অত্যন্ত দুরন্ত ও উচ্ছৃঙ্খল একটা ছেলে সে। উচ্ছৃঙ্খল আচরণের জন্য শৈশবে তাকে তার খালার বাসায় পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিলো। প্রতিবেশীদের বাড়ির কাঁচও ভেঙ্গে ফেলতো সে পয়সার জন্য। বাবা- মা ছেলেকে নিয়ে দিশেহারা। সে ছেলে আর কেউ নয়, লর্ড ক্লাইভ। বোঝাই যাচ্ছে, সে ছিলো বাবা-মায়ের দুশ্চিন্তার প্রধান কারণ। তবে আশ্চর্যের বিষয়, সেই ছেলেই একদিন ইংল্যান্ডের জন্য বয়ে আনে বিপুল সম্পদের ভান্ডার। বলছিলাম ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠার অন্যতম সেনানায়ক লর্ড ক্লাইভের কথা। বাংলাদেশ থেকে শুরু করে ভারতের সিংহভাগ মানুষ জানেন রবার্ট লর্ড ক্লাইভ কে ছিলেনl
‘ক্লাইভ’ ইংরেজদের কাছে পরম শ্রদ্ধার একটি নাম হলেও ভারতবর্ষের মানুষের কাছে তিনি একজন অতি জঘন্য লুটেরা ব্যাক্তি। লর্ড ক্লাইভই তার সমরকৌশল এবং কূটকৌশলের জোরে নবাব সিরাজউদ্দৌলার বাহিনীকে পরাজিত করেছিলেন। বাংলাতে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন ইংরেজ শাসন। তবে বাংলার ইতিহাসের জনপ্রিয় বর্ণনাগুলোতে মহানায়কের পরিবর্তে রবার্ট ক্লাইভ খলনায়কের উপাধিই পেয়েছেন, যেখানে পরাজিত হয়েও নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে মহানায়ক হিসেবে দেখানো হয়।
রিচার্ড বোলেস্লাভোস্কির পরিচালনায় ১৯৩৫ সালের দিকে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ক্লাইভ অফ ইন্ডিয়া’ সিনেমায় দেখানো হয়েছে ফরাসি সেনাদলের সঙ্গে লড়াই করে জেতার ক্ষেত্রে রবার্ট ক্লাইভের দুর্ধর্ষ নেতৃত্ব আর অসম সাহসিকতা। তবে এটি ছিলো ইংরেজদের প্রোপাগান্ডামূলক একটি সিনেমা l তাই অনেকেই এ চলচ্চিত্র দেখে মনে করতে পারেন রবার্ট ক্লাইভ না থাকলে হয়তো ভারতবর্ষের কোন উন্নতিই হতো না। ফরাসিদের সাথে ইংরেজদের যুদ্ধ বহুদিনের, আর পলাশী যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পক্ষ নিয়ে যুদ্ধ করেছিলো ফরাসিরা। এজন্য এই ঘটনাটাকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য ইংরেজরা ঐতিহাসিক এই যুদ্ধকে ফরাসি-বৃটিশ যুদ্ধ বলেও অভিহিত করেন। তাহলে চলুন, দেখে আসা যাক, কে এই রবার্ট ক্লাইভ? এবং তার শেষ পরিণতি কি হয়েছিলো?
ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, ইংল্যান্ডের ওয়েস্ট মিডল্যান্ডের শ্রোপশ্যায়র কাউন্টির মার্কেট ড্রাইটোন শহরে ১৭২৫ সালে ক্লাইভ পরিবারে রবার্ট ক্লাইভ জন্মগ্রহণ করেন। সম্রাট চতুর্থ হেনরি এর আমলে ক্লাইভ পরিবারের একটি ছোট জমিদারি ছিলো। তার বাবা তাকে প্রথমে গ্রামার স্কুলে ভর্তি করে দেন, কিন্তু উচ্ছৃঙ্খল আচরণের জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষ অভিযোগ তোলে, পরে অন্য স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়া হয় তাকে। এখানেও উচ্ছৃঙ্খল আচরণের জন্য বহিস্কৃত হন তিনি। তিনটি স্কুল থেকে বহিস্কৃত হওয়ায় তাঁর পরবর্তী শিক্ষাকার্যক্রম ব্যাহত হয়। পরে তিনি নিজের মতো করে লেখাপড়া করতে থাকেন। তার বাবা মা তার অত্যাচার থেকে কিছুটা সময় মুক্তি পাবার জন্য তাকে ম্যানচেস্টারে তার খালার বাসায় পাঠিয়ে দেন।
নয় বছর বয়সের সময় ক্লাইভের খালা মারা গেলে তিনি আবার বাবা-মায়ের কাছে ফিরে আসেন। কিন্তু তার আচরণের কোনো পরিবর্তন হয় না। আরো বেশি উচ্ছৃঙ্খল ও ভবঘুরে স্বভাবের হয়ে যান তিনি। এমনকি কিছু আজেবাজে ছেলেদের সাথে মিশে অসামাজিক কাজের সাথেও জড়িয়ে পড়ে্ন তিনি। এভাবে আরো কিছুদিন চলার পর তার যখন ১৮ বছর বয়স তখন তার বাবা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে তার জন্য একটা ছোট চাকরির ব্যবস্থা করে দেন। তার বেতন ছিল ৫ পাউন্ড পুরো এক বছরের জন্য, আর অতিরিক্ত কাজের জন্য আরো ৩ পাউন্ড পাবে, অবশ্য খাওয়া ও থাকা ছিলো ফ্রী। দিন যায় মাস যায়, এভাবে কাজ করতে করতে ১৭৪৩ সালে তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জাহাজে করে প্রথম ভারত উপমহাদেশের উদ্দেশ্যে তিনি রওনা দেন। সে সময় ইংল্যান্ডের সবচেয়ে লোভনীয় চাকুরি ছিল এই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চাকুরি।
শুরু হলো এক নতুন জীবন। মাদ্রাজের এই নতুন জীবনে আসার পর কর্ণাটের যুদ্ধে ক্লাইভ একবার ফরাসিদের হাতে বন্দি হন। তবে বুদ্ধি করে একজন স্থানীয় লোকের ছদ্মবেশে পালিয়ে পন্ডিচেরির সেন্ট ডেভিড দুর্গে আশ্রয় নিয়েছিলেন। এরপর ক্লাইভ কোম্পানির চাকরি ছেড়ে ১৭৪৮ সালে মাদ্রাজ সেনাবাহিনীতে সর্বনিম্ন কমিশনপ্রাপ্ত অফিসার হিসেবে যোগদান করেন। তার জীবনী লেখক ম্যালকমের মতে, তিনি একজন উচ্ছৃঙ্খল অফিসার ছিলেন। কিন্তু উচ্ছৃঙ্খলতার সাথে শৌর্যের সমন্বয় ঘটায় উগ্রস্বভাববিশিষ্ট হওয়া সত্ত্বেও ক্লাইভ সামরিক কর্তৃত্বলাভ করেছিলেন। লেফটেন্যান্ট হিসেবে তিনি একবার এক মারাঠা নেতার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন এবং মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় দেবীকোট দুর্গ অধিকার করেন।
