চিকিৎসা ও চিকিৎসক একে অপরের পরিপূরক। কিন্তু এই চিকিৎসাক্ষেত্রে নারীরা আজ যতটা পদচারণা করছে বা সফলতা পাচ্ছে এক সময় তা ছিলো কল্পনারও বাইরে। চিকিৎসাক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ ছিলো সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এবং আইনগতভাবে সীমিত। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় সব দেশে নারীদের চিকিৎসাবিদ্যা অর্জনে সমান সুযোগ প্রদান করা হলেও এখন পর্যন্ত কর্মসংস্থানে নারীদের সমান সুযোগ এবং অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারে নি।
প্রাচীন এথেন্সে এক সময়-চিকিৎসাবিদ্যাকে নারীদের পেশা হিসেবে নেবার কোনো অধিকার ছিলো না। নারীদের এই পেশা গ্রহনের সুযোগকে একেবারে আইন করেই নিষিদ্ধ করা হয়েছিলো। এতে করে স্বাভাবিকভাবেই নারী রোগীদের নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হতো। চিকিৎসা গ্রহণে নারীদের এমন দুরবস্থা দেখে মনে মনে প্রতিবাদী হয়ে উঠেন এক নারী, নাম তার ‘অ্যাগনডাইস’। তিনি মনস্থির করলেন যে, ডাক্তার তিনি হয়েই ছাড়বেন এবং এর জন্য তাকে আইনভঙ্গ করতে হলেও তা করতে তিনি পিছপা হবেন না। শেষ পর্যন্ত এক ফন্দি আটলেন অ্যাগনডাইস। তিনি মাথার চুল কেটে ছেলেদের ছদ্মবেশ ধারণ করে রওনা হয়ে গেলেন মিশরের উদ্দেশ্যে। সেই সময় মিশরে নারীদের চিকিৎসাবিদ্যা অর্জনে কোনো বাধানিষেধ ছিলো না। অ্যাগনডাইস মিশর থেকে চিকিৎসাবিদ্যা অর্জন করে আবার মাতৃভূমিতে ফিরে আসেন, তবে কেবল অ্যাগনডাইস হয়ে না বরং ‘ডাক্তার অ্যাগনডাইস’ হয়ে।
অ্যাগনডাইস চিকিৎসক হয়ে ফিরে এলেও এথেন্সে তখনও চিকিৎসা ক্ষেত্রে নারীদের কাজ করা নিয়ে যে নিষেধাজ্ঞা ছিলো তা পরির্তন হয়নি। ওদিকে চিকিৎসক হয়ে চিকিৎসা না করে তো আর বসে থাকা যায় না,তাই আবারও দুটো অভিনব উপায় বের করলেন তিনি। প্রথমত, পুরুষের ছদ্মবেশে চিকিৎসা প্রদান করা আরম্ভ করলেন। দ্বিতীয়তঃ যদি কোনো মহিলা রোগী এসে তার কাছে সমস্যা খুলে বলতে বা তার হাতে অপারেশন করাতে রাজি না হতো, তাহলে তিনি তার পরিহিত পোশাক উন্মোচন করে রোগীকে আশ্বস্ত করতেন যে পুরুষের ছদ্মবেশ নিয়ে থাকলেও তিনি তাদের মতোই একজন নারী। তখন অ্যাগনডাইসের প্রকৃত পরিচয় জানতে পেরে মহিলা রোগীরা স্বস্তিবোধ করতো এবং নির্দ্বিধায় তার কাছে চিকিৎসা গ্রহণ করতো। এভাবে ধীরে ধীরে অ্যাগনডাইসের চিকিৎসা পেশার প্রসার হতে থাকে, বিশেষ করে মহিলা রোগীদের মাঝে। অন্যদিকে অ্যাগনডাইসের সফলতা অন্যান্য পুরুষ চিকিৎসকদের চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তখন তারা নিজেদের মাঝে বলাবলি করতে থাকে, “কী অবস্থা! কোথা থেকে এক নতুন চিকিৎসক এসে কি না আমাদের সব মহিলা রোগীদের নিয়ে নিচ্ছে!” অ্যাগনডাইসকে ঠেকানোর আর কোনো উপায় না পেয়ে তারা অ্যাগনডাইসের বিরুদ্ধে মামলা করে দেন। মামলায় এই অভিযোগ করেন যে, “অ্যাগনডাইস নারী রোগীদের প্রলুব্ধ করে তার কাছে চিকিৎসা নেবার জন্য,যা চিকিৎসা পেশার জন্য নিঃসন্দেহে অবমাননাকর।
