‘আমেনহোটেপ’ শব্দটির অর্থ ‘আমুন সন্তুষ্ট’। সে সময় দেবতা আমুনই ছিলেন প্রধান এবং ফারাও তৃতীয় আমেনহোটেপও দেবতা আমুনের প্রতি নিবেদিত ছিলেন। তিনি এতোটাই নিবেদিত ছিলেন যে, সামরিক অভিযান থেকে অর্জিত সমস্ত সম্পদ তিনি আমুনের মন্দিরে দান করতেন। সে সময় মিশরের ধর্মীয় রাজধানী ছিলো ‘থিবস’ এবং প্রশাসনিক রাজধানী ছিলো ‘মেম্ফিস’। আমুনের সন্তুষ্টির আশায় তিনি থিবসেই দান বা উৎসর্গ অনুষ্ঠান পালন করতেন। তবে অধিকাংশ সময় তাকে মেম্ফিসেই থাকতে হতো।
বাবা চতুর্থ থুতমোসের কাছ থেকে একদম গোছানো শক্তিশালী এক রাজ্য উপহার পেয়েছিলেন ফারাও তৃতীয় আমেনহোটেপ। আরও বেশি সমৃদ্ধ করে গড়ে তুলেছিলেন তিনি একে। তাই তৃতীয় আমেনহোটেপের রাজত্বকাল খুব গুছিয়ে নথিবদ্ধ করা সম্ভব হয়েছিলো।
প্রথম টেলিগ্রাম ব্যবস্থার সূত্রপাত তিনিই করেছিলেন। সৌভাগ্যের প্রতীক গুবরে পোকার আকৃতিতে তৈরী সাড়ে তিন থেকে চার ইঞ্চি চওড়া পাথরের মধ্যে হায়ারোগ্লিফিক লিপি খোদাই করে তিনি তার জীবনের ঘটনাবলি ও সাফল্যের গাঁথা লিপিবদ্ধ করে রাখতেন। প্রচার ও প্রোপাগান্ডার বার্তাগুলো বহন করতো গুবরে পোকার আকৃতিতে তৈরী এই স্মারকগুলো। তা ছাড়া সামাজিক সচেতনতা ও রাজকীয় ঘটনাবলির বিভিন্ন তথ্য সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়ার মাধ্যম হিসেবেও ব্যবহৃত হতো পাথরের এই গুবরে পোকাগুলো। তবে তথ্য সম্প্রসারণের এই পদক্ষেপের পেছনে ফারাও এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য ছিলো, সামন্ত প্রদেশগুলোকে নিজের শক্তি ও ক্ষমতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল বা সতর্ক করে দেয়া, যেনো তারা কখনোই ফারাও এর বিরুদ্ধাচরণ করবার সাহস না পায়। মিশরের প্রত্যেকটি জায়গায় এবং সিরিয়া, ফিলিস্তিন ও নুবিয়াতে এই পাথুরে গুবরে পোকাগুলো পাঠানো হতো।
কি ছিলো না সেই স্মারকগুলোতে! ফারাও এর বিয়ের ঘটনাবলি, তার রাজ্যের বিবরণ, এমনকি শিকারি হিসেবে তার দক্ষতার ছবিও খোদাই করা হয়েছিলো স্মারকগুলোতে। এ ছাড়াও অসংখ্য স্থাপনা তিনি তৈরী করেছিলেন, যেগুলো থেকে তার সম্পর্কে অগণিত তথ্য পাওয়া যায়। প্রায় ২৫০ টি স্থাপনা তিনি নির্মাণ করেছিলেন।
তৃতীয় আমেনহোটেপের রাজত্বকালে একটি দীর্ঘ সময় প্রজারা শান্তিতে বসবাস করতে পেরেছেন, যার ফলে সে সময় অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে শক্তিশালী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশগুলোকে বোঝাতে আমরা ‘সুপার পাওয়ার’ কথাটি ব্যবহার করে থাকি। তৃতীয় আমেনহোটেপের সময়কালে তার শাসিত রাষ্ট্রকেই এই ‘সুপার পাওয়ার’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হতো।
