২০০১ সালে আমেরিকার প্রাক্তম রাষ্ট্রপতি জর্জ ডব্লিউ বুশ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তার যুদ্ধের তুলনা করেছিলেন মধ্যযুগের ক্রুসেডের সাথে। ঐ বক্তব্যের জন্য তাকে হতে হয়েছিল অনেক সমালোচিত। পাশ্চাত্যের অনেক অঞ্চলেই  ক্রুসেডকে এখনো মোটামুটি ইতিবাচকভাবেই দেখা হয়, যদিও প্রাচ্যে এটি একটি অত্যন্ত নেতিবাচক ঘটনা হিসেবেই বিবেচিত। একাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে শুরু হওয়া ক্রুসেডের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম শাসন থেকে জেরুসালেম উদ্ধার করা। এটি ছিল খ্রীষ্টান সম্প্রদায়ের দীর্ঘ এক ধর্মীয় যুদ্ধ। ক্রুসেডের নামে দীর্ঘ বিরোধের সূত্রপাতের অন্যতম উদ্দেশ্য ধর্ম হলেও, ক্রুসেডের মূল অন্তর্নিহিত চালিকা শক্তিটি ছিল ইউরোপের তখনকার অর্থ-সামাজিক করুন দুর্দশা। ক্রুসেডকে বুঝতে হলে ক্রুসেডের ঠিক পূর্বে ইউরোপের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট প্রথমে জানা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। সাথে সাথে আরো জানা দরকার, ঐ একই সময়ে প্রাচ্যের সামগ্রিক অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অবস্থা কেম্নন ছিল।

একাদশ শতাব্দী ছিল মধ্যযুগের একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ। এই সন্ধিক্ষণে প্রথম সংগঠিত ক্রুসেড (খ্রীষ্ট-ধর্মীয় যুদ্ধ) ছিল বিশ্ব-ইতিহাসের একটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। প্রথম পর্বের ক্রুসেডের স্থায়িত্ব ছিল আনুমানিক দু’শো বছর (১০৯৬ – ১২৯১)। ঐ সময়টিতে মোট আটটি বড় রকমের এবং কয়েক ডজন ছোট আকারের  ক্রুসেড সংগঠিত হয়। ক্রুসেডের পরিসমাপ্তি ঘটে আরো দু’শো বছর পর, অর্থাৎ ১৪৯২ সালে স্পেনে গ্রানাডার মুসলমান সাম্রাজ্যের পতনের মধ্য দিয়ে। । একাদশ শতাব্দী থেকেই সাম্রাজ্যবাদী রোমান সামরিক শক্তির উপর ভিত্তি করে শত শত বছরের ইউরোপীয় আধিপত্য স্থিমিত হতে থাকে ধীরে ধীরে। মূলতঃ রোমান সাম্রাজ্যের এশিয়া মাইনরের অঞ্চলগুলো চলে যেতে থাকলো মুসলিম নিয়ন্ত্রণে। মুসলমান সাম্রাজ্যগুলো, যেমন তুর্কীর সুন্নী সেলজুক (Seljuk), বাগদাদের সুন্নী আব্বাসীয়, এবং মিশরের শিয়া ফাতেমীয়রা, পশ্চিমে স্পেন থেকে পূর্বে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত তাদের শাসিত এলাকা দিয়ে পশ্চিম ইউরোপকে প্রায় ঘিরে ফেলে। ১০৭১ সালে মানজিকর্টের যুদ্ধের  (Battle of Manzikert) পরিণতিতে জেরুসালেম চলে যায় তুর্কী সেলজুকদের অধীনে। এর তিন বছর পর,  ইউরোপে পোপ সপ্তম গ্রেগরী (Gregory VII) মুসলমানদের হাত থেকে জেরুসালেম উদ্ধারের পরিকল্পনা করতে থাকে।

