পক্ষ নিতেই হবে। ব্রিটিশ আমলের আগে বাংলার বাণিজ্য, বৌদ্ধিক এবং কৃষ্টির যে পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটেছিল শাসকদের উৎসাহে, শুদ্র জাগরণের মধ্যে দিয়ে – তার একটা শ্রেয় যায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত পূর্ব জমিদারদের কর্মকাণ্ডে। নবাবি আমলে বিশেষ করে মুর্শিদকুলি আর আলিবর্দীর আমলে জমিদারদের বৈকুণ্ঠ দেখানো হত খাজনা আদায় ঠিক মত না হলে – তা নিয়ে জমিদারদের উত্তরাধিকারীরা পক্ষ নিতেই পারেন – কিন্তু সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতায় সিরাজ যে একা হয়ে যান – পলাশির পর অধিকাংশ জমিদার ব্রিটিশ পক্ষ নেন, এবং তারপরে তারা প্রায় নেই হয়ে গিয়ে, ছিন্নভিন্ন হয়ে নতুনভাবে আবির্ভূত হন সেটা তো ঘোর বাস্তব। সব থেকে বড় কথা সিরাজের সাম্রাজ্যের পরের বাংলা শতচ্ছিন্ন লুঠের জন্য পড়ে থাকা একটা ভৌগোলিক অবস্থান হয়ে দাঁড়ায়।

১।  আমাদের প্রশ্ন হল সিরাজকে কিভাবে দেখব – অবশ্যই নিজেদের অবস্থান থেকে আমরা নড়ছি না – তিনি মহান কেন? তার সময়ে একমাত্র তিনিই তার দাদুর মত বুঝেছিলেন লুঠেরা খুনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্য চরিত্র। দাঁতে দাঁত চেপে শেষ দিন পর্যন্ত লড়ে গিয়েছেন। সিরাজ খুন করিয়েছেন। ঠিকই, নানান রকম অভিচার ছিল তার, ঠিকইতো। কিন্তু তাঁর আগের কোন সাম্রাজ্য-পুত্র সিংহাসন পেতে খুন লড়াই করেন নি, ঘুষ দেননি, বাবার আমলের আমলাদের অপদস্থ করেন নি, রাজ্যের মেয়েদের হারেমে ঢোকাননি – তার ইতিহাস আর ঘাঁটতে ইচ্ছে করে না। এটা যারা পড়ছেন তাদের অনেকেই শিক্ষিত মানুষ, জানেন। শুধু বেঁড়ে ব্যাটাকেই ধর। কেন? তিনি সাম্রাজ্য-উপনিবেশ বিরোধী বলে?

২। তিনি দাদুর আলাল পৌত্র, আতুপুতু করে বড় হয়ে অবাধ ক্ষমতার অধিকার পেলে কি হয় তা আমরা ভারতের ইতিহাসে চোখের সামনে ঘটতে দেখেছি কয়েক দশক আগেই – সিরাজ ছিলেন তাঁদের থেকেও ক্ষমতাধর আর একগুঁয়ে। কিন্তু সিরাজকে নিয়ে ভালবাসা একটাই এই একজন মানুষ তাঁর কিছু সাথী নিয়ে শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়ে গিয়েছিলেন – ঠিক যেমন লড়েছিলেন ইন্দিরা – সাম্রাজ্যবাদের চক্রব্যুহে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের যুদ্ধে। কুমারবাবু যে ইতিহাসের পাতা উল্টেছেন তা হয়ত সবই ঠিক এবং এ নিয়ে আমার বা আমার দলের ব্যক্তিগতভাবে কিছু বলার নেই – এই নিয়ে শেষ কথা বলার যোগ্যতা আমার/আমাদের আছে বলে আমরা মনে করি না।

৩। কিন্তু ঐ যে, দাদুর থেকে পাওয়া ব্রিটিশ বিরোধিতায় ছিলেন খাঁটিতম। তাঁর ব্রিটিশ বিরোধিতায় অস্বস্তিতে পড়ে(আপনারা বলবেন তার বেলেল্লাপনায় – মাথা নামিয়ে মেনেও নিলাম) ভদ্রলোকেরা সরাসরি পলাশির চক্রান্তে সামিল হলেন। কিন্তু পলাশির পরে ভদ্রলোকেরা কি করলেন – ব্রিটিশদের সরিয়ে নিজেরা ক্ষমতায় এলেন? না তো! তাঁদের লুকোনো দাঁত, নখ ফোলাতে দেখা গেল ব্রিটিশ বাবাদের হয়ে দেশের মানুষের বিরুদ্ধে, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে নয়। প্রথমে ক্লাইভ পরে হেস্টিংসের পায়ে গড়াগড়ি খেয়ে বাংলায় অবর্ণনীয় লুঠ, অত্যাচার, কয়েক হাজার বছর ধরে তিলে তিলে  তৈরি উৎপাদন পরিকাঠামো ধ্বংসে হাত লাগালেন ব্রিটিশদের পঞ্চম বাহিনী হয়ে – সে ইতিহাসটা বোধয় — না থাক।