তৃতীয় আমেনহোটেপের স্ত্রী ছিলেন টিয়ে। স্ত্রীর সাথে তার মিষ্টি সম্পর্কের বিষয়টি তার নির্মিত বিভিন্ন স্থাপনা ও পাথুরে গুবরে পোকার স্মারকগুলো থেকে জানা যায়। স্ত্রী টিয়েকে ভীষণ ভালোবাসতেন তিনি। শুধু তা-ই নয়, তাকে প্রচন্ড সম্মানও করতেন ফারাও। টিয়ের গর্ভে তার ছয় জন সন্তানের জন্ম হয়েছে।
অবশ্য টিয়ে ছিলেনও একজন যোগ্য রাণী। তিনি শিক্ষিত ছিলেন। আমার্না চিঠিগুলো থেকে জানা যায়, বহু ভাষায় পারদর্শী ছিলেন টিয়ে। তার নিজস্ব লাইব্রেরিও ছিলো। ফারাও এর বিশাল হারেম থাকা সত্ত্বেও তিনি টিয়েকেই তার প্রধান স্ত্রীর মর্যাদা দিয়েছিলেন। টিয়ে কোনো রাজকীয় নারী ছিলেন না। তবুও তার যোগ্যতা তাকে ফারাও এর সমমর্যাদায় আসীন করেছিলো। মিটান্নির রাজা তুশরাত্তার সাথে তার নিয়মিত চিঠিপত্র আদান-প্রদান হতো এবং সেসব চিঠিতে রাষ্ট্রীয় বিষয় বাদেও অনেক আন্তরিক আলাপের প্রমাণ মিলেছে, যা বিদেশী শাসকদের সাথে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রক্ষারই প্রতিফলন। বিদেশী শক্তির সঙ্গে বাণিজ্যিক চুক্তি গঠনের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজও তিনি করেছেন। শক্তিশালী কূটনৈতিক বুদ্ধিমত্তা ও পরামর্শ প্রদানের মাধ্যমে সর্বদা স্বামীর পাশে সহাবস্থান করেছেন তিনি এবং ফারাও এর একজন ‘মহান স্ত্রী’-র ভূমিকায় সার্থকতার সাথে অবতীর্ণ হয়েছিলেন।
ফারাও তৃতীয় আমেনহোটেপ দক্ষিণের দিকে একটি চমৎকার প্রাসাদ তৈরী করেছিলেন, যার নাম রাখা হয়েছিলো ‘মালাকাটা প্রাসাদ’। কাদামাটি ও ইট দিয়ে তৈরী প্রাসাদটি সাদা জিপসাম দিয়ে প্লাস্টার করা হয়েছিলো এবং প্লাস্টারের উপরে দেবতা, গাছপালা ও বিভিন্ন প্রাণীর ফ্রেস্কো করা হয়েছিলো। এই মালাকাটা প্রাসাদের পাশেই প্রিয় স্ত্রী টিয়ের জন্য তিনি একটি বিশাল হ্রদ ও তাতে সুন্দর সময় যাপনের জন্য একটি নৌকা তৈরী করেছিলেন। হ্রদটি লম্বায় প্রায় এক মাইল ছিলো।
পুরোহিত সমাজের অযাচিত ক্ষমতা বৃদ্ধিকে অত্যন্ত কৌশলে দমিয়ে রেখেছিলেন ফারাও তৃতীয় আমেনহোটেপ, যেটি তার ছেলে আখেনাতেন করতে অসমর্থ ছিলেন। আখেনাতেন একেশ্বরবাদ প্রতিষ্ঠার আড়ালে ক্ষমতাবান পুরোহিতদের ক্ষমতা হ্রাস করতে চাইলেও হয়েছিলো হিতে বিপরীত। আখেনাতেনের অতি দ্রুত পরিবর্তন আনয়নের প্রচেষ্টা শক্তিশালী মিশরকে একেবারে নাজেহাল করে দিয়েছিলো, প্রায় দেউলিয়া হবার পথে ছিলো মিশর।
