শনিবার, ১৫ জুলাই, ১৯৪৪
আদরের কিটি,
লাইব্রেরি থেকে আমরা একটা বই পেয়েছিলাম, বইয়ের নামটাতে একটা যুদ্ধংদেহি ভাব; কমবয়সী আধুনিক তরুণীদের সম্পর্কে আপনি কী মনে করেন?’ আজ এই বিষয়টা নিয়ে আমি কিছু বলতে চাই। বইটির লেখিকা ‘আজকের তরুণ সমাজ’-কে আগাপাছতলা ধুনেছেন–অবশ্য তাই বলে একথা বলেননি যে, তরুণদের সবাই ‘ভালো কিছু করতে অপারগ।’ বরং বলেছেন এর ঠিক উল্টো। তাঁর মতে, তরুণ-তরুণীরা যদি ইচ্ছে করে তাহলে তাঁরা এর চেয়ে বড়, এর চেয়ে সুন্দর এবং এর চেয়ে ভালো দুনিয়া গড়তে পারে–সে ক্ষমতা তাদের মুঠোর মধ্যেই আছে; কিন্তু তাঁরা সত্যিকার সৌন্দর্যের বিষয়ে না ভেবে ওপরকার জিনিসগুলো নিয়েই ব্যস্ত।
রচনার কোনো কোনো অংশে মনে হয়েছে লেখিকার সমালোচনার লক্ষ্য যেন আমি; তাই আমি তোমার কাছে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে একবার খুলে ধরতে চাই এবং এই আক্রমণের বিরুদ্ধে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে চাই। যে আমাকে কিছুকালও দেখেছে, তাঁরই চোখে না পড়ে পারে না–আমার চরিত্রের এক অসামান্য গুণ হল আমার আত্মজ্ঞান। ঠিক একজন বাইরের লোকের মতোই আমি নিজেকে আর আমার ক্রিয়াকলাপগুলোকে নিরীক্ষণ করতে পারি।
কোনোরকম পক্ষপাত ছাড়াই, তাঁর হয়ে কোনোরকম সাফাই না গেয়েও, প্রতিদিনের আনার মুখোমুখি আমি দাঁড়াতে পারি; এবং তাঁর মধ্যে কী ভালো আর কী মন্দ তা লক্ষ্য করতে পারি। এই ‘আত্মচেতনা’ সব সময় আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকে এবং যখনই আমি মুখ খুলি, কথা বলমাত্র আমি জানি ওটা না বলে অন্য কিছু বলা উচিত ছিল’ কিংবা ‘ওটা ঠিকই বলা হয়েছে। আমার মধ্যে এত কিছু আছে যা আমার চোখে খারাপ ঠেকে; সে সব বলে ফুরোবে না। আমি যত বড় হচ্ছি তত বুঝছি বাপির সেই কথাগুলো কত ঠিক–সব শিশুকেই তাঁর মানুষ হওয়ার দিকে নজর দিতে হবে।’
বাপ-মা-রা শুধু সদুপদেশ দিতে পারেন অথবা তাঁদের সঠিক পথে এনে দিতে পারেন কিন্তু কারো চরিত্র চূড়ান্তভাবে কী রূপ নেবে সেটা নির্ভর করে তাঁদের নিজেদের ওপর। এর ওপর আমার আর যা আছে তা হল মনের জোর; সবসময় নিজেকে আমার খুব শক্তসমর্থ বলে মনে হয় এবং মনে হয় আমি অনেক কিছু সহ্য করতে পারি। নিজেকে ঝাড়া হাত-পা আর নবীন বলে মনে হয়। প্রথম সেটা জানতে পেরে আমি কী খুশি হয়েছিলাম; কেননা যখন প্রত্যেকের ওপর অনিবার্যভাবে ঘা এসে পড়বে, আমার মনে হয় না, আমি সহজে সে আঘাতে ভেঙে পড়ব। কিন্তু এসব বিষয় নিয়ে আগেও আমি অনেকবার বলেছি। এবার আমি ‘বাপি আর মা-মণি আমাকে বোঝে না’ অধ্যায়টিতে আসব।
বাপি আর মা-মণি বরাবর পুরোপুরিভাবেই আমার মাথাটি খেয়েছেন; ওঁরা সবসময় আমার সঙ্গে মিষ্টি ব্যবহার করেছেন, আমার পক্ষ নিয়েছেন, এবং মা-বাবার পক্ষে সম্ভবপর। সবকিছুই আমার জন্য করেছেন। তবু আমি দীর্ঘ সময় ধরে কী ভয়ঙ্কর নিঃসঙ্গ বোধ করেছি এবং নিজেকে পরিত্যক্ত, উপেক্ষিত আর লোকে আমাকে ভুল বুঝেছে বলে মনে হয়েছে। বাপি সাধ্যমত চেষ্টা করেছেন আমার বিদ্রোহী ভাব ঠেকাতে, কিন্তু ফল হয়নি; আমার নিজের আচরণে কী ভুল তা দেখে এবং সেটা নিজের চোখের সামনে তুলে ধরে আমি নিজেকে সারিয়ে তুলেছি। এই বা কেমন যে, আমার লড়াইতে আমি বাপির কাছ থেকে কোনো সাহায্যই পাইনি? তখন তিনি আমার দিকে সাহায্যের হাত বাড়াতে চেয়েছেন, কেন তিনি তখনও সম্পূর্ণভাবে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছেন?
