বাংলায় কড়ি শব্দটি এসেছে সংস্কৃত কপর্দক শব্দটি থেকে। আমাদের যখন পকেট খালি থাকে তখন আমরা ‘কপর্দকশুন্য’ এই কথাটা ব্যাবহার করে থাকি। এটি হিন্দি ‘কৌড়ির’ আরেক রূপ।

তখনকার সময় শহরে সোনা- রুপার টাকা থাকলেও গ্রামে কড়ি দিয়েই চলতো বেচাকেনা। এটি ছিল সে কালের লেনদেনের সবচেয়ে কম-মানের মুদ্রার প্রতীক। মুঘল ও সুলতানী আমলে শস্য বা কড়ি দিয়েও কর দেয়া যেত। মৌর্যযুগে সরকারি কর্মচারী ও কারিগরদের কড়ি দিয়ে বেতন দেওয়া হতো।

১৮৪৫ সালের আঁকা একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে, একজন আরব বণিক বিনিময়ের মাধ্যম হিসাবে কড়ি ব্যবহার করছে।

কড়ির অস্তিত্ব প্রমাণ করে যে, বাংলার সমাজে-অর্থনীতিতে বিনিময় মাধ্যম হিসেবে কড়ির ভূমিকা ছিল বিশাল। তখন গ্রাম বাংলার সব জায়গাতেই কড়ি দিয়ে কেনাবেচা হতো। অথচ এখন সেই কড়ির কোন অস্তিত্বই নাই। কড়ি আসলে কি এবং কোথা থেকে এগুলি সংগ্রহ করা হতো? কড়ি কিন্তু একটি শামুক জাতীয় জলজ প্রানী, সমুদ্রে জন্মায়।কড়ি মারা যাবার পর সেটা পরিস্কার করে নিয়ে মানুষের কেনা- বেচার জন্য হাত বদল হতো। সেই সময় এগুলি মালদ্বীপ থেকে জাহাজ বোঝাই করে তারা এদেশে নিয়ে আসতো বিনিময়ে তারা এদেশ থেকে চাল নিয়ে যেত।

কড়ি গণনা করা হচ্ছে, ১৮৯৫

ভারত মহাসাগর কড়ির জন্য বিখ্যাত। অনেকদিন থেকেই মালদ্বীপ- এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপ কড়ি রপ্তানি করতো। আরব বণিক সোলায়মান (৮৫১ খ্রি.) মালদ্বীপের কড়ি সংগ্রহের একটি সাশ্রয়ী এবং কম পরিশ্রমের পদ্ধতি আবিষ্কারের কাহিনি শুনিয়েছেন। মালদ্বীপের সমুদ্র উপকূলে যেখানে পানির গভীরতা কম থাকে, সেখানে নারকেলের পাতাসহ কিছু ডাল পানিতে চুবিয়ে রাখলে জীবন্ত সামুদ্রিক কড়ি ঝাঁকে ঝাঁকে সেই ডালে আশ্রয় নিতো। কিছুদিন পর কড়িসহ সেই ডাল ডাঙায় তুলে রোদে ফেলে রাখা হতো এরপর কড়িগুলি মরে গেলে ভিতরের সবকিছু পচেগলে শুধু এর শক্ত খোলস পড়ে থাকতো। এই চকচকে শক্ত খোলসটিই ধুয়ে পরিষ্কার করে কড়ি হিসেবে নানা দেশে রপ্তানি করা হতো।

সুমুদ্রর নিচে জীবন্ত কড়ি

আমাদের দেশে যখন কড়ির ব্যবহার ছিল তখন সেগুলি বিদেশ থেকে আমদানি করা হতো। কড়ি কখন যে বাংলার আর্থিক ও সামাজিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে মিশে গিয়েছিল সেটা সঠিকভাবে জানা যায়নি। কড়ি নিয়ে কত কাব্য, কত সাহিত্য রচনা করা হয়েছে, কড়ি নিয়ে বিমল মিত্র তো একটি উপন্যাসই লিখে ফেললেন, ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’, এটি নিয়ে আবার সিনেমাও তৈরি হয়ে গেল! নীহাররঞ্জন রায় তাঁর বাঙালির ইতিহাস, আদিপর্বে লিখেছেন, ‘’গুপ্তযুগ থেকে বাংলাদেশে মুদ্রার নিম্নতম মান ছিল কড়ি’’। অ্যাংলো-ভারতীয় শব্দ সংগ্রহের অভিধান হবসন জবসনের (১৮৮৬) মতে উনিশ শতকের প্রায় শেষ পর্যন্ত বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে সীমিত আকারে কড়ির প্রচলন টিকে ছিল।