৪। কিন্তু তিন সত্যি, ব্রিটিশ বিরোধিতায় বাংলার ভদ্রলোকেরা তাকে পাত, সাথ দিলেন না। বাংলার প্রত্যেক ক্ষমতাবান যেভাবে ব্রিটিশদের সঙ্গে হাত মেলালেন আর তার পরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত শক্ত করার জন্য উঠেপড়ে লাগলেন, তার তুলনা তাঁরাই। যে তারাকে বাঁচাতে রাণী ভবানীর মত মহিয়সী নারী, যিনি ব্রিটিশদের লুঠেরা আখ্যা দেবেন এক চিঠি লিখে, সিরাজের বিরুদ্ধাচরণ করলেন কোমরে কাপড় বেঁধে – মা হিসেবে সেটা হয়ত ঠিকই ছিল – কিন্তু যে খাল কেটে কুমির আনলেন রাণী। তো, সে কুমির কাকে খেল? কোম্পানি মির কাসেমের মুখোশ পরে ১৭৬১তে আবিষ্কার করল রাণী ভবানীর যতদূর সম্ভব হরবন্দ পরগণার বিভিন্ন জমিদারি এলাকার খাজনা কোথাও ১০ লাখ টাকা কোথাও কুড়ি লাখ টাকা বাড়ানো যেতে পারে। কোম্পানি রাণীর  থেকে ৩১ লক্ষ টাকা বেশি খাজনা আদায় চাইল। রাণী অপারগ হওয়ার নবাবের রায়রায়াণ রাণীর জমিদারি চারভাগে ভাগ করে প্রত্যক ভাগ নিজের পেটোয়া আমিলদারের হাতে তুলে দিলেন। রাণীর পুরোনো আমলাদের কয়েদ করা হল। মির কাশেমের সঙ্গে ইংরেজদের যুদ্ধে আবার মির জাফর নবাব হলেন, মন্ত্রী হলেন নন্দকুমার। তাকে ঘুষ দিয়ে হাত করলেন রাণী। কিন্তু জমিদারি বাঁচানো গেল না। টুকরো টুকরো হয়ে গেল রাণী ভবানীর জমিদারিটি। তিনি অস্ত গেলেন কিন্তু ছিয়াত্তরের গণহত্যায় তার যতটুকু সম্বল ছিল সব জনগণের জন্যে খুলে দিলেন। মেরেফেলা হল জগতের শেঠ পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদেরকে। পলাশির লুঠের একটা টাকাও দেওয়া হল না।

৫। চক্রান্তে সামিল হওয়া প্রত্যেকটি ধনী ক্ষমতাশালী পরিবার, প্রত্যেকটি প্রখ্যাত মানুষকে খুন করে তাঁদের কোম্পানির পক্ষ নেওয়ার আর সিরাজ বিরোধিতার ধার সুদে আসলে উসুল করে নিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্য – কোথায় গেল বাংলার গর্বিত জমিদারির ঐতিহ্য? জমিদারি আর সমাজ ধ্বংস করে পলাশির পর যে বিপুল পরিমান সম্পদ উদ্বৃত্ত হল, তাঁর পরে আর ইওরোপ থেকে একটা পাউন্ডও বাংলায় আনতে হয় নি ব্যবসা করার জন্য – বরং বাংলার দামি ধাতু, সম্পদ থরে থরে চালান হয়ে গিয়েছে ইওরোপে  – চির অধমর্ণ ইওরোপ হয়ে পড়ল উত্তমর্ণ, বাংলা অধমর্ণ। পলাশির পর বাংলা শুধু নয় এশিয় উদ্বৃত্ত অর্থনীতি যে হেঁটমুণ্ড উর্ধ্বপদ হয়ে পড়ল – আজও সেই প্রবণতা পালটানো যায় নি – আমরা ভদ্রলোকেরা খেলে চলেছি ইওরোপিয় প্রসাদ সূত্রে আজও –  অধমর্ণের অভিনয়ে।

৬। কারু ও বস্ত্র শিল্পীদের হয়ে কাজ করেছেন বাংলার জমিদারেরা আর রাজপরিবারেরা। সত্যিই সিরাজ অর্থে আলিবর্দি পড়া ভাল – সিরাজ আর কতটা সময় পেলেন – ইংরেজের বিরুদ্ধে লড়াই করতেই তাঁর সময় কেটেগেল! সিরাজের পরে বাংলার গ্রামীন উৎপাদনের কি হাল হল সে মায়ের কথা আর মাসিদের কাছে কেন বলি – হয়ত ছোট মুখে বড় কথা হবে – চন্ডীচরণ সেনের নন্দকুমার… তথ্য উপন্যাসটি তার জ্বলন্ত উদাহরণ।

৭। আর আমরা যদি এই সময়ের সঙ্গে সেই সময়ের মিল পাই তাহলে কি খুব ভুল হবে?