বাপি এগিয়েছিলেন ভুল পথ ধরে, উনি সবসময় আমার সঙ্গে যেভাবে কথা বলেছেন তাতে মনে হবে আমি যেন এমন এক শিশু যে কষ্টকর অবস্থার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। কথাটা অদ্ভুত ঠেকবে, কারণ বাপিই হলেন একমাত্র লোক যিনি আমাকে বিশ্বাস করে সবকিছু বলতেন; এবং আমি যে সুবোধ মেয়ে, একটা বাপি ছাড়া আর কেউই আমাকে মনে মনে বুঝতে দেয়নি। কিন্তু একটা জিনিস বাদ পড়েছিল; তিনি এটা উপলব্ধি করতে পারেননি যে, আমার পক্ষে অন্য সবকিছুর চেয়ে ঢের বেশি জরুরী হল চরম উৎকর্ষে পৌঁছুবার লড়াই। তোমার বয়সে এটা হয়; বা অন্য মেয়েরাবা ‘এটা আপনা থেকে আস্তে আস্তে কেটে যাবে’–এ ধরনের কথা আমি শুনতে চাইতাম না; আমি চাইনি আমার সঙ্গে ব্যবহার করা হোক আর পাঁচটা মেয়ের মতো ব্যবহারটা হওয়া উচিত আনা যা তাঁর সেই নিজের গুণে। পিম সেটা বোঝেননি। সেদিক থেকে কাউকেই আমি মনের কথা বলতে পারি না, যদি না তাঁরা নিজেদের সম্বন্ধে বিস্তর কথা আমাকে বলে। যেহেতু পিম সম্পর্কে আমি খুব সামান্যই জানি। আমি মনে করি না তাঁকে সঙ্গে নিয়ে আমি খুব ঘনিষ্ঠ জায়গায় পা ফেলতে পারি। পিম সবসময় বয়োবৃদ্ধের, পিতৃসুলভ মনোভাব নেন; বলেন এক সময়ে তাঁরও এই ধরনের ঝোঁক হয়েছিল। তবে ওসব বেশিদিন থাকে না। হাজার চেষ্টা করেও আমার সঙ্গে আজও বাপির মনের তার ঠিক বন্ধুর মতো এক সুরে বাজে না।
এই সবের দরুন, জীবন সম্বন্ধে আমার মতামত অথবা আমার সুচিন্তিত তাত্ত্বিক ধারণাগুলোর কথা আমি আমার ডায়েরির পাতায় এবং মাঝে মাঝে মারগটকে ছাড়া কখনও কারো কাছে ঘুণাক্ষরেও বলি না। যেসব জিনিস আমাকে বিচলিত করছিল, তার পুরোটাই আমি বাপির কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছিলাম; আমি কখনই বাপিকে আমার আদর্শের অংশীদার করিনি। এটা আমি মনে মনে বুঝছিলাম যে, আমি তাঁকে আস্তে আস্তে আমার কাছ থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছি। অন্য কিছু করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। আমি সবকিছুই পুরোপুরি আমার অনুভূতি অনুযায়ী করেছি, কিন্তু করেছি এমনভাবে যা আমার মনের শান্তি রক্ষার সবচেয়ে অনুকূল। কারণ, এ অবস্থায়, আমি যদি আমার অর্ধসমাপ্ত কাজের সমালোচনা মেনে নিই, তাহলে নড়বড় করতে করতে যে স্থিরতা আর আত্মবিশ্বাস গড়ে তুলেছি–আমাকে তা সম্পূর্ণভাবে খোয়াতে হয়। পিমের কাছ থেকে এলেও আমি তা মানতে পারি না, যদিও কথাটা কঠিন শোনাবে, কেননা পিমকে আমি আমার গূঢ় ভাবনার অংশীদার তো করিইনি, উপরন্তু আমার রগচটা মেজাজের সাহায্যে অনেক সময় নিজেকে তাঁর কাছ থেকে আরও বেশি দুরে ঠেলে দিয়েছি।
এই বিষয়টা নিয়ে আমি বিলক্ষণ ভেবে থাকি–পিমের ওপর কেন আমি চটি? এতই চটি যে, আমাকে ওঁর জ্ঞান দিতে আসাটা আমি সহ্যই করতে পারি না, ওঁর সস্নেহ ভাব ভঙ্গিগুলো আমার কাছে ভান বলে মনে হয়, আমি চাই একা শান্তিতে থাকতে এবং ওঁর হাত থেকে একটু রেহাই পেলেই বরং খুশী হই, যতক্ষণ ওঁর প্রতি আমার মনোভাব ঠিক কী সেটা নিশ্চিতভাবে না বুঝতে পারছি। কারণ, উত্তেজিত হয়ে যে যাচ্ছেতাই চিঠিটা দম্ভ করে ওঁকে আমি লিখেছিলাম, তার কুরে কুরে খাওয়া অপরাধবোধ এখনও আমার মধ্যে রয়ে গেছে। সবদিক দিয়ে প্রকৃত বলিষ্ঠ আর সাহসী হওয়া, ইস, কত যে শক্ত।