তবে ধর্মীয় পরিবর্তনের হাওয়া অবশ্য তৃতীয় আমেনহোটেপ বেঁচে থাকাকালীনই বইছিলো। কেননা ফারাও এর সাধারণত অবসর যাপন বাদে অন্য সময় প্রশাসনিক রাজধানী মেম্ফিসে অবস্থান করবার কথা থাকলেও শেষ সময়ে তৃতীয় আমেনহোটেপ মালাকাটা প্রাসাদে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছিলেন এবং নাম গ্রহণ করেছিলেন ‘ড্যাজলিং সান ডিস্ক অফ অল ল্যান্ডস’। এ ছাড়াও রাণী টিয়ের জন্য নির্মিত নৌকাটির নামও তিনি দিয়েছিলেন ‘দ্য অ্যাথেন গ্লিমস’। এ সব ঘটনা থেকে এমনটাই মনে হয় যে, তৃতীয় আমেনহোটেপের জীবনের শেষ সময়ে সূর্য বা দেবতা আতেন ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিলো।
নিজের জন্য একটি শবাগার মন্দিরও তিনি নির্মাণ করেছিলেন, যেখানে তাকে পূজা করা হতো। মন্দিরটির সামনে তিনি নিজের প্রায় ৬০ ফুট উঁচু বিশাল প্রতিকৃতি বানিয়েছিলেন, যাদেরকে ‘কলোসি অফ মেমনন’ বলে ডাকা হতো। তবে দুটি মূর্তির মধ্যে একটি ছিলো স্থানীয়দের জন্য বিশেষ। স্থানীয়দের বিশ্বাস ছিলো, মূর্তিটির মাধ্যমে স্বয়ং ফারাও কথা বলতেন। এই বিশেষ মূর্তিটির নাম রাখা হয় ‘ভোকাল মেমনন’। আসলে মূর্তিটিতে ছিলো ফাটল এবং সূর্যের আলো মূর্তিটির ওপর পড়লে সদ্য গরম হয়ে ওঠা মূর্তি প্রসারিত হয়ে ফাটলে ভেতর বাতাস চলাচলের কারণে একটি বাঁশির মতো শব্দ হতো। সবার ধারণা হলো, এই ভোকাল মেমনন কথা বলে। তবে সম্প্রতি ফাটলটি ঠিক করা হলে এতে আর কোনো শব্দ হয় না।
খ্রিস্টপূর্ব ১৩৮৬ থেকে ১৩৫৩ সাল পর্যন্ত প্রায় ৩৯ বছর রাজত্ব করা ফারাও তৃতীয় আমেনহোটেপের শেষ সময়টা ভীষণ অসুস্থতার মধ্যে কেটেছিলো। ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে গড়ে তোলা বড় ছেলে থুতমোসও মারা গিয়েছিলেন ফারাও হবার আগেই। তাই তার মৃত্যুর পর ছোট ছেলে চতুর্থ আমেনহোটেপই ফারাও হয়েছিলেন, যিনি পরবর্তীতে নিজের নাম আখেনাতেন রেখেছিলেন। তবে রাণী টিয়ে ছেলের রাজত্বকালেও আগের মতোই শক্তিশালী ও প্রভাবশালী ভূমিকা নিয়ে মিশর শাসনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো গ্রহণ করেছিলেন। তৃতীয় আমেনহোটেপই প্রথম ফারাও, যাকে পশ্চিম উপত্যকায় সমাহিত করা হয়েছিলো।
রেফারেন্সঃ
- Amenhotep III
- Tiye
- ‘মিশরীয় মিথলজি আদি থেকে অন্ত’ –এস এম নিয়াজ মাওলা