমাত্য দের দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। তাঁরা রাজাকে পরামর্শ দেন রাজসেবায় নিযুক্ত কয়েকশত সুন্দরীর মধ্যে থেকে রাজা যেন তাঁর মহাদেবীকে নির্বাচন করেন। কিন্তু মহারাজা নারাজ। সুরো যে গত রাতেই ঘুমন্ত অবস্থায় এক স্বপ্ন দেখেছেন। দৈব আদেশ। তিনি দেখেছেন, সুদূর পশ্চিমে দেবতাদের দেশ ‘অয়ুতা’ থেকে এক রাজকুমারী আসবেন গায়া রাজ্যে। তাঁর সাথেই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে হবে রাজা সুরোকে। প্রতিষ্ঠা করতে হবে নতুন রাজবংশ। তবেই দেশের মঙ্গল হবে।
মহারাজ সুরো তাঁর বিশ্বস্ত সেনাপতি ইউচ্ অন গান-কে সুসজ্জিত ঘোড়া ও নৌকা নিয়ে মাংসান ডো দ্বীপে যেতে বলেন। এই দ্বীপের মাটিতেই প্রথম পা পড়বে দৈব প্রেরিত রাজনন্দিনীর।
সেনাপতি ইউচ্ কয়েকদিন অপেক্ষা করার পর একদিন সকালে সত্যি সত্যিই দেখলেন রক্তবর্ণের পোশাক পরিহিত একশত জন নাবিক লাল পতাকায় সুসজ্জিত এক বিশালকায় নৌপোত নোঙর করলো দ্বীপভূমিতে। সেনাপতি ইউচ্ অন গান পথ দেখিয়ে সসম্মানে নৌবহরকে রাজধানী গায়ার কাছে নিয়ে চললেন। অপর এক সেনানী সিঙ্গ উইগান দ্রুতগামী অশ্বে প্রাসাদে ফিরে গিয়ে রাজাকে দেবতা প্রেরিত কুমারীর আগমনের বার্তা দেন। রাজা রাজ্যের সবচেয়ে সম্মানীয় নয়জন গোত্রপ্রধানকে পাঠালেন কুমারীকে অভ্যর্থনা করে প্রাসাদে নিয়ে আসার জন্য। কিন্তু রাজকুমারী সুরিরত্না অচেনা লোকেদের সাথে রাজপ্রাসাদে থাকতে অস্বীকার করায় প্রাসাদের অদূরে এক পাহাড়ের ঢালে রাজকুমারীর জন্য বস্ত্রাবাস তৈরি করা হয়। অযোধ্যা নরেশের পক্ষে কুড়িজন দাসদাসী সোনা, রূপো, মনিমানিক্য ও রেশম বস্ত্র উপহার স্বরূপ গায়া নরেশকে অর্পণ করে।
যথাসময়ে বিবাহ সম্পন্ন হলো। নতুন রাজা-রানীর হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হল নতুন রাজবংশ। কারাক বা গারাক রাজবংশ। সুরিরত্না পরিচিত হলেন মহারানী হেও হোয়াং ওক নামে। তাঁর বাকি সঙ্গীসাথীদেরও নতুন নামকরণ করা হয়। মহারানী হেও-র সঙ্গীদের মধ্যে সিন পো, চো কুয়াং এবং তাদের স্ত্রীরা যথাক্রমে মো জঙ্গ ও মোর ইয়াং রানীর সাথে নতুন দেশে থেকে যেতে মনস্থ করেন। বাকি সঙ্গীরা দেশে ফিরতে উদ্যত হলে মহারাজা সুরো প্রত্যেককে প্রীতির নিদর্শন স্বরূপ দশ বস্তা করে চাল এবং তিরিশ রোল হেমপেন বস্ত্র দান করেন। (১ রোল = ৪০ ইয়ার্ড)