তবু এটাই আমার সবচেয়ে বড় আশাভঙ্গ নয়। না, বাপির চেয়ে আমি ঢের বেশি ভাবি পেটারের কথা। আমি ভালো করেই জানি, আমি ওকে হার মানিয়েছিলাম, ও আমাকে নয়। ওর সম্পর্কে আমি মনের মধ্যে একটা ভাবমূর্তি খাড়া করেছিলাম। শান্ত সংবেদনশীল মিষ্টিমতো একটি ছেলের–যার দরকার স্নেহ-ভালবাসা আর বন্ধুত্ব। আমার প্রয়োজন ছিল জীবন্ত কোনো মানুষের–যাকে আমি প্রাণের সব কথা খুলে বলতে পারি; আমি চেয়েছিলাম এমন একজন বন্ধু, যে আমাকে এনে দেবে ঠিক রাস্তায়। আমি যা চেয়েছিলাম তা পেয়েছি এবং আস্তে আস্তে কিন্তু নিশ্চিতভাবে তাঁকে আমি নিজের কাছে টানলাম। শেষ পর্যন্ত, যখন তাঁকে আমি বন্ধুভাব বোধ করাতে পারলাম, তখন আপনা থেকে তা এমন এক মাখামাখিতে গিয়ে গড়াল যে, পুনর্বিবেচনায় বুঝলাম, সেটা অতটা হতে দেওয়া আমার উচিত হয়নি।
আমরা কথা বলেছি যারপরনাই ব্যক্তি বিষয়ে, কিন্তু আজ অবধি আমাদের কথাবার্তায় আমরা সেইসব বিষয়ের ধারকাছ দিয়েও যাইনি যে বিষয়গুলো সেদিন এবং আজও আমার হৃদয়মন ভরে রেখেছে। আমি এখনও পেটারের ব্যাপারটা ভালো জানি না ওর কি সবই ওপরসা? নাকি ও এখনও লজ্জা পায়, এমন কি আমাকেও? কিন্তু সে কথা থাক, সত্যিকার বন্ধুত্ব পাতানোর অধীর আগ্রহে আমি ভুল করে বসেছিলাম। দুম করে সরে গিয়ে ওকে ধরার চেষ্টায় আমি গড়ে তুললাম আরও মাখামাখির সম্পর্ক। সেটা না করে আমার উচিত ছিল অন্যান্য সম্ভাবনাগুলো বাজিয়ে দেখা। পেটার হেদিয়ে মরছে ভালবাসা পাওয়ার জন্যে এবং আমি দেখতে পাচ্ছি ও ক্রমবর্ধমানভাবে আমার প্রেমে পড়তে শুরু করেছে। আমাদের দেখাসাক্ষাতে ও তৃপ্তি পায়; অথচ আমার ওপর এসবের একমাত্র ক্রিয়া হয় এই যে, আমার মধ্যে আরেকবার পরীক্ষা করে দেখার বাসনা জাগে। এ সত্ত্বেও যেসব জিনিস দিনের আলোয় তুলে ধরার জন্যে আমি আকুলিবিকুলি করছি, কেমন যেন মনে হয় আমি সে বিষয়গুলো টুতেই পারি না। পেটার যতটা বোঝে, তার চেয়েও ঢের বেশি আমি ওকে আমার কাছে টেনে এনেছি। এখন ও আমাকে আঁকড়ে ধরেছে; আপাতত ওকে ঝেড়ে ফেলার এবং ওকে নিজের পায়ে দাঁড় করানোর আমি কোনো রাস্তা দেখছি না। যখন আমি বুঝলাম ও আমার বোধশক্তির উপযোগী বন্ধু হতে পারবে না, তখন ঠিক করলাম আমি অন্তত চেষ্টা করব ওর মনের এঁদো গলি থেকে ওকে তুলে আনতে এবং এমন ব্যবস্থা নিতে যাতে ওর যৌবনটা দিয়ে ও কিছু করতে পারে।
কারণ, অন্তরের অন্তরতম প্রদেশে যৌবন বার্ধক্যের চেয়েও নিঃসঙ্গ। এটা আমি কোনো বইতে পড়েছিলাম এবং বরাবর স্মরণে আছে; দেখেছি কথাটা ঠিক। তাহলে কি এটা ঠিক যে, আমাদের চেয়েও আমাদের গুরুজনদের এখানে থাকা ঢের বেশি কষ্টকর? না। আমি জানি, এটা ঠিক না। বয়সে যারা বড়, সব কিছু সম্পর্কে তাদের মতামত তৈরি হয়ে গেছে। কোনো কিছু করতে গিয়ে তাঁদের দ্বিধার মধ্যে পড়তে হয় না। আজ যখন সমস্ত আদর্শ ভেঙে তছনছ হয়ে যাচ্ছে, যখন লোকে তাঁদের সবচেয়ে ওঁছা দিকটা চোখের সামনে তুলে ধরছে এবং সত্য, ন্যায় আর ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখতে হবে কিনা তাও জানে না–তখন নিজের কোট বজায় রেখে নিজের মতামত ঠিক রাখা, আমাদের ছোটদের পক্ষে, তো আরও দ্বিগুণ শক্ত।