১৭৫৩ সালে ক্লাইভ লন্ডনে ফিরে গেলে ভারতবর্ষের দাক্ষিণাত্য বিজয়ের জন্য তাকে বীরোচিত সংবর্ধনা দেয়া হয় এবং কর্ণাটের যুদ্ধে সাফল্যের জন্য কোর্ট অব ডাইরেক্টর্স তাকে ‘জেনারেল ক্লাইভ’ নামে আখ্যায়িত করে একটি রত্নখচিত তরবারি উপহার দেয়। ইংল্যান্ডে প্রচুর অর্থ নিয়ে গেলেও তার সেই আগের উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপনে ফিরে যাওয়ার কারণে বেহিসাবি টাকা খরচ করে প্রায় সব টাকা-পয়সা শেষ করে ফেলেন ক্লাইভ। ভারতবর্ষ থেকে আয় করা টাকা দিয়ে তিনি শুধুমাত্র বাবার কিছু পাওনা পরিশোধ করতে পেরেছিলেন। অবশেষে নিঃস্ব রবার্ট ক্লাইভ দ্বিতীয়বার আবারও ভারতবর্ষের দিকে লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকান। ১৭৫৫ সালে এবার তিনি ডেপুটি গভর্নর হিসেবে মাদ্রাজে ফিরে আসেন। ফিরে আসার কিছুদিনের মধ্যেই রবার্ট ক্লাইভ প্রমোশন পেয়ে লেফটেন্যান্ট কর্ণেল হয়েছিলেন। কিন্তু তার খারাপ মদ্যপ চরিত্র বদলায়নি, উচ্ছৃঙ্খলতা ও কূটকৌশলগত স্বভাব তার মজ্জাগত। ক্লাইভ ভারতবর্ষে ছিলেন ১৭৪৬ থেকে ১৭৭৪ সাল পর্যন্ত। এই সময়কালে তিনি মাদ্রাজ, কর্ণাটকসহ দক্ষিণ ভারতে ফরাসি বাহিনী ও অন্যান্য দেশীয় মারাঠা রাজাদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হন। উপমহাদেশে এসেই তিনি ভারতবর্ষ তথা বাংলা-বিহার-উড়িষ্যায় ব্রিটিশ আধিপত্য বিস্তারে কূটকৌশল চালাতে থাকেন। বাংলার পলাশী রণাঙ্গনের সাফল্য উপমহাদেশের রাজনীতির পাশাপাশি তার জীবনকেও একেবারে পাল্টে দিয়েছিলো ও চরম সৌভাগ্য বয়ে এনেছিলো তার জন্য।
ভারতবর্ষে তখন টালমাটাল অবস্থা। ১৭৫৭ সাল। মুঘল শক্তিও পতনের দিকে। সেইসময় মাদ্রাজ জয় করার পর ক্লাইভ ও তার সঙ্গীরা উৎসব উদযাপন করছে। ঠিক তখনি খবর এলো বাংলার নবাব সিরাজের বাহিনী কোলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ দখল করে নিয়েছে। জানা যায় যে, কোলকাতা ও আশেপাশের ইংরেজ বসতি থেকে বিতাড়িত সকল ইংরেজ বণিক ও নাগরিক কোলকাতার ভাটিতে আশ্রয় নিয়েছে এবং তারা জ্বরে আক্রান্ত হয়ে, বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্যের অভাবে মারা যাচ্ছে। এই বিপজ্জনক সময়ে মাদ্রাজ কর্তৃপক্ষ উদ্ধারকাজ পরিচালনার জন্য ক্লাইভকে সর্বাপেক্ষা যোগ্য ব্যক্তি বিবেচনা করে। ১৭৫৬ সালের ১৬ অক্টোবর ক্লাইভের নেতৃত্বে একটি সেনাবাহিনী নৌপথে মাদ্রাজ থেকে যাত্রা শুরু করে কোলকাতা পুনরদ্ধারের জন্য। এ সময় সাহায্যকারী নৌবাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন অ্যাডমিরাল ওয়াটসন। ক্লাইভ ও ওয়াটসনের যৌথ অভিযানের ফলে ১৭৫৭ সালের ২ জানুয়ারি খুব সহজেই কোলকাতা পুনর্দখল সম্ভব হয় এবং সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গে ‘আলীনগর চুক্তি’ নামে একটি শান্তি চুক্তি হয়। ‘আলীনগর’ হলো কোলকাতার পুরনো নাম। রবার্ট ক্লাইভ তার সামরিক কৌশলের মাধ্যমে কোলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ জয় করেন এবং গভর্নর পদে অধিষ্ঠিত হন। প্রকৃতপক্ষে ক্লাইভ নিজেই নিজেকে গভর্নর হিসেবে ঘোষণা করেন।