মহারানী হেও বারোজন সন্তানের জন্ম দিলেন, এদের মধ্যে দুজন কন্যা সন্তান। প্রথম পুত্রের নাম জিও ডেউং। সুখে দিন কাটলেও মহারানী মাঝে মাঝে ছেড়ে আসা পিতার কথা ভেবে বিমর্ষ হয়ে পড়েন। তাই সন্তানেরা বড় হলে মহারানী রাজাকে অনুরোধ করলেন তাদের অন্ততঃ দুজন সন্তান যেন মাতুল বংশের পরিচয়ে পরিচিত হয়। মহানুভব রাজা সুরো সম্মত হলেন। জিমহায়ের হেও এবং লি বা উই পদবীর লোকেরা এদেরই বংশজ। অন্যদিকে কিম পিতার পদবী গ্রহণ করলেন।
জিলবুরাম অনুযায়ী বাকি সাত পুত্র হায়েজিন, গাকচো, জিগাম, ডেঅং গিয়ং, ডুমু, জেয়ং হেয়ং এবং গায়ে জাং মাতৃকূলের মতো বৌদ্ধ ধর্ম পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। বাকি দুই কন্যার একজন তাল হায়ের পুত্র এবং অপরজন সিলার অধিপতিকে বিবাহ করে। যাইহোক, মহারানী হেও হোয়াং ওকের হাত ধরেই কোরীয় উপদ্বীপে বৌদ্ধ ধর্মের প্রবেশ বলে মনে করা হয়।
The Record Of Garak Kingdom বা ‘গারাকগুকগি’ নামক গ্রন্থে গারাক বংশের কথা বিস্তারিত ভাবে উল্লেখ থাকলেও কালের গহ্বরে আজ তা বিনষ্ট। কিন্তু ত্রয়োদশ শতকে গারাকগুকগি-র অনুসরণে লেখা গ্রন্থ ‘সামগুক ইউসা’ এ প্রসঙ্গে একমাত্র নির্ভরযোগ্য দস্তাবেজ।
দক্ষিণ কোরিয়ার গিমহায়েতে কোরীয় ইতিহাসের অন্যতম প্রভাবশালী রানী সুরিরত্নার সমাধি আজও সগৌরবে বর্তমান। ৪৫২ খ্রিস্টাব্দে কোরীয় রাজা জিলজি রাজা সুরো ও রানী সুরিরত্নার বিবাহস্থলে ‘ওয়াংঘুসা’ নামে এক বৌদ্ধ মন্দির নির্মাণ করেন যার অর্থ ‘রানীর মন্দির’। এই মন্দিরের ব্যয় নির্বাহের জন্য রাজা জিলজি দশ গায়েওল জমি দান করেন। প্রাচীন কোরীয় হিসাবশাস্ত্রে উর্বরতা অনুযায়ী প্রতি গায়েওল জমির মাপ ২.২ একর থেকে ৯ একর পর্যন্ত হতো।
কিংবদন্তি অনুসারে রানী হেও হোয়াং ওক ১৫৭ বছর জীবিত ছিলেন! কিংবদন্তি যাই বলুক, ভারত তার প্রথম মহিলা ভূ-পর্যটককে ভুলে গেলেও কোরিয়াবাসীর হৃদয়ে আজও তিনি সম্রাজ্ঞীর আসনে অধিষ্ঠিতা।
২০০১ সালে উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত, ১০০ জন ঐতিহাসিক ও বহু সরকারি আধিকারিকের উপস্থিতিতে অযোধ্যাতে Memorial of Heo Hwang Ok বা সুরিরত্না স্মারক তৈরি হয়।
২০১৮ সালে দীপাবলির দিন দক্ষিণ কোরিয়ার First Lady কিম জুং সুক এই স্মৃতি স্মারকের পরিবর্ধন ও সৌন্দর্য্যায়নের সূচনা করেন। প্রতি বছর কয়েক হাজার কোরীয় “মামাবাড়ি” অযোধ্যায় আসেন শুধুমাত্র তাদের হৃদয় সম্রাজ্ঞী সুরিরত্নাকে শ্রদ্ধা জানাতে। আজকের কোরীয় উপদ্বীপের কমপক্ষে ৬০ লক্ষ মানুষ নিজেদেরকে রানী সুরিরত্নার বংশধর বলে গর্ববোধ করেন। অথচ ভারতের আদ্যিকালের বদ্যি ইতিহাস বুড়ো তাঁর নামটুকু পর্যন্ত মনে রাখেনি। মহাকালের কি নির্মম পরিহাস!!
তথ্যসূত্র: Silk Empress by N. R. Parthasarathi.