কেউ যদি, সে যেই হোক, দাবি করে যে এখানে গুরুজনদের থাকতে বেশি কষ্ট হয়, তাহলে বলব সে মোটেই বোঝে না কী পরিমাণ ভারী ভারী সমস্যা আমাদের ঘাড়ের ওপর; এসব সমস্যা সামলাবার পক্ষে আমরা হয়ত খুবই ছোট, কিন্তু তাহলেও ক্রমাগত তার চাপ তো আমাদের ওপর পড়ছে; হতে হতে একটা সময় আসে, আমরা তখন ভাবি, যা একটা সমাধান পাওয়া গেছে–কিন্তু সে সমাধান তো প্রকৃত ঘটনাগুলোকে ঠেকাতে পারে না, ফলে আবার সব লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। এমন দিনে এই হল মুশকিল–আমাদের ভেতর আদর্শ, স্বপ্ন আর সাধ আহ্লাদ মাথা তোলে, তারপরই ভয়ঙ্কর সত্যের মুখে পড়ে সেসব খান খান হয়ে যায়। এটা খুব আশ্চর্য যে, আমি আমার সব আদর্শ জলাঞ্জলি দিইনি; কেননা সেগুলো অযৌক্তিক এবং কাজে খাটানো অসম্ভব, এ সত্ত্বেও আমি সেগুলো রেখে দিয়েছি, কারণ, মানুষের ভেতরটা যে সত্যিই ভালো, সবকিছু সত্ত্বেও আমি আজও তা বিশ্বাস করি। আমি এমন ভিত্তিতে আমার আশাভরসাকে দাঁড় করাতে পারি না যা বিশৃখল, দুঃখদৈন্য আর মৃত্যু দিয়ে তৈরি। আমি দেখতে পাচ্ছি পৃথিবী ক্রমশ জঙ্গল হয়ে উঠছে, আমি কেবলি শুনতে পাচ্ছি আসন্ন বজ্রনির্ঘোষ, যা আমাদেরও ধ্বংস করবে, আমি অনুভব করতে পারি লক্ষ লক্ষ মানুষের যন্ত্রণা-লাঞ্ছনা এবং এ সত্ত্বেও, আমি দিবালোকের দিকে মুখ তুলে তাকাই, আমি ভাবি সব ঠিক হয়ে যাবে, এ নিষ্ঠুরতারও অবসান হবে এবং আবার ফিরে আসবে শান্তি আর সুস্থিরতা।
যতদিন তা না হয়, আমি আমার আদর্শগুলোকে উঁচুতে তুলে ধরব, কেননা হয়ত এমন দিন আসবে যখন আমি সেই আদর্শগুলোকে কাজে খাটাতে পারব।
তোমার আনা।
●
শুক্রবার, ২১ জুলাই, ১৯৪৪
আদরের কিটি,
এখন আমার সত্যিই আশা জাগছে, এখন সব কিছুই ভালো চলছে। হ্যাঁ, সব ভালো চলছে। সবার বড় খবর। হিটলারকে খুন করার চেষ্টা হয়েছিল এবং এবার যে করেছিল সে এমন কি না ইহুদী কমিউনিস্ট, না ইংরেজ পুঁজিবাদী বরং যে করেছিল সে একজন জার্মান সেনাপতি, এবং তদুপরি একজন কাউন্ট, এবং বয়সেও যথেষ্ট তরুণ। ফুরার প্রাণে বেঁচেছে দৈবক্রমে, এবং দুর্ভাগ্যক্রমে, দু-চারটে আঁচড় আর পোড়ার ওপর দিয়ে ফুরারের ফাঁড়া কেটে গেছে। সঙ্গে যে কয়জন অফিসার আর জেনারেল ছিল, তাঁরা কেউ খুন, কেউ জখম হয়েছে। যে প্রধান অপরাধী, তাঁকে গুলি করে মারা হয়।
যাই হোক, এ থেকে স্পষ্টই বোঝা যায়, প্রচুর অফিসার আর জেনারেল যুদ্ধের ব্যাপারে বীতশ্রদ্ধ এবং তাঁরা হিটলারকে জাহান্নামে পাঠাতে পায়। হিটলাকে সরিয়ে দিয়ে, তাঁদের লক্ষ্য সে জায়গায় এমন একজন সামরিক একনায়ককে বসানো, যে মিত্রপক্ষের সঙ্গে শান্তিচুক্তি করবে; এরপর তাঁরা চাইবে পুনরাষ্ট্রীয়করণ করে বিশ বছরের মধ্যে আরেকটি যুদ্ধ ডেকে আনতে। দৈবশক্তি বোধহয় ইচ্ছে করেই হিটলারকে সরিয়ে ওদের পথ পরিসর করার ব্যাপারটা একটু দেরি করিয়ে দিয়েছেন, কেননা নিচ্ছিদ্র জার্মানরা তাহলে নিজেরা নিজেদের মেরে মিত্রপক্ষের কাজ অনেক সহজ এবং ঢের সুবিধাজনক করে দেবে। এতে রুশ আর ইংরেজদের কাজ কমে যাবে এবং ঢের তাড়াতাড়ি তাঁরা নিজেদের শহরগুলো পুনঃনির্মাণের কাজে হাত দিতে পারবে।
কিন্তু তবু, আমরা অতদূর এখনও এসে পৌঁছাইনি, এবং সময় হওয়ার এত আগে সেই গৌরবোজ্জ্বল ঘটনাগুলোর কথা আমি বিবেচনা করতে চাই না। তবু, তুমি নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছ যে, এ সমস্তই ঠাণ্ডা মাথার বাস্তব এবং আজ আমি রয়েছি, আটপৌরে গদ্যের মেজাজে; এই একটিবার উচ্চ আদর্শ নিয়ে আমি বকবক করছি না। আরও কথা হল, হিটলার এমন কি বারি কৃপা পরবশ হয়ে তাঁর বিশ্বস্ত ভক্তজনদের জানিয়ে দিয়েছে যে, সৈন্যবাহিনীর প্রত্যেকে অতঃপর গেস্টাপোকে মানতে বাধ্য থাকবে; এবং হিটলারকে হাজার নীচ, কাপুরুষোচিত প্রচেষ্টায় জড়িত ছিল জানলে যে কোনো সৈনিক তাঁর সেই উপরওয়ালাকে যেখানে পারে সেখানেই, কোট-মার্শাল ছাড়াই গুলি করে মারতে পারবে।