তারপর তিনি মীরজাফরসহ অন্যান্য জমিদার ও জগৎ শেঠদের মত বড় বড় ব্যাংকারদেরকে ষড়যন্ত্র ও কূটকৌশলের মাধ্যমে নিজের দলে ভেড়াতে সক্ষম হন। এর কিছুদিন পরেই ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আমবাগানে প্রহসনমূলক যুদ্ধের মাধমে ক্লাইভ পুরো বাংলা জয় করে নেন। ক্লাইভ না থাকলে হয়তো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারত জয় করতে পারতো না। পলাশীর যু্দ্ধে তিনি ছিলেন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাপতি। তাকে পলাশীর প্রথম ‘ব্যারন’ (যুদ্ধবীর) ছাড়াও ‘মেজর জেনারেল দ্য রাইট’, ‘অনারেবল দ্য লর্ড ক্লাইভ’, ‘কেবি’, ‘এমপি’, ‘এফআরএস’ ইত্যাদি সনদ ও সম্মাননায় ভূষিত করা হয় ইংরেজ জাতির ঐতিহাসিক রূপকার হিসেবে।
পলাশীর যুদ্ধে ক্লাইভের নেতৃত্বে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের মাধ্যমে ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠা হয়। সিরাজের সেনাবাহিনীতে ৫০ হাজার সৈন্য ছিল, আর ইংরেজ সেনা ছিল মাত্র ৩ হাজার। সুতরাং মীরজাফরের প্রতারণা ও বিশ্বাসঘাতকতার জন্যই এই যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলা হেরে যান। নবাব সিরাজকে হারিয়ে ক্লাইভ মীরজাফরের আগেই মুর্শিদাবাদ পৌঁছান এবং নবাবের খাজাঞ্চিখানার সমুদয় ধন-দৌলত লুট করেন। ষড়যন্ত্রমূলক যুদ্ধের শর্ত অনুযায়ী মীরজাফরকে চাপ দিয়ে আরও অতিরিক্ত টাকা আদায় এবং অন্যবিধ লুটতরাজে ক্লাইভ ও তার বাহিনী বাংলায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে।
পলাশীর যুদ্ধের ১০ বছর পর ১৭৬৭ সালে ক্লাইভ ইংল্যান্ড ফিরে যান। কিন্তু ভারত উপমহাদেশে রেখে যান ঘুষ, দুর্নীতি, সম্পদ আত্নসাৎ, প্রাসাদ ষড়যন্ত্র, দুর্বৃত্তায়ন আর অপরাজনীতির এক জঘন্য ইতিহাস। তার দুর্নীতি এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, ১৭৭২ সালে ইংল্যান্ডের পার্লামেন্ট তার দুর্নীতির তদন্ত শুরু করতে বাধ্য হয়। এতে একে একে তার বহু দুর্নীতির তথ্য বেরোতে থাকে। শাস্তি ও আত্মসম্মানের কথা বিবেচনা করে তিনি সব সম্পদের বিনিময়ে তদন্ত বন্ধ করার করুণ আর্তনাদ জানান। তবুও চলতে থাকে তদন্ত।
যদিও বর্তমান বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের সুবিশাল অঞ্চলের উপর ইংরেজদের যে আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো, তার কেন্দ্রে ছিলেন এই রবার্ট ক্লাইভ। শিল্পবিপ্লব থেকে শুরু করে আজকের আধুনিক ইংল্যান্ডের সুবিশাল অট্টালিকা-ভবন নির্মাণের যোগানদাতা আমাদের এই সমৃদ্ধ বাংলা অঞ্চল। ক্লাইভের বসানো পুতুল শাসকদের সহায়তায় ফরাসিরা চরমভাবে প্রতিহত হয় ভারতবর্ষে। তবে এতো কিছু করার পরও ইংল্যান্ড কিন্তু তাকে শেষ জীবনে কোন প্রতিদান দেয়নি। বরং তার বিরুদ্ধে মামলা করে তাকে শাস্তির সম্মুখীন করেছিলো।
ইতিহাসের নির্মম পরিণতি এটাই যে, ক্লাইভ ষড়যন্ত্রমূলক জীবন কাটিয়ে শেষ জীবনে ব্যর্থতা ও জনমানুষের ঘৃণার শিকার হলেন। কেনো এমন হলো তার সাথে? এর কারণ হলো তার সীমাহীন ঈর্ষা, লোভ ও পরশ্রীকাতরতা।