বিভিন্ন জাতের কড়ি

গুপ্ত আমলে বাজারে সোনা-রুপা আর তামার পয়সা থাকা সত্ত্বেও কড়ির চল ছিল। ঐতিহাসিক মিনহাজউদ্দিন (১৩০০ শতক) বলেছেন, ‘’বিজয়ী তুর্কিরা বাংলাদেশে কোথাও রুপার মুদ্রার প্রচলন দেখতে পাননি, খুচরা কেনাবেচায় কড়িই ব্যবহার হত’’। ‘লক্ষণ সেনের নিম্নতম দান ছিল এক লক্ষ কড়ি’। ইবনে বতুতা লিখেছেন, চালের বিনিময়ে বাংলায় কড়ি রপ্তানি হতো। সতের শতকে পাইরান্ড ডি লাডেন্স জাহাজডুবির শিকার হয়ে মালদ্বীপে দুই বছর আটকা পড়েছিলেন। তিনি বছরে ৩০ থেকে ৪০টি জাহাজকে শুধু কড়ি বোঝাই হয়ে বাংলার দিকে রওনা হতে দেখেছিলেন।  আবার আবুল ফজল বলছেন, মুঘল আমলে কোন কোন অঞ্চলে কড়ির দিয়ে খাজনা নেওয়া হতো। কোম্পানি আমলের প্রথম দিক পর্যন্ত রংপুর ও সিলেটে জেলার জমিদাররা পুরো খাজনাই কড়িতে আদায় করতেন।

চীনা শেল মানি, খ্রিস্টপূর্ব ১৬-১৮ শতাব্দী

পনের শতকে সুলতান গিয়াসউদ্দীন আজম শাহের সময়ে গৌড় ভ্রমণকারী চীনা রাজদূত মা হুয়ান লিখেছেন, ‘’এখানে রুপার মুদ্রা চালু, তবে খুচরা কেনাকাটার জন্য কড়িই ব্যবহার হয়’’। ১৭৫০ খৃষ্টাব্দে ইংরেজ বণিকেরা দেখেছেন কলকাতা শহরে কর আদায় করা হয় কড়ি দিয়ে। সোনার টাকা, মোহর বা আশরফি নামে পরিচিত ছিল। সাধারণত বাজারে লেনদেনের কাজে মোহর ব্যাবহার হতো না। এগুলো রাজস্ব, উপঢৌকন, উপহার ও সঞ্চয়ের জন্য তৈরি করা হতো। ঐতিহাসিক খান মোহাম্মদ মহসীন মোহরকে যথার্থই আখ্যা দিয়েছেন ‘সখের মুদ্রা’ বা ‘ফ্যান্সি কয়েন’ হিসেবে। তার মতে রুপার সিক্কাই ছিল প্রকৃতপক্ষে বড় ধরনের লেনদেনের জন্য বৈধ মুদ্রা।

বাংলার রমরমা আন্তর্জাতিক ব্যাবসা এই সিক্কা টাকার ওপরই গড়ে উঠেছিল। প্রথমে বাজারে তামার পয়সা ( দাম) খুচরা কেনাবেচার জন্য চালু হয়েছিল। একটি সিক্কা টাকার বিনিময়ে ৪০টি তামার পয়সা (দাম) পাওয়া যেত। আঠারো শতকের শুরু থেকে বাংলার অভ্যন্তরীণ বাজারে দাম বা তামার পয়সা দুষ্প্রাপ্য হয়ে ওঠে। এ সময়ে অস্ত্র তৈরির জন্য তামার ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় ‘দাম’ তৈরির জন্য তামায় টান পড়ে। আস্তে আস্তে তামার পয়সা বাজার থেকে হারিয়ে যায়, সেই শূন্যস্থান দখল করে কড়ি। আঠার শতকে কড়ি পুরোপুরি তামার পয়সাকে বাজার থেকে উঠিয়ে দেয়। (কে এম মহসীন—এ বেঙ্গল ডিস্ট্রিক ইন ট্রানজিশন: মুর্শিদাবাদ ১৭৬৫-১৭৯৩, এশিয়াটি সোসাইটি অব বেঙ্গল)