এবার যা একখানা নিখুঁত খুনের খেল শুরু হবে। লম্বা রাস্তা পাড়ি দিতে গিয়ে সেপাই জনির পা ব্যথা করেছে, উপরওয়ালা অফিসার দাঁত খিঁচিয়েছে। আর যায় কোথায়–জনি অমনি তাঁর রাইফেল বাগিয়ে ধরে হুঙ্কার দেবে—‘ফ্যুরারকে বড় যে মারতে গিয়েছিলি, এই নে ইনাম।’ গুড়ুম! ব্যস, সেপাই জনিকে ধমকানোর স্পর্ধা দেখাতে গিয়ে নাক-তোলা ওপরওয়ালা চলে গেল চিরন্তন জীবনে (নাকি সেটা চিরন্তন মৃত্যু?)। শেষকালে, কোনো অফিসার যখনই কোনো সেপাইয়ের মুখোমুখি হবে, কিংবা তাঁকে সবার আগে পিঠে রেখে দাঁড়াতে হবে, দুর্ভাবনায় সে তাঁর প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলবে। কেননা সেপাইরা যা বলতে সাহস পায় না সে সবই তাঁরা বলবে। আমি যা বলতে চাইছি, তার খানিকটা কি তুমি ধরে নিতে পারছ? নাকি আমি প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে লাফ দিয়ে দিয়ে যাচ্ছি? লাফ না দিয়ে উপায় নেই; আসছে অক্টোবর ইস্কুলের বেঞ্চিতে গিয়ে বসতে পারি, এই সম্ভাবনায় মন খুশিতে এত ভরে উঠেছে যে, যুক্তিতর্ক সব চুলোয় গেছে। এই মরেছে দেখ, এক্ষুনি তোমাকে আমি বলেছিলাম না যে, আমি খুব বেশি আশাবাদী হতে চাই না? আমার ঘাট হয়েছে, সাধে কি ওরা আমার নাম দিয়েছে ‘টুকটুকে বিরোধের পুটুলি’।
তোমার আনা।
●
মঙ্গলবার, ১ আগস্ট, ১৯৪৪
আদরের কিটি,
‘টুকটুকে বিরোধের পুঁটুলি’–এই বলে ইতি করেছিলাম আমার শেষ চিঠি এবং সেই একই কথা দিয়ে শুরু করছি এটা। ‘টুকটুকে বিরোধের পুটুলি’! আচ্ছা বলতে পারো এটা ঠিক কী? বিরোধ বলতে কী বোঝায়। অন্য অনেক কথার মতো এতে দুটো জিনিস বোঝাতে পারে বাইরে থেকে বিরোধ আর ভেতর থেকে বিরোধ। প্রথমটা হল মামুলি সহজে হার না মানা, সব সময় সেরা বিশেষজ্ঞ বলা, মোক্ষম কথাটা বলে দেওয়া’, সংক্ষেপে, যে সব অপ্রিয় বপণের জন্যে আমি সুবিদিত। দ্বিতীয়টা কী কেউ জানে না, ওটা আমার নিজের গোপন কথা।
এর আগেই তোমাকে আমি বলেছি যে, আমার রয়েছে যেন এক দ্বৈত ব্যক্তিত্ব তার একার্থ ধারণ করে আছে। আমার আল্লাদে আটখানা ভাবি, সবকিছু নিয়ে মজা করা, আমার তেজস্বিতা এবং সবচেয়ে বড় কথা, যেভাবে সমস্ত কিছু আমি হালকাভাবে নিই। প্রেমের ভান দেখে নারাজ না হওয়া, চুমো, জড়িয়ে ধরা, অশ্লীল রসিকতা–সব এর মধ্যে পড়ে। এই দিকটা সাধারণত ওৎ পেতে থাকে এবং অন্য যে দিকটা ঢের ভালো, ঢের গভীর, ঢের বেশি খাঁটি–সেই দিকটাকে দুম করে ঠেলে সরিয়ে দেয়। তোমাকে এটা বুঝতে হবে যে, তুলনায় আনার সেটা ভালো দিক সেটার কথা কেউ জানে না এবং সেইজন্য অধিকাংশ লোকের কাছে আমি অসহ্য।
এক বিকেলে আমি হই অবশ্যই এক মাথাঘোরানো ভাঁড়; ব্যস, আর একটা মাস ওতেই ওদের চলে যাবে। গভীর চিন্তাশীল লোকদের পক্ষে যেমন প্রেমমূলক ফিল্ম–নিছক চিত্তবিনোদন, মজাদার শুধু একবারের মতো। এমন জিনিস যা অল্পক্ষণ পরেই ভুলে যাওয়া যায়, মন্দ নয়, তবে নিশ্চয়ই ভালো বলা যায় না। সত্যি বলতে, এও ঠিক তাই। তোমাকে এসব বলতে খুবই খারাপ লাগছে; কিন্তু যাই হোক এ জিনিস যখন সত্যি বলে জানি, তখন বলব নাই বা কেন? আমার যে দিকটা হালকা ওপর, সেটা আমার গভীরতর দিকের তুলায় সব সময়ই বড় বেশি প্রাণবন্ত মনে হবে এবং তাই সব সময়ই কিস্তি মাত করবে। তুমি ধারণা করতে পারবে না ইতিমধ্যেই আমি যে কত চেষ্টা করেছি। এই আনাকে ঠেলে সরিয়ে দিতে, তাঁকে পঙ্গু করে দিতে, কেননা, সব সত্ত্বেও, যাকে আনা বলা হয়, সে হল তার অর্ধেক মাত্র; কিন্তু তাতে কাজ হয় না এবং আমি এও জানি, কেন তাতে কাজ হয় না।