জেরুসালেমে তীর্থযাত্রাসহ বিভিন্ন কারণে ইউরোপীয়নরা প্রায়ই প্রাচ্যের মুসলিম জনপদগুলোর মধ্য দিয়ে ভ্রমণ করতো। এই ভ্রমণগুলো ইউরোপিয়ান খ্রীষ্টানদের অন্য সমাজ ব্যবস্থার সাথে পরিচিত হবার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছিলো, বিশেষ করে প্রাচ্যের মুসলমান এবং গোঁড়া খ্রীষ্টান বাইজেন্টাইনদের সাথে। পশ্চিমের ইউরোপীয়নদের জন্য তখন প্রাচ্যের  বাইজেন্টাইন এবং মুসলমান সাম্রাজ্যগুলোর সমৃদ্ধি এবং প্রাচুর্য  ছিল “এক হাজার এক রজনীর” কল্পনার রাজ্য। আধুনিক জনজীবন, নগর-কাঠামো, মসৃণ কাপড়ের পোশাক, মন-ভোলানো সংগীত, বিভিন্ন বিনোদন এবং সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করতো তখন প্রাচ্যের ঐ সাম্রাজ্যগুলো। পশ্চিমের  ইউরোপিয়ান খ্রীষ্টানদের কাছে তখন প্রাচ্যের, বিশেষ করে  মুসলমান-অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোর চোখ-ধাঁধানো উন্নয়ন এবং প্রাচুর্য আকর্ষণ করতো সাংঘাতিকভাবে। প্রাচ্যের মুসলমানরা যখন আধুনিক জীবনযাত্রা আর সমৃদ্ধিতে বাস করতো, পশ্চিমে ইউরোপীয়নরা তখন কঠিন দারিদ্র্য এবং সংঘাতের মধ্যে গভীরভাবে নিমজ্জিত।

ক্রুসেড সময়ের রাজা

ক্রুসেডের আগে, পশ্চিমের ইউরোপ ছিল একটি একক জাতিসত্তা; আজকের মতো অনেক দেশ নিয়ে গঠিত কোন ফেডারেশন নয়। ইউরোপে সাধারণ জনগনের সার্বিক দায়িত্বে ছিল অভিজাততন্ত্র এবং গীর্জাগুলো । ইউরোপের পশ্চিমা সমাজ ছিল সামন্ততান্ত্রিক, কৃষি-ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা। তখন ৯৯% মানুষের ছিল না আবাদের কোন ভূমি। অন্যদিকে, অভিজাত শ্রেণীরা, যেমন কাউন্ট, ডিউক বা ব্যারন উপাধিপ্রাপ্তরা মোট জনসংখ্যার মাত্র এক শতাংশ হয়েও তাদেরই হাতে ছিল ইউরোপের সমস্ত কৃষি জমির মালিকানা। সাধারন জনগণের জীবন ছিল অত্যন্ত কঠিন এবং তাদের গড় আয়ু ছিল অনেক কম। রোগ-শোকে তারা হয়ে পড়েছিল অনেক দুর্বল।  ইউরোপিয়ানরা তখন ছিল লিখতে-পড়তে অপারগ। নিরক্ষর। গীর্জার পাদ্রীরাও না পারতো লিখতে, না পড়তে; কিন্তু তারাই নিয়ন্ত্রণ করতো সমাজকে। মুষ্টিময় কিছু ধর্মগুরু অজ্ঞরা নিয়ন্ত্রণ করতো বিশাল এক অজ্ঞ জনসমষ্টিকে। সমাজে ছিল চরম নৈরাজ্য। এমন একটি সমাজ চালিত হতো ধর্মান্ধতা এবং স্বেচ্ছাচারিতা দিয়ে। সাধারণ জনগণের অধিকার গীর্জার অশিক্ষিত পাদ্রী দ্বারা ছিল সম্পূৰ্ণভাবে নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু এই মানুষগুলোর নিত্যপ্রয়োজনীয় চাহিদা ছিল গীর্জার কাছে সামগ্রীকভাবে উপেক্ষিত। তখন ঐ দূর্দশা থেকে মুক্তির জন্য বেশীরভাগ মানুষের একমাত্র কামনা ছিল দ্রুত মৃত্যু।