সোনা-রুপা তামার নানা ধরনের বিকল্প এবং জনপ্রিয় ব্যবহার ছিল—যেমন গয়নাগাটি, বাসনকোসন, যুদ্ধাস্ত্র—এসব তৈরিতে কড়ির কোনো বিশেষ ব্যবহার ছিল না। সব ধাতব মুদ্রাকেই জাল বা নকল করা সম্ভব, কড়ির বেলায় সে সুযোগ নেই। ১৭৭২ খ্রিষ্টাব্দে সিলেট জেলার প্রথম কালেক্টর হিসেবে উইলিয়াম ম্যাকপিস থ্যাকরে যোগদান করেন। সে সময় সিলেটের রাজস্ব ছিল এক লাখ ৭০ হাজার টাকা। জমিদারেরা কড়ি দিয়ে এই রাজস্ব আদায় করতেন।

জেসি হ্যারিসন হোয়াইটহার্স্টের আঁকা ম্যাকপিস থ্যাকারির চিত্র, ১৮৫৫

লিন্ডসেও লিখেছেন তাঁর সময়ে সিলেটের পুরো রাজস্বই কড়ি দিয়ে আদায় করা হতো। তত দিনে সিলেটের খাজনা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল আড়াই লাখ টাকায়। সে সময় পাঁচ হাজার ১২০টি কড়িতে এক টাকা পাওয়া যেত। চিন্তা করা যায়, এক লাখ সত্তুর হাজার টাকা করের জন্য কি পরিমান কড়ি জমা করতে হতো! লিন্ডসে আরও লিখেছেন এই বিপুলসংখ্যক কড়ি রাখার জন্য শহরে অনেক গুদাম ছিল। এক বিরাট নৌবহরের সাহায্যে এই কড়ি প্রতি বছর ঢাকায় পাঠানো হতো। ঢাকায় পাঠানো কড়ি নিলামে বিক্রি করে রুপার মুদ্রায় বদলে নেওয়া হতো। লিন্ডসে সাহেব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে অবশেষে লিখছেন, ‘সুখের বিষয় এই যে, এই প্রথা দীর্ঘকাল স্থায়ী হয় নাই, সত্বরই তাহা উঠাইয়া দেওয়া হয়’।

অবশ্য ইংরেজের কাছে খাজনা নির্ধারণের ভিত্তি ছিল অবশ্যই রুপার টাকা, কড়ি নয়। যেখানে কড়ি দিয়ে খাজনা আদায় করা হয়েছে, সেখানে খাজনা হিসেবে নির্ধারিত কড়ির হিসাব করা হতো রুপার টাকার সঙ্গে কড়ির সে সময়ের বিনিময় হারের ভিত্তিতে। ১৮০৪ সালে ফোর্ট উইলিয়াম জেলার কালেক্টরদের ৫২৮০টি কড়ির সমান এক টাকা ধরে খাজনা আদায়ের নির্দেশ দিয়েছিলেন। এখানে দেখা যাচ্ছে সময়ের সাথে সাথে কড়ির দামও পড়ে যাচ্ছিল।

অর্থনীতিবিদ আকবর আলি খান লিখেছেন, যারা কড়িতে কেনাবেচা করত তারা আয়ও করতো ঐ কড়িতে, সোনা বা রুপার মুদ্রায় নয়। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন প্রাক-মুসলিম বাংলায় কড়ির ব্যাপক ব্যবহারের কারণ সোনা ও রুপার মুদ্রা দুর্লভ হওয়ার কারনে। তাদের চোখে এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী ভারত মহাসাগরের বাণিজ্যে, আরবদের অধিকার প্রতিষ্ঠা হওয়ার জন্য উপমহাদেশে সোনা ও রুপার আমদানিতে ঘাটতি পড়ে।

কিন্তু মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার পরও কেন কড়ির ব্যবহার ছিল? কেউ কেউ মনে করেন মধ্যযুগের বাংলায় সোনা ও রুপার পর্যাপ্ত সরবরাহ আবার শুরু হলেও বাঙালিরা চিরাচরিত অভ্যাসের বশে কড়ির ব্যবহার থেকে সরে আসেনি।