অষ্টপ্রহর আমি যা সেইভাবে যারা আমাকে জানে, পাছে তাঁদের চোখে পড়ে যায় আমার অন্য দিক, যেটা সূক্ষ্মতর এবং অনেক ভালো। তাই আমি বেজায় ভয়ে ভয়ে থাকি। আমার ভয়, ওরা আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে, মনে করবে আমি উপহাসযোগ্য আর ভাবপ্রবণ। আমাকে ওরা গুরুত্ব দিয়ে নেবে না। গুরুত্ব দিয়ে না নেওয়াতে আমি অভ্যন্ত; কিন্তু তাতে অভ্যন্ত এবং তা সইতে পারে তো শুধু ফুর্তিবাজ আনা; সিকিভাগ সময়ের জন্যে মঞ্চে গিয়ে দাঁড়াতে আমি যদি সত্যিকার বাধ্যও করি, তাহলেও মুখ থেকে কথা বের করতে গিয়ে সে একেবারে কুঁকড়ে যায় এবং শেষে পয়লা নম্বর আনাকে তার জায়গায় দাঁড়াতে দিয়ে, আমি বুঝবার আগেই, সে হাওয়া হয়ে যায়।
সুতরাং লোকজন থাকলে ভালো আনা কখনই সেখানে থাকে না, এ পর্যন্ত একটিবারও সে দেখা দেয়নি, কিন্তু আমরা একা থাকলে প্রায় সব সময়ই সে এসে জাকিয়ে বসে। আমি ঠিক জানি, আমি কি রকম হতে চাই, সেই সঙ্গে আমি কি রকম আছি… ভেতরে। কিন্তু হায়, আমি ঐ রকম শুধু আমারই জন্যে। হয়ত তাই, না, আমি নিশ্চিত যে, এটাই কারণ যে জন্যে আমি বলি আমার হাসিখুশি স্বভাবটা ভেতরে এবং যে জন্যে অন্য লোকে বলে আমার হাসিখুশি স্বভাবটা বাইরে। ভেতরের বিশুদ্ধ আনা আমাকে পথ দেখায়, কিন্তু বাইরে আমি দড়ি ছিঁড়ে নেচেগেয়ে বেড়ানো ছাগলছানা বৈ কিছু নই।
যেটা আমি আগেই বলেছি, কোনো বিষয়ে আমি আমার আসল অনুভুতির কথা কখনও মুখ ফুটে বলি না এবং সেই কারণে আমার নাম দেওয়া হয়েছে ছেলে-ধরা, ছেনাল, সবজান্তা, প্রেমের গল্পের পড়ুয়া। ফুর্তিবাজ আনা ওসব হেসে ওড়ায়, ধ্যাষ্টামো করে জবাব দেয়, নির্বিকারভাবে কাঁধ ঝাড় দেয়, কেয়ার না করার ভাব দেখায়, কিন্তু হায় গো হায়, মুখচোরা আনার প্রতিক্রিয়া এর ঠিক উল্টো। যদি সত্যি কথা বলতে হয়, তাহলে স্বীকার করব যে, এতে আমার প্রাণে আঘাত লাগে, আমি প্রাণপণে চেষ্টা করি নিজেকে বদলাতে, কিন্তু আমাকে সর্বক্ষণ লড়তে হচ্ছে ঢের জবরদস্ত এক শত্রুর বিরুদ্ধে।
আমার মধ্যে একটি ফোঁপানো কণ্ঠস্বর গুনি–’ও ঈশ্বর, শেষে তোমার এই হাল হয়েছে; কারো ওপর মায়াদয়া নেই, যা দেখ তাতেই নাক সিটকাও, আর তিরিক্ষে নিজের অর্ধাঙ্গিনীর উপদেশে কান দিতে চাও না।’ আমি কান দিতে চাই গো, চাই কিন্তু ওতে কিছু হয় না; যদি আমি চুপচাপ থেকে গুরুতর কোনো বিষয়ে মন দিই, প্রত্যেকে ধরে নেয় ওটা কোনো নতুন রঙ-তামাসা এবং তখন সেটাকে হাসির ব্যাপার করে তুলে তা থেকে আমাকে বেরিয়ে আসতে হয়। আমার নিজের পরিবারের কথাই বা কী বলি–ওঁরা নির্ঘাৎ ভেবে বসবেন আমার ঘাড়ে মাথায় হাত ঠেকিয়ে দেখবেন, আমার গায়ে জ্বর আছে কিনা জিজ্ঞেস করবেন। শরীর খারাপ, মাথাধরা আর স্নায়বিক রোগের ওষুধের বড়ি গোলাবেন, জিজ্ঞেস করবেন আমার কোষ্ঠবদ্ধতা হয়েছে কিনা এবং তারপর আমার মেজাজ ভালো নেই বলে আমাকে চোখে চোখে রাখা হয়, আমি শুরু করি খেকি হতে, তারপর অসুখী এবং সবশেষে আমার অন্তঃকরণে মোচড় দিই, যাতে খারাপটা বাইরে পড়ে আর ভালোটা থাকে ভেতরে এবং সমানে চেষ্টা করতে থাকি রাস্তা খোজার, যাতে হওয়া যায় যা হতে চেয়েছি এবং যা হতে পারি, যদি… পৃথিবীতে আর কোনো জনপ্রাণী বেঁচে না থাকত!