ইউরোপের বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত ধনী অভিজাত সম্প্রদায়ের মধ্যে ছিল পারস্পরিক বিরোধ। তারা সবসময় লিপ্ত থাকতো একে অপরের সম্পদ লুটপাটে। তাদের মধ্যে অন্তর্কলহ এবং যুদ্ধ ছিল প্রাত্যহিক একটি বিষয়। পোপ সপ্তম গ্রেগরী এই যুদ্ধগুলো বন্ধ করতে চেয়েছিল “Peace of God” নামের একটি চুক্তির মাধ্যমে, কিন্তু তা’ সফল হয় নি। পোপ তখন পরিকল্পনা করলো, গীর্জার নেতৃত্বে অভিজাতদের অন্তর্কলহ-যুদ্ধকে নিয়ে যেতে হবে ইউরোপের বাহিরে। পোপ আরো চেয়েছিল, ইউরোপের ৯৯% নিঃস্ব মানুষগুলোর মনোযোগ অন্যদিকে ফেরাতে হলে যুদ্ধকে নিয়ে যেতে হবে প্রাচ্যে। সংঘর্ষ ছড়িয়ে দিতে হবে মুসলিম-অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে। তাই তাদেরকে বোঝাতে চেয়েছিল যে, তাদের দূরবস্থার জন্য দায়ী প্রাচ্যের ইসলাম, মুসলিম সাম্রাজ্যগুলো। আরো প্রচার করতে থাকে যে, খ্রীষ্ট ধর্মের প্রধান শত্রু ইসলাম। পশ্চিমের ইউরোপীয়ানরা তখন ইসলামকে আলাদা কোন ধর্ম হিসেবে দেখতো না। তাদের ধারণা, ইসলাম ছিল খ্রীষ্টান ধর্ম থেকে বিচ্যূত একটি ভ্রান্ত ধারা মাত্র।  অতএব তাদেরকে শক্তি প্রয়োগে খ্রীষ্টান ধর্মে ফিরিয়ে আনা গীর্জার দায়িত্ব। পরিকল্পনা অনুযায়ী গীর্জাগুলোকে দেয়া হলো অসীম ক্ষমতা। ফলশ্রুতিতে গীর্জার অধীনে অর্থ এবং সম্পদের পরিমান হয়ে পড়ে ইউরোপের সব রাজাদের সম্মিলিত সম্পদের থেকেও অনেক বেশী।

অন্যদিকে, ভূমধ্যসাগরের ওপারে, মুসলিম বিশ্বের ঐশ্বর্য, সমৃদ্ধি ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন অন্যদের কাছে ঈর্ষণীয় হলেও, নিজেদের মধ্যে অন্তর্দন্দ্বে ইসলামিক বিশ্ব তখন হয়ে যায় রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে কয়েকভাগে বিভক্ত। ইসলামের মূল আদর্শ থেকে তারা হয়ে পড়ে বিচ্যুত। বাগদাদের সুন্নী আব্বাসীয়রা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে  মিশরের শিয়া ফাতেমীয় সাম্রাজ্যের সাথে। নবম দশক থেকেই আব্বাসীয় খলিফার নিয়ন্ত্রণ ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছিলো বিভিন্ন ছোট-ছোট রাজবংশের অধীনে। খলিফা মানে, ইসলামী বিশ্বের সার্বজনীন নেতা। কিন্তু ঐ অস্থির সময়ে মুসলিম-বিশ্বে আব্বাসীয় খলিফা হয়ে পড়লো তার মন্ত্রী, সেনা কমান্ডার, এমন কি রাজপ্রাসাদের ভৃত্যদের নিয়ন্ত্রিত এক পাপেট বা পুতুল। এদিকে, তুর্কীর সেলজুকরা  (Seljuk) তাদের অধিকৃত অঞ্চলের  চারদিকে সাম্রাজ্য বিস্তার করতে লাগলো অপ্রতিরোধ্যভাবে। তাদের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সামরিক অভিযান ছিল এশিয়া মাইনর, তথা বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে। ১০৭১ সালে মানজিকর্ডের যুদ্ধে জেরুসালেম বিজয়ের পরে, সালজুকরা বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টান্টিনোপলের কাছাকাছি চলে আসে।