বাংলা থেকে কড়ি উঠে যাওয়ার মূলত দুটি কারণ গবেষকেরা খুঁজে পেয়েছেন (বাংলা ও ভারতে কড়ি, অর্নিবান বিশ্বাস, সুবর্ণরেখা)। ১৭৬৫ সালে ইংরেজের দেওয়ানি লাভের পর রুপার টাকার তুলনায় কড়ির দাম কমে যায়, ফলে বিনিময় মাধ্যম হিসাবে কড়ির আর কানাকড়িও মূল্য থাকেনা, তখন বিকল্প বিনিময় মাধ্যম হিসেবে ইংরেজ কোম্পানি তামার পয়সা চালু করে।

বাংলায় সোনা ও রুপা খুব সামান্য পাওয়া যেত। সোনা ও রুপার প্রায় সবটাই আসত রপ্তানি বাণিজ্যের বিনিময়ে। এর ফলে সোনা ও রুপার সরবরাহে কখনো বিরূপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, রফতানী বানিজ্য থেকে আসা সোনা ও রুপার ওপরই মুদ্রার উৎপাদন নির্ভর করত। ইংরেজ এবং সব বিদেশি কোম্পানিগুলোকে এ দেশের পণ্য কিনে বিলেতে রপ্তানির খরচ মেটাতে বাংলায় প্রচুর রুপা আনতে হতো, কিন্তু ১৭৬৫ সালে বাংলার রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব পাওয়ার পর কোম্পানির হাতে প্রতিবছর এত টাকা উদ্বৃত্ত থাকত যে মূলধনের জন্য আর বিলেত থেকে রুপা বা রুপার মুদ্রা আমদানি করতে হতো না।

এক পাই সিককা

এভাবে ধীরে ধীরে বাংলায় রুপার মুদ্রা ও রুপার আমদানি কমতে শুরু করে এবং বাংলায় রুপার মুদ্রার বিশাল ঘাটতি দেখা দেয়। নবাবি আমলেই রুপার মুদ্রা আনার অনুপাতে কড়ির বিনিময়মূল্য কম ছিল, পরে কড়ির বিনিময়মূল্য আরও কমে যাওয়ায় কড়ি অকার্যকর হয়ে পড়ে। ১৭৯০ সালে-কড়ির বিকল্প হিসেবে তামার পয়সা ও ‘আধলা’ (এক পয়সার অর্ধেক) চালু হলে কড়ির দিন ফুরানোর পালা দ্রুত এগিয়ে আসে। আরও একটু পরে ‘পাই’ (এক পয়সার এক- তৃতীয়াংশ) ও ‘ছিদাম’ (এক পয়সার এক-চতুথাংশ) ইত্যাদি পয়সা এসে কড়িকে বাজার থেকে উৎখাত করে। ১৮০৭ সালে ইংরেজ কোম্পানি আইন করে কড়িতে খাজনা নেওয়া বন্ধ করে দেয়। এর পরই কড়ির চাহিদা কমে গিয়ে দ্রুত তার দাম পড়তে শুরু করে।

বিশাল ইংরেজ রাজত্বে একই সময় সব জায়গা থেকে যে একসঙ্গে কড়ির ব্যাবহার উঠে যায়নি তার প্রমান মিলে ১৮৭০ সালে বন্তার এলাকায় কড়ির ব্যবহার দেখে। তখন যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে দেশের সব প্রান্তে ইংরেজ সরকারের কড়ি বাতিলের হুকুম একসাথে পৌঁছায়নি, কাজেই একেক জায়গায় একেক সময় কড়ির ব্যাবহার বন্ধ হয়।

হান্টার তাঁর থেকারেজ ইন ইন্ডিয়া গ্রন্থে লিখেছেন, ১৮২০ সালের পরও গ্রামীণ বাংলার কোনো কোনো জায়গায় কড়ি সীমিতভাবে শুধু দৈনন্দিন প্রয়োজনের জন্য ব্যবহার করা হত। কড়ি উঠে যাওয়ার জন্য দেশের মানুষ ক্ষুব্ধ হয়েছিল নাকি সে ব্যাপারেও কিছুই জানা যায়নি।বাতিল হয়ে যাওয়া লাখ লাখ কড়ি যা ইংরেজ সরকার ও দেশের অগণিত মানুষের হাতে রয়ে গেল, তার কি ব্যাবস্থা হয়েছিল কে জানে!

তথ্য

উইকিপিডিয়া

প্রথম আলো