-তোমার আনা।
●
আনার ডায়েরি এইখানে শেষ। ৪ঠা আগস্ট, ১৯৪৪–এইদিন সবুজ উর্দি-পরা পুলিস ‘গুপ্ত মহলে’ হানা দেয়। ওখানকার সব বাসিন্দাদের, ক্রালার আর কুপহুইস সমেত, গ্রেপ্তার করে এবং জার্মান আর ডাচ বন্দী নিবাসে পাঠিয়ে দেয়। গেস্টাপো ‘গুপ্ত মহল’ লুট করে। মেঝের ওপর ফেলে দেওয়া পুরনো বই, ম্যাগাজিন আর খবরের কাগজের ডাঁই থেকে মিপ আর এলি খুঁজে বের করেন আনার ডায়েরিটা। আনার বাবা ছাড়া ‘গুপ্ত মহলে’র আর কোনো বাসিন্দাই ফিরে আসতে পারেননি। ক্রালার আর কুপহুইস ডাচ বন্দীনিবাসে দারুণ কষ্টভোগ করে স্বগৃহে নিজের নিজের পরিবারে ফিরে যেতে পেরেছিলেন। হল্যাণ্ডের মুক্তির দুই মাস আগে ১৯৪৫ এর মার্চ মাসে বেরজেন-বেলসেন বন্দীনিবাসে আনার মৃত্যু হয়।
ঠিক তেরো বছর বয়সের এক সদ্য কিশোরী। ডায়েরি লেখার শুরু সেই বয়সেই। দিনে দিনে। কেটে গেছে দুই বছর দুই মাস। পনেরো বছর দুই মাস বয়স পর্যন্ত লিখতে পেরেছিল সেই কিশোরী। ডায়েরির পাতায় শেষ আঁচড় টানার ঠিক সাত মাস পরে এই পৃথিবীর জল-মাটি হাওয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছিল তাঁর। ফ্যাসিস্ট নাৎসীদের নির্মমতার সাক্ষর হিসেবে এই পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে যেতে হয়েছিল তাঁকে। চলে গেছে সে কিন্তু রেখে গেছে তার কালজয়ী অমর দিনলিপি। এ হলো সেই কিশোরীর সেই ডায়েরি, দুই বছর দুই মাসের দিনলিপি–আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি। তাঁর বাবার নাম ছিল অটো ফ্রাঙ্ক, মায়ের নাম এডিথ। মূলত জার্মানির বাসিন্দা তাঁরা, ধর্মে ইহুদি। অটো-এডিথের প্রথম সন্তান মারগট, জন্ম তাঁর ১৯২৬ সালে। দ্বিতীয় সন্তান। আনা–আনা ফ্রাঙ্ক, জন্ম ১৯২৯ সালের ১২ই জুন।
এইসময় জার্মানির মাটিতে মাথা তুলে হুংকার ছাড়ছে হিটলার। চারদিকে বিভৎস অত্যাচার আর ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতে শুরু করেছে তাঁর নাৎসি বাহিনী। এ যেন সরাসরি ইহুদিদের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ ঘোষণা করেছে তাঁরা। অনেক ইহুদিই জার্মানির পাট চুকিয়ে চলে যাচ্ছে অন্য কোনও দেশে, নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। ১৯৩৩ সালে দেশ ছাড়লেন অটো ফ্রাঙ্কও। চলে গেলেন হল্যাণ্ডে। আনা ফ্রাঙ্ক তখন চার বছরের শিশু।
এর ঠিক ছয়বছর পর শুরু হল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। পৃথিবী দখলের দুর্বার স্বপ্ন দেখছে নাৎসী হিটলার। জার্মানি ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনকে, কারণ তিনি ইহুদি। এদিকে হল্যাণ্ডের আলো-হাওয়ায় বড় হচ্ছে আনা ফ্রাঙ্ক।
কিন্তু ফ্রাঙ্ক পরিবারের হল্যাণ্ডের আশ্রয়ও নিরাপদ রইল না। হিটলারের নাৎসিবাহিনী হল্যাণ্ড দখল করল। শুরু হল ইহুদিদের ওপর অত্যাচার। অসংখ্য ইহুদিকে পাঠানো হল বন্দীশিবিরে। ১৯৪২ সালের জুলাই মাসে সরাসরি সমন এল অটো ফ্রাঙ্কের নামে। আসলে, সেই সমন ছিল তার বড় মেয়ে মারগটের নামে। মারগট তখন ষোড়শী সুন্দরী। নাৎসী বাহিনীর কয়েকজন অফিসারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে তাঁর রূপ-সৌন্দর্য। তাঁকে হাতছানি দিল বন্দীশিবির। কিন্তু সে-ডাকে সাড়া দিলেন না অটো ফ্রাঙ্ক। সমস্ত পরিবার সহ নিলেন এক চরম ঝুঁকি। নিজেদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের পেছনদিকে এক গোপন আস্তানায় আশ্রয় নিলেন সপরিবারে। সঙ্গে রইল আরও একটি পরিবার। এই সময় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন তাঁর অতি কাছের কয়েকজন ইংরেজ বন্ধু। আনা ফ্রাঙ্কের বয়স তখন সবেমাত্র তেরো বছর এক মাস। এক সদ্য কিশোরী। যে বয়সটা তাঁর থাকার কথা ছিল স্কুলে। পৃথিবীর খোলা আলো-বাতাসে প্রাণের অপরিমিত উচ্ছাসে যার দিন কাটাবার কথা ছিল সেই কিশোরী আনা ফ্রাঙ্ককে বরণ করে নিতে হলো ঘুপচি ঘরের নিরাপদ আশ্রয়। রাতের বেলা যেখানে ৰাতি জ্বালানো নিষেধ ছিল। দিনের বেলায় কোন জানালা খোলার উপায় ছিল না। সে এক অপরিসীম সহ্যাতীত সময়।
