খড়ম একধরনের পায়ে দেয়ার কাঠের স্যান্ডেল। হিন্দি “খড়ৌঙ” শব্দটি থেকে বাংলায় “খড়ম” শব্দটির উৎপত্তি। সংস্কৃতে খড়ম “পাদুকা” নামে পরিচিত। খড়মের আবিষ্কার হয় প্রাচীন কালে। পায়ের স্যান্ডেলের মাপ মতো কাঠ কেটে, পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলির কাছে একটি কাঠের গোল গুটি বসিয়ে দেয়া হয় যা পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি ও পাশের আঙ্গুলটি দিয়ে আঁকড়ে ধরে রেখে হাঁটাচলা করা হয়। ভারত উপমহাদেশের বিশিষ্ট আউলিয়া হযরত শাহজালাল ১৪শ শতকে বাংলাদেশের সিলেটে বসতি স্থাপন করেছিলেন, তিনি ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে সঙ্গীসাথীসহ সিলেটে আসেন। তার ব্যবহৃত খড়ম এখনো তার সমাধিস্থল সংলগ্ন স্থাপনায় রক্ষিত আছে।
সিলেটের দরগা মহল্লায় মুফতি নাজমুদ্দিন আহমদের পারিবারিক তত্ত্বাবধানে তাঁর খড়ম ও তলোয়ার আছে বলে লোক মুখে প্রচলিত আছে। অনুমান করা যায় ওই সময় বাংলার বাইরেও খড়ম ছিল। পৃথিবীর প্রাচীনতম খড়ম পাওয়া গিয়েছিল ভারতের বাইরে। যুক্তরাষ্ট্রের ওরেগনে প্রাচীনতম এই খড়ম পাওয়া গিয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব ৭০০০ থেকে ৮০০০ বছর আগে। স্বাভাবিকভাবেই কাঠকেই বেছে নেওয়া হয়েছিলো জুতো তৈরির প্রধানতম উপকরণ হিসেবে।
এক সময় দেবতার তুষ্টির জন্য পাদুকা পূজার প্রচলন ছিল। হিন্দুদের মহাকাব্য রামায়নে খড়মের একটি বিশেষ ভূমিকা আছে। টরামচন্দ্র তাঁর স্ত্রী সীতা ও ছোট ভাই লক্ষ্মণকে নিয়ে বনবাসে গেলে তাঁর আরেক ভাই ভরত রামের খড়ম সিংহাসনের বসিয়ে রাজ্য পরিচালনা করেছিলেন। হিন্দুরা একে দেবতা ও শ্রদ্ধেয় সাধু-সন্ন্যাসীদের পদচিহ্নের প্রতীকও মনে করত। হিন্দুদের পাশাপাশি জৈনধর্মের ভিক্ষাজীবী সাধু-সন্ন্যাসীরা খড়ম ব্যবহার করতেন। বাংলাদেশেও একসময় এর প্রচলন ছিল। তখন জমিদার থেকে ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের সবাই খড়ম ব্যবহার করত। তখন পাদুকা বলতেই ছিল কাঠের তৈরি খড়ম। এছাড়াও খড়ম পায়ে হাঁটার সময় চটাশ্ চটশ্ যে শব্দ হয়, বাংলাদেশের লোকজ ছড়াটিতে বিষয়টি বর্ণনা করা হয়েছে:
হরম বিবি খড়ম পায়
খটটাইয়া হাঁইটা যায়
হাঁটতে গিয়া হরম বিবি
ধুম্মুড় কইরা আছাড় খায়
আছাড় খাইয়া হরম বিবি
ফিরা ফিরা পিছন চায় ….
পঞ্চাশ এমনকি ষাটের দশকেও গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে খড়ম ছিল। ষাটের দশকে ‘স্পঞ্জের ’ ফোমের ,রাবারের ও প্লাস্টিকের স্যান্ডেল পরা চালু হয়। তবে খড়ম ছাড়াও অভিজাত পরিবারগুলো ‘ চটি’ ব্যাবহার করতো। আশির দশকেও বাংলাদেশে অনেকেই ব্যবহার করতেন কাঠের পাদুকা বা খড়ম। এখন তেমন আর ব্যবহার হচ্ছে না। তবে বাংলাদেশে খড়মের ব্যবহার অনেক প্রাচীন।