ইউরোপের দুঃস্থ মানুষগুলোকে পুরোপুরি প্রাচ্যে ইসলামের বিরুদ্ধে প্ররোচিত করে সংগঠিত করার আগেই পোপ সপ্তম গ্রেগরীর মৃত্যু হয় ১০৮৫ সালে। তার মৃত্যুর তিন বছর পর দ্বিতীয় আরবান (Urban II) পোপের দায়িত্ত্বভার নেয়। সে ছিল আগের পোপের চেয়েও অনেক উগ্র এবং কট্রর রক্ষণশীল। দ্বিতীয় আরবান ছিল মধ্যযুগের সবচেয়ে ভয়ানক পোপ। সে চেয়েছিল খ্রীষ্টান ধর্মকে উগ্র-সামরিকীকরণ করা এবং শক্তি প্রয়োগ করে ক্যাথলিক ধর্মকে অন্য দেশে ছড়িয়ে দেয়া। আরবান  নিজেকে মনে করতো খ্রীষ্টানদের প্রভু।  ১০৯৫ সালের ২৭শে  নভেম্বরে আরবান ফ্রান্সের ক্লেরমন্টে (Clermont) ডাকে ক্যাথোলিক গীর্জাগুলোর এক কাউন্সিল (Council of Clermont)। কাউন্সিলটির উদ্দেশ্য ছিল ধর্মীয় বাণীর সম্মেলন। কিন্তু দশম দিনে পোপের বক্তৃতা সূত্রপাত করে আগামী দু’শো বছরের রক্তপাতের পরিকল্পনা। পোপ তার বক্তৃতায় বলে, প্রাচ্যে খ্রীষ্টানদের পবিত্র স্থান জেরুসালেম আজ অবিশ্বাসীদের হাতে। সে সবাইকে পবিত্র স্থান পুনরুদ্ধারের জন্য ১০৯৬ সালের গ্রীস্মকালে গীর্জার নেতৃত্বে অভিযানা অংশগ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত হতে বলে। পোপ তার ভাষণে “ইসলাম” বা “মুসলিম” শব্দগুলো ব্যবহার করে নি একবারের জন্যও। তার পরিকল্পিত অভিযানকে “Holy war” নামে আখ্যায়িত করে সে। পোপ জানায়, যারা এই অভিযানে অংশগ্রহণ করবে, তাদের সব পাপ বিলীন হয়ে যাবে। আর যারা অভিযানে যাবে না, তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি। পোপ আরো বলে যে, যারা এই অভিযানে অংশগ্রহণ করবে তারা পাবে বাইবেলে বর্ণিত প্যালেস্টাইনের অফুরন্ত মধু, দুধ এবং প্রাচুর্য। তার এই বাণী নিঃস্ব জনগোষ্ঠীর উপর যাদুর মতো কাজ করেছিল। তারা হয়েছিল অন্ধভাবে প্ররোচিত। যদিও সমাজের ধনীরা, যেমন ব্যারন, কাউন্ট, লর্ডরা পোপের ঐ  ধর্মীয় বাণীতে  প্ররোচিত না হলেও, সংখ্যাগরিষ্ট ভূমিহীন জনগণ হয়েছিল উদ্বুদ্ধ। আর এখানেই সূচিত হয় ক্রুসেডের প্রাথমিক প্রস্তুতি।

ক্রুসেড - পিটার দ্য হারমিটের একটি মূর্তি

ফ্রান্সের অ্যামিয়েন্সে পিটার দ্য হারমিটের একটি মূর্তি

এমন সময় আবির্ভাব হলো ফরাসী এক বৃদ্ধ সন্ন্যাসীর, নাম পিটার দ্য হেরমিট (Peter the Hermit)। তার সাথে সার্বক্ষণিক থাকতো একটি গাধা। ঐ সময়ের ল্যাটিন ইতিহাসবিদরা পিটারকে বর্ণনা করে একজন কৃশকায় অতিশয় বৃদ্ধ ব্যক্তি, যিনি ছিলেন একজন খুবই ভালো বক্তা। পিটারের গায়ে থাকতো একটি উলের চাদর, তার পা থাকতো উম্মুক্ত, কোন জুতো-সেন্ডেল পড়তো না সে। পিটারের চুল থাকতো উস্ক-শুষ্ক। তার হাতে থাকতো একটি লাঠি, যা’র উপর ভর করে কিছুটা গুজো হয়ে হাঁটতো। বক্তৃতা দিয়ে মানুষকে প্ররোচিত করার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল তার। ১০৯৫ সালের নভেম্বরের ক্যাথলিক কাউন্সিলে পোপ আরবানের বক্তৃতার পরপরই ১০৯৬ সালের প্রথম থেকেই পিটার সংগঠিত করতে লাগলো নিঃস্ব মানুষগুলোকে, যারা দূর প্রাচ্যের নগর জেরুসালেম উদ্ধারের অভিযানে যেতে আগ্রহী। ক্রুসেড সংগঠিত করতে পিটার কোন গীর্জার প্রতিনিধিত্ব করতো না। এটি ছিল তার ব্যক্তিগত উদ্যোগ। প্রথম দিকের এই ক্রুসেড সংগঠিত করতে গীর্জাগুলো সরাসরি জড়িত ছিল না। পিটার ইউরোপ ঘুরে ঘুরে ক্রুসেডের পক্ষে বক্তৃতা দিয়ে ভূমিহীন নিঃস্ব জনগণকে জেরুসালেম উদ্ধারের জন্য প্ররোচিত করতে লাগলো। সংগ্রহ করতে লাগলো ক্রুসেডার।