এইসময় কলম উঠে এলো সদ্য কিশোরী আনা ফ্রাঙ্কের হাতে। নিজের মনের কথা, সেই সময়ের বিস্তারিত বিবরণ লিপিবদ্ধ হতে শুরু করলো কাগজের পাতায় পাতায়। অনেক কষ্ট, অনেক ত্যাগ আর সেই সময়ের কষ্টার্জিত জীবন-যাপন প্রণালীর দিনলিপি একের পর এক লিখে চললো কিশোরী আনা ফ্রাঙ্ক।
এরপর পেরিয়ে গেল একে একে পঁচিশটা মাস। চারদিকে চলছে হিটলারের নাৎসীবাহিনীর অত্যাচার। সেই অত্যাচারের খবরে কেঁপে কেঁপে উঠছে গোপন আস্তানায় লুকিয়ে থাকা ফ্রাঙ্ক পরিবার। কখনও ভয়ে আতঙ্কে কাতর হয়ে নিশ্চুপ –আসলে এছাড়া তো তাঁদের আর করার কিছুই নেই। কারণ বাইরে বের হলেই নাৎসী বাহিনীর হাতে পড়ার সম্ভাবনা। আর তারপর আতঙ্কময় সেই বন্দীশিবির – যেখান থেকে ফিরে আসার কোন সম্ভাবনা নেই। এভাবেই হয়তো পেরিয়ে যেত দিন, আতঙ্ক আর বিভীষিকাময় দিন রাতগুলো হয়তো যুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত পার করতে পারতো ফ্রাঙ্ক পরিবার–সেই ঘুপচি ঘরগুলোর মধ্যে বাস করে। কিন্তু সেটাও হলো না। গোপন আস্তানায় আশ্রয় নেবার পঁচিশ মাস পর, ১৯৪৪ সালের ৪ঠা আগস্ট, সেখানে হানা দিয়েছিল নাৎসিবাহিনী, আটজন ইহুদি মানুষকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল বন্দীশিবিরে। জার্মানির আউশভিৎস বন্দীশিবিরে ১৯৪৫ সালের ৬ই জানুয়ারি মারা যান আনার মা। মারগট আর আনাকে পাঠানো হয় আরও দূরবর্তী বেরজেন-বেসেন বন্দীশিবিরে। ১৯৪৫-এর ফেব্রুয়ারির শেষদিকে অথবা মার্চের শুরুতে সেখানেই মারা যায় মারগট। আর মার্চ মাসেই, ওই বন্দীশিবিরেই, শেষবারের মতো চোখ বুজেছিল পনেরো বছর নয় মাসের সেই কিশোরী আনা ফ্রাঙ্ক।
বন্দীশিবির থেকে ফিরতে পারেননি অন্য পরিবারের তিনজন সদস্য এবং দাঁতের ডাক্তার ডুসেল-ও। মৃত্যুর অন্ধকার থেকে ফিরে এসেছিলেন শুধু একজন। তিনি ছিলেন মারগট আর আনা-র বাবা অটো ফ্রাঙ্ক। আর তখনই তাঁদের দুই শুভার্থী–এলি আর মিপ, তাঁর হাতে তুলে দিয়েছিলেন লাল ডোরাকাটা মলাটের একটা ডায়েরি এবং আরও কিছু কাগজ–এগুলো ছিল আনার লেখা। আনার দিনলিপি। আনার গল্প-উপন্যাস-স্মৃতিকথা।
তারপর প্রকাশিত হয়েছিল সেই দিনলিপি– ‘আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি’ নামে। প্রকাশিত হবার পরই শুরু হলো আসল ইতিহাস। সারা পৃথিবী যেন চমকে গেল একজন সদ্য কিশোরীর কলমের আঁচড়ে। পরবর্তীতে এই সদ্যকিশোরীর দিনলিপি অনূদিত হয়েছে পৃথিবীর প্রায় সমস্ত ভাষায়, তৈরি হয়েছে চলচ্চিত্র, মঞ্চস্থ হয়েছে নাটক।
এক আশ্চর্য অনুভূতি তৈরি হয় পাঠকের মধ্যে এই ডায়েরি পড়তে গিয়ে। কখন যেন এতে খুঁজে পাওয়া যায় একজন কিশোরী আনাকে; পরক্ষণেই পাঠককে বিস্মিত করে সামনে। এসে দাঁড়াবে আশ্চর্য গভীর আনা ফ্রাঙ্ক। সেই সময়ের বিভীষিকাময় দৈনন্দিন ঘটনার বর্ননার পাশাপাশি তেরো থেকে পনেরোর দিকে হেঁটে-চলা কিশোরী অনায়াসে কথা বলে গেছে দর্শন, ঈশ্বর, মানবচরিত্র এমনকি প্রেম-প্রকৃতি-জীবনবোধ নিয়েও। পাশাপাশি ফুটে উঠেছে সমকালীন ইতিহাস, ইহুদিদের লাঞ্ছনা-যন্ত্রণা-সংগ্রাম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একটি খন্ডকালীন ছবি।
সেই শুরু থেকেই লেখিকা হওয়ার স্বপ্ন ছিল আনা ফ্রাঙ্কের। তাঁর স্বপ্ন ছিল এমন কিছু করার যাতে সে মৃত্যুর পরেও বেঁচে থাকতে পারবে–সাধারণ মানুষের অন্তর জুড়ে। কিন্তু তা হলো না। যে ফুল ফুটলে চারদিক ভরে যেতে পারতো অন্তহীন সুবাসে–সেই ফুলের ফোটা হলো না। ঝরে যেতে হয়েছে তাঁকে কুঁড়িতেই।
কিন্তু বেঁচে আছে তাঁর সেই অমর দিনলিপি। বাঁচিয়ে রেখেছে তাঁকে বিশ্বজুড়ে পাঠকের অন্তরে। বেঁচে থাকবে আনা ফ্রাঙ্ক, বেঁচে থাকবে তাঁর ডায়েরি।
তথ্যসূত্র:
১- Anne Frank: The Diary of a Young Girl, Translated by B.M. Mooyaart, Bantam (১৯৯৩)।
২- Anne Frank’s Tales from the Secret Annex, Anne Frank, RHUS (২০০৩)।
৩- আনা ফ্রাঙ্কের সন্ধানে, আর্নস্ট শ্ন্যাবেল, অনুবাদক – মোস্তাক আহ্মাদ, দি স্কাই পাবলিশার্স।)
লেখকঃ রানা চক্রবর্তী