টিপু সুলতান ছিলেন ভারতবর্ষের বিরল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন শাসকদের একজন যিনি তার রাষ্ট্র ও সেনাবাহিনীর আধুনিকায়নের উপর জোর দিয়েছিলেন। অষ্টাদশ শতাব্দীতে টিপু সুলতান ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাম্রাজ্যবাদী নীতিগুলো বুঝতে পারেন । তাই তিনি টিপু সুলতানের বাবা-হায়দার আলী, টিপু সুলতান ও হায়দ্রাবাদের নিজাম ও মারাঠা নিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে একটি যুক্তফ্রন্ট গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন ।
টিপু সুলতানের আধুনিক মনোভাব এবং জ্ঞানের গভীর সংযুক্তির অনন্য প্রমাণ হচ্ছে তাঁর ব্যক্তিগত লাইব্রেরি । যেখানে ছিলো আরবি, ফার্সি, সংস্কৃত, হিন্দি এবং অন্যান্য ভারতীয় ভাষাসহ ইউরোপীয় ভাষার বিরল পাণ্ডুলিপি । ১৭৯৯ সালে চতুর্থ অ্যাংলো-মাইসোর যুদ্ধে টিপু সুলতানের পরাজয়ের পর তার এই গ্রন্থাগারটি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি লুটপাট করে । এছাড়া যুদ্ধের পর গঠিত একটি কমিটি (পুরস্কার কমিটি) এই বইগুলো বিক্রি করার চেষ্টাও করেছিলো, কিন্তু তখন সেখানে এই ধরনের বিরল পাণ্ডুলিপি এবং বইয়ের জন্য কোনো মার্কেট ছিল না ।
ইংল্যান্ডে কোম্পানির সংগ্রহের জন্য প্রথম টিপু সুলতানের বই অর্ডার করতে চান ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পরিচালকরা কিন্তু তৎকালীন গভর্নর-জেনারেল ভেলেজালি এই বইগুলো কলকাতা থেকেই কিনেছিলেন । পরবর্তীতে ১৮০০ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হলে কলেজের লাইব্রেরীতে টিপু সুলতানের বই অন্তর্ভুক্ত করা হয় । ১৮০৯ সালে প্রকাশিত, টিপু সুলতানের বইয়ের প্রথম বিস্তৃত ক্যাটালগ তৈরি করেন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পার্সি শিক্ষক চার্লস স্টুয়ার্ট । তালিকা অনুযায়ী, টিপু ‘ র সংগ্রহে ভাষাবিদ্যা, কবিতা, ইতিহাস, সুফিজম, বিচার ব্যবস্থা, দর্শন, জ্যোতির্বিদ্যা , গণিত, পদার্থবিদ্যা, কোরআন এবং তার উপর লেখা মন্তব্য, তাজকিয়ার ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত ছিল।
স্টুয়ার্টের মতে, টিপু সুলতানের সংগ্রহে দুই হাজার বই ছিল…. ক্যাপ্টেন ডেভিড প্রাইস বলেন, আনুমানিক তিন থেকে চার হাজার বই ছিল । ঐতিহাসিক জশুয়া আর্লিচ তার ‘ দক্ষিণ এশিয়া ‘ পত্রিকায় লেখা ‘ পল্যান্ডার অ্যান্ড প্রেস্টিজ ‘ প্রবন্ধে ব্যাখ্যা করেছেন যে, ভারতীয় টিপু সুলতানের বই থেকে বেঁচে থাকা শত শত বই আজ ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে, যখানে কিছু বই ভারতীয় আর্কাইভ এবং এশিয়াটিক সোসাইটির সঙ্গে রয়েছে ।
টিপু সুলতান তার এই লাইব্রেরিকে শিল্প ও জ্ঞানের অসাধারণ সংগ্রহ হিসেবে দেখেছিলেন । যা সার্বভৌম ব্যক্তিত্ব এবং তার ক্ষমতার সাথে গভীর ভাবে সংযুক্ত ছিল । টিপু সুলতান তার বই রক্ষণাবেক্ষণ, সংরক্ষণ এবং লাইব্রেরী ম্যানেজারের কাছ থেকে নিয়মিত তথ্য পেতেন ।
বিখ্যাত ইতিহাসবিদ হিউ ট্রেভর- ‘রাজকুমারী ও শিল্পী’ নামে একটি বই রচনা করেছেন। সেখানে তিনি রসিয়ে রসিয়ে উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে বলেছেন,
“মাংসখেকো মানুষেরা যেভাবে মানুষের শরীরের প্রত্যেকটি অংশ আত্মতৃপ্তির সাথে ভক্ষণ করে, তেমনি ভাবে এই উপনিবেশিক শক্তিও তাদের রাজ্যের প্রতিটি ধন-সম্পদ ও গুরুত্বপূর্ণ জিনিস ভক্ষণ করে…… তখন তারা হয়ে ওঠে মাংস খেকো মানুষ গুলোর মতো। টিপু সুলতানের লাইব্রেরী লুটপাটের সময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিও একই মনোভাবের পরিচয় দিয়েছে যা না বললেই নয় ।”