ভারতবর্ষ, বিশেষ করে বাংলা থেকে প্রচুর সম্পদের মালিক হয়েছিলেন ক্লাইভ। তিনি চেয়েছিলেন ইংল্যান্ডের শ্রেষ্ঠ অভিজাতরা যেখানে বসবাস করে, সেখানে দম্ভের সঙ্গে বাস করতে। তিনি সেন্ট্রাল লন্ডনের বার্কল স্কোয়ারে ১৭৬৪ সালে ওয়ালকোট হল কিনেছিলেন ৯০ হাজার পাউন্ড দিয়ে, এটা ছিলো সেই সময় এক বিরাট অঙ্কের সম্পদ, যার পুরোটাই তিনি বাংলা থেকে অবৈধভাবে লুট করেছিলেন। এখান থেকেই ‘লুট’ শব্দটি ইংরেজি ভাষায় চালু হয়। তিনি আরেকটি এস্টেট ক্রয় করেন ২৫ হাজার পাউন্ড দিয়ে এবং নতুন কয়েকটি প্রাসাদ ও বাগান তৈরির জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করেন। নর্থ ওয়েলসের ক্লাইভের পাইস ক্যাসেলটি বর্তমানে ক্লাইভ জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এটি ইংল্যান্ডের সর্ববৃহৎ প্রাইভেট কালেকশন, যেখানে বাংলা থেকে লুট করে নিয়ে যাওয়া দামী দামী হীরে-রত্ন-জুয়েলারীসহ বিভিন্ন মূর্তি ও তলোয়ার সামগ্রী রয়েছে। এমনকি আপনি অবাক হবেন ক্লাইভ জাদুঘরে সংরক্ষিত সিরাজউদ্দৌলার পালকি দেখে। তিনি কি পরিমাণ অর্থ-সম্পদ লুট করেছিলেন, তা তার কয়েকটি ছোট খরচের হিসাব দেখলে সহজেই অনুমান করা যায়।
অঢেল সম্পদের মালিক হয়েও ক্লাইভের ঐ সমাজে ঠাঁই মেলেনি। অর্থবিত্তের মালিক হয়ে উঠলেও সেখানকার অভিজাতশ্রেণি ক্লাইভকে মেনে নিতে পারে নি। তারা অনেক ধনী ক্লাইভকেও একজন অনাহুত ভেবে লুটেরা হিসেবে তুচ্ছজ্ঞান করে। ইংল্যান্ডের অভিজাতশ্রেণির নানা যন্ত্রণা এবং আদালতের মামলা-মোকদ্দমা ক্লাইভের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিলো তার স্বাভাবিক জীবন। তাই নানা অভিযোগ ও অপমানে ১৭৭৪ সালের ২২ নভেম্বর নিজ বাসাতেই আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছিলেন ক্লাইভ। জানা যায়, ক্লাইভের মৃত্যুর পর তার পরিবারের সদস্যদেরও নানামুখী যন্ত্রণা পোহাতে হয়েছে। তার অর্জিত ও জমা করা অঢেল সম্পদ তিনি যেমন ভোগ করতে পারেন নি, তেমনি তার পরিবারের সদস্যদেরও নানাভাবে ঐ সম্পদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিলো।
তবে আজও ইংরেজদের কাছে ক্লাইভ এক রোমাঞ্চকর চরিত্র। আর সে জন্য পলাশী যুদ্ধের ১৫০ বছর পরে যখন লর্ড কার্জন ভারতের ভাইসরয়, তখন তিনি লন্ডন ও কোলকাতায় রবার্ট ক্লাইভের ভাস্কর্য নির্মাণের জন্য প্রস্তাব করেন। পরে লন্ডনের কমনওয়েলথ অফিসের সামনে রবার্ট ক্লাইভের ভাস্কর্য তৈরি করা হয়, যা এখনো সেখানেই আছে। কমনওয়েলথ অফিসটি আগে ইন্ডিয়া অফিসের বিল্ডিং ছিলো।
ইংল্যান্ডকে আমরা কি বলতে পারি? ইংল্যান্ড আসলে এক চরম স্বার্থপর জাতি। এমনকি যারা তাদের জন্য সম্পদ এনে দিয়েছে, তাদের ক্ষেত্রেও তারা স্বার্থপর। আর এরই পরিণতি হিসেবে ক্লাইভকেও হতে হয়েছে সীমাহীন যাতনার শিকার। ইংল্যান্ড এমন এক জাতি, যে কাউকে ছাড় দেয় না। এই জাতি শুধু সময় ও সুযোগের সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে নিজেদের স্বার্থকে চরিতার্থ করেছে সবসময়। ক্লাইভের বিচারও ছিলো এরই একটি অংশ। ক্লাইভ, মীরজাফর প্রভৃতি সকল চরিত্রই ইংল্যান্ডের হাতের মহরামাত্র। সবাইকে সঠিকভাবে ব্যবহার করে প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়ার পর ছুঁড়ে ফেলে দেয়াই মূলত উপনিবেশবাদীদের চরিত্রের বাস্তবতা।