পিটারের ক্রুসেডারের দলটি ছিল অত্যন্ত বিশৃঙ্খলাপূর্ণ। দলের অধিকাংশ সদস্যরা ছিল অত্যন্ত গরীব, ভূমিহীন, তাদের কাঁধে ছিল একটি কুড়াল এবং কাপড়-চোপড়ের একটি ছোট বস্তা। তাদের কোন ধারণাই ছিল না কতদূর তারা ভ্রমণ করবে, কিভাবে যুদ্ধ করবে, কে তাদের শত্রু। তাদের ছিল না যুদ্ধ করার কোন প্রশিক্ষণ।   যুদ্ধের অভিজ্ঞতা তো ছিলই না। যাত্রাপথে তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল যেভাবেই হোক অর্থ সংগ্রহ করা এবং নিরাপরাধ মানুষ হত্যা করা। বেঁচে থাকার জন্য যা’ যা’ দরকার, যেমন, শস্য, সম্পদ, অর্থ, সব তারা জোর করে ছিনিয়ে নিতো তাদের যাত্রা পথে। ক্রুসেডাররা ছিল অর্থের জন্য মরিয়া। অর্থের জন্য তারা স্বগোত্রের, তথা খ্রীষ্টানদেরও আক্রমণ করে কেড়ে নিতো সব। জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ধ্বংস করতো বাড়ী-ঘর। পিটারের ক্রুসেডাররা ছিল মরিয়া হয়ে উঠা এক নিরক্ষর গোষ্ঠী। তাদেরকে বলা হতো “People’s Crusade”  অথবা “Paupers’ Crusade.”

১৯৬৯ সালের ১২ই এপ্রিল পিটারের নেতৃত্বে  ক্রুসেডাররা যখন আজকের জার্মানীর ক্লন (Cologne) পোঁছালো, তখন ক্রুসেডারের সংখ্যা ছিল প্রায় চল্লিশ হাজার। এদের না ছিল কোন সামরিক প্রশিক্ষণ, না ছিল কোন শিক্ষা। দলটিতে বৃদ্ধ, নারী এবং শিশুও ছিল অনেক। তাদের যাত্রা চললো রাইন (Rhine) নদীর তীর ধরে। ঐ এলাকায় তখন বাস করতো প্রচুর ইহুদী। সেখানে তারা ছিনিয়ে নেয় তাদের সম্পদ, হত্যা করে অসংখ্য ইহুদী। ব্রিটেনের  Sussex University’র প্রফেসর এবং ইতিহাসবিদ নরমান কহনের  (Norman Cohn)  মতে, ক্রুসেডাররা তখন সেখানে নির্বিচারে চার হাজার থেকে আট হাজার ইহুদী নারী-পুরুষ-শিশু হত্যা করে। ইতিহাসে এই হত্যাকান্ড “Rhineland massacres” নামে পরিচিত।  অনেককে করা হয় বন্দী। তাদের অত্যাচারে অনেক ইহুদী আত্মহননের পথ বেছে নেয়। অনেক ইহুদীকে আবার জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করা হয়। জ্বালিয়ে দেয়া হয় তাদের বসতি। ক্রুসেডাররা যে নগরীতে পৌঁছায়, সেটাকেই মনে করে তাদের পবিত্র নগরী জেরুজালেম। ভেবে নেয়, ঐ নগরীর উপর আছে তাদের পূর্ণ অধিকার, যেমনটি পোপ বলেছিল তার প্ররোচিত বক্তৃতায়। তাই নগরের সবকিছু ছিনিয়ে নেয় ক্রুসেডাররা জোর করে। জার্মানীর মেইঞ্জে (Mainz) পিটার এবং তার অনুগামীরা ইহুদিদের একটি বড় দলকে হত্যা করেছিল যারা স্থানীয় খ্রীষ্টান বিশপের আশ্রয়ে ছিল। এই ধ্বংসযজ্ঞের পর ক্রুসেডাররা হাঙ্গেরির মধ্য দিয়ে বলকান পার হয়ে চার মাসের ক্লান্তিকর পথ চলার পর ১০৯৬ সালের ১ম আগস্ট ত্রিশ হাজার ক্রুসেডার বাইজেন্টাইনের রাজধানী কনস্টান্টিনপোলে পৌঁছাতে সক্ষম হয়। প্রাচ্যের দ্বারপ্রান্তে ইউরোপের ক্রুসেড!