অ্যাগনডাইস নিজের পেশার মানুষদের কাছ থেকে এমন অভিযোগে হতাশ হলেও যথাসময়েই বিচারকের দরবারে হাজির হন তিনি। অ্যাগনডাইস ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন যে শাস্তি এড়ানোর বিকল্প কোনো পথ নেই, যেহেতু তাকে অভিযুক্ত করা হচ্ছে মহিলা রোগীদের সাথে অনৈতিক সম্পর্কে লিপ্ত হবার সাথে, যা তিনি একদমই করেননি। তখন তার এই অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণের জন্য বাধ্য হয়ে আদালতে তার আসল পরিচয় প্রকাশ করে দেন অর্থাৎ অ্যাগনডাইস আদালতে বলে দেন যে তিনি একজন নারী,কোনো পুরুষ নন।
অবশেষে মিথ্যা অপবাদ থেকে মুক্তি পায় অ্যাগনডাইস। কিন্তু নারী রোগীদের প্রলুব্ধ করে চিকিৎসার মিথ্যা অপবাদ থেকে রেহাই মিললেও ,শাস্তি এড়ানো গেলো না। দেশের আইনের বিরুদ্ধে গিয়ে নারী হয়ে চিকিৎসা সেবা প্রদানে জন্য তার শাস্তি মৃত্যুদন্ড তো তাকে পেতেই হবে! মৃত্যুদন্ডের শাস্তি এড়ানোর জন্য অ্যাগনডাইসের স্বপক্ষে বলার মতো কোনো যুক্তিই জানা ছিলো না। অবশ্য তখন তার আর নিজের জন্য কিছু বলার প্রয়োজনও হয়নি।বিচারকার্য চলাকালে তার কাছ থেকে চিকিৎসা নিয়ে উপকৃত হওয়া বহু মহিলারা তখন ছুটে আসেন এবং বলতে থাকেন অ্যাগনডাইসের চিকিৎসার দক্ষতা ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে তার কৃতিত্বের কথা। অবশেষে বিচারক সবকিছু বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিলেন, অ্যাগনডাইসকে ছেড়ে দেয়া হবে; মুক্তি পান অ্যাগনডাইস। শুধু তা-ই না, এই ঘটনার পর এথেন্সে নারীদের চিকিৎসক হবার ব্যাপারে যে নিষেধাজ্ঞা ছিলো সেটাও আইন করে চিরতরে বিলুপ্ত করা হয়। আর এভাবেই সকলের জন্য এক অনুপ্রেরণা, চিরাচরিত প্রথা ভাঙার প্রতিশব্দ হয়ে ওঠেন অ্যাগনডাইস।
তবে অধিকাংশ ইতিহাসবিদদের মতে,অ্যাগনডাইসের এই কাহিনী সত্য নয় এবং এর পিছনে তাদের যুক্তিকেও অগ্রাহ্য করার মতো নয়। কেননা অ্যাগনডাইসের কাহিনীর অনেক আগে থেকেই চিকিৎসা পেশায় নারীদের অংশগ্রহনের ব্যাপারে জানা যায়। প্রাচীন সভ্যতায়-অ্যাগনডাইস ধরনের আরও অনেক কাহিনী রয়েছে। অ্যাগনডাইসকে কোনো ঐতিহাসিক চরিত্র হিসেবে বিবেচনা করা হয় না,কিন্তু তার গল্পটি ক্রমাগতভাবে মেয়েদেরকে ধাত্রীবিদ্যা অথবা ঔষধিবিদ্যা পেশা চর্চার ক্ষেত্রে একটি শক্তিশালী উদাহরণ বা নজির হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। অ্যাগনডাইসের কাহিনীটি সত্য বা কাল্পনিক সেটা বড় ব্যাপার নয়, বরং এটা একটা সময়ের নিষিদ্ধ প্রথাকে ভেঙ্গে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার একটি অনুপ্রেরণামূলক কাহিনী। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হিসেবে নারীদের অংশগ্রহণের পরিধীকে বাড়িয়ে,চিকিৎসা ক্ষেত্রে লিঙ্গীয় সমতা এখন একটি বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ। তাই চিকিৎসা পেশায় নারীর সমান অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সবার সোচ্চার হওয়া এবং কার্যকরী ভূমিকা পালন করা অতীব জরুরী।