বাইজেন্টাইন সম্রাট আলেক্সিয়াস কোমনেনোস (Alexios Komnenos) বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যে হঠাৎ ত্রিশ হাজার ক্রুসেডারের সমাগম দেখে ইউরোপের কাছে সাহায্য চেয়ে বার্তা পাঠালো। কারণ, এতো লোকের সমাগম তার শহরে সৃষ্টি করবে এক সমস্যা। পিটারের ক্রুসেডাররা দেখলো চোখ ধাঁধানো বাইজেন্টাইন রাজধানীর সৌন্দর্য, চকচকে রুপোর মোড়ানো গীর্জার ডোম, চারিদিকে প্রাচুর্যের ঝলকানি। তারা আরো দেখলো বাইজেন্টাইন সৈন্যদের তাক লাগানো পোশাক, অস্ত্র। এগুলো তাদের জন্য ছিল এক ধরণের সাংস্কৃতিক ধাক্কা (cultural shock), কারণ এসব ছিল তাদের কল্পনাতীত। নগরের জৌলুশ দেখে তারা চমকিত। তারা গীর্জা এবং অন্যান্য জনস্থাপনার উপর চালালো আক্রমণ। বাইজেন্টাইন সম্রাট আলেক্সিয়াস এতে হলেন ভীষণ বিরক্ত। তার সৈন্যকে হুকুম দিলেন অতি দ্রুত সব ক্রুসেডারকে কনস্টান্টিনপোলের সীমানা থেকে বের করে এশিয়া মাইনরে রেখে আসতে। অতি দ্রুতই বসবরাস (Bosboras) নদীর অপর পারে তুর্কী সেলজুক নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে রেখে আসা হলো ক্রুসেডারকে।

ক্রুসেড এর সময়ের ছবি

কিছুদিনের মধ্যেই ক্রুসেডাররা পরিণত হলো সেলজুক সেনাবাহিনীর আক্রমণের সহজ লক্ষ্যবস্তুতে। ২১শে  অক্টোবর, ১০৯৬ সালে বর্তমান তুর্কীর আনাতোলিয়া অঞ্চলের নাইসি (Nicaea) শহরের কাছে ড্রাকোন (Dracon) গ্রামে পিটারের হাজার হাজার পিপলস ক্রুসেডারের প্রায় সবাই সিভেটটের (Battle of  Civetot) এক সংক্ষিপ্ত যুদ্ধে সেলজুক সুলতান খিলিজ আর্সলানের সৈন্যের কাছে প্রাণ হারায়। কোন কোন ইতিহাসবিদের ধারণা, মোট নিহতদের সংখ্যা হবে ত্রিশ হাজারের কাছাকাছি। বেঁচেছিল মাত্র কিছু সংখ্যক ক্রুসেডার। তাদেরকে বন্দি করে ফিরিয়ে দেয়া হয় কনস্টান্টিনোপলে। পিটার দ্য হেরমিট এর আগেই কনস্টান্টিনপোলে বাইজেন্টাইনদের সাহায্যের জন্য সেখানে অবস্থান করছিল। তাই সে রক্ষা পেলো এবার।

যখন অসংগঠিত পিপলস ক্রুসেডাররা এশিয়া মাইনরে তুর্কী সেলজুকদের কাছে করুণ পরিণতির শিকার, ঠিক তখনই ইউরোপে ধর্মীয় যুদ্ধের আরেকটি ক্রুসেডের প্রস্তুতি চলছিল, যাকে  বলা হয় “প্রথম ক্রুসেড”। এবার ইউরোপের গীর্জা এবং অভিজাত শ্রেণী  প্রত্যক্ষভাবে “প্রথম ক্রুসেডে” নেতৃত্ব  দিয়ে আরও বৃহত্তর এবং সংগঠিত ক্রুসেডার গঠন করছিল ধাপে ধাপে।

 

তথ্যসূত্র:

১) Al Jazeera documentary, “Shock: The First Crusade and the Conquest of Jerusalem” Episode 1.

২) Wikipedia, Crusade